অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...!
অল্পদর্শী
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রগুলো অনেকাংশই নৃত্য ও সঙ্গীত-নির্ভর। ভারতের মুম্বাই বা বলিউডের সিনেমা তো নাচ-গান ছাড়া জমেই না। আবার কে ভালো নৃত্যশিল্পী তা নিয়েও চলে তুমুল তর্কবিতর্ক। নৃত্য ভারতীয়দের ধর্মেরই এক অংশ। তাই সেখানে শিশুকাল থেকেই চলে নৃত্যচর্চার হাতেখড়ি।
আর বলিউডের সিনেমাগুলোতে নাচ না জেনে কেউ কখনো নায়ক-নায়িকা হয়েছে, এমন নজির সম্ভবত পাওয়া যাবে না। ভারতীয় নাচ আজ আর কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই, এখন তা এশিয়াবাসীর মন জয় করে পাড়ি জমাচ্ছে সুদূর পশ্চিমেও। কিন্তু আকার ইঙ্গিত-নির্ভর চিরায়ত ভারতীয় নৃত্যের অঙ্গভঙ্গি, পায়ের কাজ এবং পোশাক পরিচ্ছদের প্রকৃত অর্থ কী, তা পশ্চিমারা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি।
বলিউডের নাচ দেখতে সহজ। নাটকীয় মুখের অভিব্যক্তি এবং সিনেমাটিক আবহ নাচবোদ্ধা কিংবা নাচে আনাড়ি সব দর্শককেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
তবে ভারতীয় নৃত্য বস্তুত অসংখ্য ঐতিহাসিক প্রতীক ও ঐতিহ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। ক্ল্যাসিকাল নৃত্য (যেমন ‘ভরতনাট্টম’ ও ‘কত্থক’) এবং লোকনৃত্য (যেমন ‘ভাংরা’) সবই তাদের নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও তাদের মধ্যে প্রতীকী চিহ্ন ও অর্থবোধ আদান-প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক বলিউড নাচের আবির্ভাব ঘটায়। ভারতীয় নৃত্যশিল্পী ও ব্যালে নৃত্য পারদর্শী শক্তি মোহন, হানি, কালারিয়া ও অঞ্জলি মেহতা বিবিসিকে বলিউডের নাচের এই মৌলিক ব্যাপারগুলোরই বর্ণনা দিলেন।
হাতের শৈলী
হাতের নড়াচড়াগুলো হলো এক ধরনের প্রতীকী ভাষা; যার প্রতিটিই একেকটি কথা বলে। অনেক সময় তা পরিবেশ, প্রাণী বা বিভিন্ন জায়গাকে প্রতিপাদন করে।
ভরতনাট্টমে হাতের নড়াচড়াকে বলা হয় ‘হাসতাস’। একহাত দিয়ে করা হলে তাকে বলে ‘আসামিউক্তা হাসতাস’। আর দুই হাতের ব্যবহারে হলে তাকে বলে ‘সামিউক্তা হাসতাস’।
অনেকেই নাচের সঙ্গে ‘মুদ্রা’ শব্দটি শুনে থাকবেন। মুদ্রা হলো হাতের প্রতীকী চিহ্নের এক স্বতন্ত্র রূপ।
ক্ল্যাসিকাল ভারতীয় নৃত্যে সর্বমোট ১০৮টি মুদ্রা রয়েছে। একজন সার্থক নৃত্যশিল্পী হতে হলে এর সবকটিই দখলে থাকতে হবে। বলিউডের যেসব অভিনেত্রীর দখলে এসব, তিনিই চলে যান সামনের কাতারে।
লন্ডনে অবস্থানরত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী, ব্যালে নৃত্য পারদর্শী ও নৃত্য প্রশিক্ষক কালারিয়া বললেন, ‘আপনি যদি একজন বলিউড মুভির নৃত্যশিল্পী হতে চান, তাহলে এগুলোর (১০৮টি মুদ্রা) সবই আপনার জানা প্রয়োজন। মুভির গল্প তৈরি করতে এর সবগুলোই ঐতিহ্যবাহী ও সহায়ক।
’
ঘাড় ও মাথার শৈলী
পাশাপাশি ও সামনা-সামনি ঘাড়ের নড়াচড়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘পিজিয়ন হেড’। এটি নৃত্যের একটি আবশ্যিক নান্দনিক অংশ। এটি তারল্য বোধ তৈরি করে। একটি ভিডিওচিত্রে মোহনের অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে তা পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়ে। লন্ডনে ভারতীয় নৃত্য প্রশিক্ষক ও শিল্পী মেহতা বললেন, ‘ঘাড়ের নড়াচড়া নাচের অন্যতম প্রধান অংশ।
এটি দেখতে সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ’
মুখের ভাবভঙ্গি
ক্ল্যাসিকাল ভারতীয় নাচ দুটি উপাদানে গঠিত। ভারতীয় ভাষায় যাদের বলা হয় ‘অভিনয়া’ ও ‘নৃত্যা’। ‘নৃত্যা’ ছন্দ ও শারীরিক নড়াচড়ার মাধ্যমে সঙ্গীতের ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ‘অভিনয়া’ অভিব্যক্তি এবং আবেগের মধ্যেই নিহিত।
এর উদ্দেশ্য নাচের মাধ্যমে জীবনের গল্প ফুটিয়ে তোলা। মুখের ভাবভঙ্গি ও চোখের নড়াচড়া নাচের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ভারতীয় নাচে গল্প বলা ও আবেগ নিয়ে আসার দিকে সবসময় জোর দেয়া হয়। মেহতা বললেন, ‘চোখের উচিত হাতকে অনুসরণ করা। ’ তার মানে হলো চোখ খুব বেশি পরিমাণে নড়তে পারে।
প্রধান ভাবাবেগগুলো দেখানোর খুব কমই মুখভঙ্গি আছে। এগুলো হলোÑ রাগ, দুঃখ, সুখ ও ভালোবাসা। এগুলো চোখ ও ভুরুতেই ধরা পড়ে। মেকআপের সময় চোখে গাঢ় করে লাইন (আই লাইনার) টেনে দেয়া হয়, যেন তাদের নড়াচড়াগুলো সহজেই ধরা পড়ে।
পায়ের শৈলী
যখন নৃত্যশিল্পীরা তাদের পা খুব ধীরে ধীরে সমান তালে চালায়, তখন বুঝতে হবে এটি ক্ল্যাসিকাল নাচের একটি উপাদান; যার উৎস ভরতনাট্টম ও লোকনৃত্য।
‘ডান্স ইনডিয়া ডান্স’ বিজয়ী মোহন একটি ভিডিওতে ঐতিহ্যবাহী ভরতনাট্টম ও সমসাময়িক রীতির সংমিশ্রণে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন। তিনি বলেন, ‘বাহু দুটি থাকবে কোমরের ওপর, আর হাতের আঙুলগুলো থাকবে পেছন দিকে। ভরতনাট্টমে ফ্লোরে পা দিয়ে জোরে আঘাত করতে হবে। এটা করতে পা সর্বোচ্চ উপরে তুলে তারপর আঘাত করতে হবে। এই মৌলিক কাজগুলো আমি শিখেছিলাম যখন আমি সাত বছর বয়সে নাচ শেখা শুরু করেছিলাম।
’ একজন নৃত্যশিল্পীকে ডান পা তুলে হাঁটু বারবার ঘোরাতে হলে তার পুরো শরীরের ওজন একদিকে ছেড়ে দিতে হয়।
বলিউডের সিনেমাগুলোতে লাফিয়ে ওঠার যে দৃশ্য দেখানো হয়, তা করতে ‘চিকেন স্টেপ’-এ চলার কথা বলা হয়। এ শৈলীগুলোর ধারণকৃত এ ভিডিওটি ইউটিউবে পাওয়া যাবে।
পোশাক-পরিচ্ছদ
পায়ের গোড়ালিতে যে বেল বা ঘণ্টা বাঁধা হয়, তাকে বলা হয় ‘ঘুংরু’- এটি দক্ষ পায়ের কাজ এবং নৃত্যশিল্পীর সঙ্গীতের সঙ্গে সময়বোধের সংহতি (টাইমিং) বিধানে গুরুত্বপূর্ণ। ‘কত্থক’ নৃত্যশিল্পীদের পায়ের গোড়ালির চারপাশে কমপক্ষে ১০০টি বেল মোড়া থাকতে হয়।
‘ভরতনাট্টমে’ স্ট্রাপের ওপর বেল আটকানো অবস্থায় থাকে, যা গোড়ালির চারপাশে বাঁধতে হয়। আর ঐতিহ্যগতভাবেই খুব বেশি অলঙ্কার পরা হয়ে থাকে। অলঙ্কারের মধ্যে ‘চোকার’ থাকতে পারে (মাথায় পরা একটি লম্বা নেকলেস)। এই অলঙ্কারের বামপাশে চাঁদ ও ডানপাশে সূর্য থাকবে। মেহতা জানান, ‘ঐতিহ্যগতভাবে নৃত্য হলো দেব-দেবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং চাঁদ-সূর্যে তা প্রতিফলিত হয়।
’
নাচের দেবতা নটরাজ
নটরাজ হলো নাচের দেবতা শিবের চিত্রায়ন। ক্ল্যাসিকাল ও বলিউড নাচের দ্বারা প্রভাবিত। কালারিয়া বলেন, ‘বেশিরভাগ নৃত্যশিল্পী বাড়িতে কম করে হলেও একটি নটরাজ রাখেন। আমার কাছেও কিছু আছে। এটি হচ্ছে অজ্ঞতার ওপর বিজয়ের প্রতীক।
এটি অহংবোধের বিরোধী এবং এটি সত্য ও সত্তার কথা বলে। ’ তথ্যসূত্র : বিবিসি অনলাইন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।