সময়ের সাথে...... এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে যখন আগুন জ্বলছিল, তখন জনগণের যাঁরা মাথা, যাঁরা রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী—বহুসংখ্যক জাতীয় অধ্যাপক, উপাচার্য (সাবেক ও বর্তমান), অধ্যক্ষ, অধ্যাপকদের জ্বলে ওঠা উচিত ছিল। আগুনটা জ্বালিয়েছে যেহেতু সেক্যুলারদের সৈন্যসামন্তরা, সুতরাং অনেকে টুঁ শব্দটি করবেন না প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত হওয়ার ভয়ে। প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত যাঁরা দুবেলা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান, তাঁরা প্রতিবাদ করবেন না। কারণ, তাতে প্রগতিশীলতা থেকে খারিজ হয়ে যেতে পারেন। বাম দলগুলো সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ সংঘে পরিণত হয়েছে।
তাদের নীরবতাও অর্থবহ।
আমাদের শ্রদ্ধেয় জনাব নুরুল ইসলাম নাহিদ যদি নৌপরিবহন বা পানিসম্পদমন্ত্রী হতেন, তাহলে তাঁর চোখে পানি মানাত। তিনি স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী। ওই ছাত্রাবাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই ঘর। তাঁর চোখে আমি পানি প্রত্যাশা করিনি।
তা ছাড়া তাঁরই এককালের ছাত্রাবাস আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার দৃশ্য দেখে তাঁর চোখে আশা করেছিলাম আগুনের শিখা। চোখের পানিতে অপরাধীদের অপরাধ ধুয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।
নাশকতা শব্দটি যাঁদের ওষ্ঠে ধ্বনিত হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায়, বিরোধী দল হরতাল শব্দটি মুখে আনামাত্র ‘নাশকতা’ শব্দটি কোরাসের মতো গাইতে থাকেন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, গোয়েন্দা-পুলিশ ও দলীয় নেতারা—তাঁরা তো নিশ্চয়ই জানেন, ‘নাশকতা’ কাকে বলে। বিশ্বের ইতিহাসে শিক্ষাঙ্গনে এত বড় নাশকতা অতীতে আর কোনো দেশে হয়েছে বলে শুনিনি। শিক্ষা-সংস্কৃতিক্ষেতে এ রকম ধ্বংসযজ্ঞ একবার মাত্র হয়েছিল হালাকু খাঁর সময়ে, বাগদাদে।
বাংলাদেশ আজ এক ভূখণ্ড, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র এমনই তৎপর যে ভবিষ্যতে হয়তো অপরাধ করবে, এমন হবু অপরাধীদের কোমরে দড়ি পড়ছে। সেদিন ওই আদিম বর্বরতায় নকশি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, জিনসের প্যান্ট পরে, চাপাতি হাতে কারা কারা পেট্রল ঢেলে কাজটি সম্পাদন করে, তাদের ছবি ১৫ জুলাইয়ের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনার আট দিন পরে সিলেটের মাননীয় পুলিশ কমিশনার অবিচল মানবতাবাদীর মতো বলেছেন, ‘আমরা তদন্ত করছি। কাজ সম্পন্ন হলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ এটা তাঁর কথা নয়, সরকারের কথা।
ওই ৪২টি কক্ষে যাঁদের বিছানাপত্র, কাপড়চোপড়, বইপত্র, টাকা-পয়সা, মৃত মা-বাবার ছবি, প্রিয়তমার সবচেয়ে দুর্লভ প্রেমপত্র, ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত সবচেয়ে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ফটোগ্রাফটি পুড়ে ছাই হয়েছে, তাঁরা ওই পথ দিয়ে হেঁটে বা টেম্পোতে যাতায়াতের সময় ওদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। কারও চোখ ভিজে যাবে পানিতে, যেমন এখন ভিজেছে শিক্ষামন্ত্রীর চোখ। তাঁদের এখনকার দীর্ঘশ্বাসে ক্ষমতাবানদের একটি লোমও পুড়বে না। কিন্তু তাঁদের দীর্ঘশ্বাসের দাহ্যক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী। সেই দীর্ঘশ্বাসের তাপে অনেক কিছু পোড়ে।
ব্রিটিশ সরকার বিতাড়িত হয়েছে। সোহরাওয়ার্দীর সরকার শেষ হয়েছে। টিক্কার সরকার, আলীর সরকার ধ্বংস হয়েছে। সবই শেষ হয় ওই দীর্ঘশ্বাসে। জনগণ নিমিত্ত মাত্র।
সেদিন যারা ছাত্রাবাসে আগুন লাগিয়েছে, দোষী তারা নয়। অপরাধী আমরা ১৬ কোটি মানুষ। সরকারকে অনুরোধ করি, ওই ছবি প্রকাশের পর সেখানে যাঁদের দেখা যাচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অজ্ঞাত মানুষের নামে ভুয়া মামলা না করে, আমাদের ১৬ কোটি মানুষের নামে মামলা করুন। শাস্তি আমাদেরই প্রাপ্য।
সবশেষে স্বর্গত ভূস্বামী গিরিশচন্দ্র রায় ও তাঁর দাদু মুরারি চাঁদ রায়ের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই।
সোয়া শ বছর পরে আপনাদের আমরা অপমান করার ধৃষ্টতা দেখালাম। আমরা মানুষ না...... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।