বিশ্লেষনমুলক লেখা, না পড়াই ভালো..........
ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে সংবাদ মাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় যখন চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে লড়াই করেই সত্য প্রকাশের অধিকার ফিরে পায় সংবাদ মাধ্যম। যদিও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে এরশাদ জমানায় গ্রামের নিরক্ষর মানুষও আস্থা রেখেছিল বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার প্রতি।
সে সময় ‘দুর্নীতি পরায়ণদের উল্লাসনৃত্য’ প্রকাশ করে কোপানলে পড়েছিলো সাপ্তাহিক খবরের কাগজ। সমালোচনা সহ্য করেননি স্বৈরশাসক এরশাদ। বন্ধ করে দেয়া হয় খবরের কাগজ। উল্লাসনৃত্যের লেখককেও নানা হয়রাণীর মুখোমুখেী হতে হয়। তবে বন্ধ করে দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ আদালতে যায় খবরের কাগজ।
আইনী লড়াইয়ে জয় লাভ করে ফিরে আসে পত্রিকাটি। যার ফলস্বরূপ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক আমলে সংবাদপত্র স্বাধীনতার প্রশ্নে এগিয়ে যায় বহুদূর। সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণের ধারা উঠিয়ে দেন এই প্রধান বিচারপতি। এরপর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সংখ্যার দিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মিডিয়ার। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে সংবাদপত্রের সংখ্যা।
সর্বশেষ দুই আমলে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের উদ্বোধন হতে থাকে ক’দিন পরপরই। দুই ডজনেরও বেশি টিভি চ্যানেল এখন সক্রিয় বাংলাদেশে। কিন্তু একটি পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে প্রায় সর্বত্র। যা কিছু মুদ্রিত অথবা প্রচারিত হচ্ছে তার সবই কি সত্য? মিডিয়ার বিশ্লেষণে যোগাযোগ তত্ত্ববিদ মার্শাল ম্যাকলুহানের একটি তত্ত্ব আলোচিত হয়ে আসছে সারা দুনিয়ায়। তিনি বলেছিলেন, মিডিয়াম ইজ দ্যা ম্যাসেজ (বাহনই বার্তা)।
ম্যাকলুহান বুঝাতে চেয়েছিলেন, প্রকাশিত সংবাদে কি বলা হয়েছে তার চেয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন সংবাদপত্রে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদপত্রের নাম দেখেই লোকে বুঝে যায় ওই সংবাদপত্রে কি লেখা হয়েছে। এত বছর পর বাংলাদেশে ম্যাকলুহানের তত্ত্ব শতভাগ সত্যতা নিয়ে হাজির হয়েছে। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের পটভূমিতে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত। বেশিরভাগ মিডিয়া শাহবাগ আন্দোলনকে মহিমান্বিত করছে নানা বিশেষণে।
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে এ আন্দোলনকে অভিহিত করেছেন তারা। বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই ফিরে এসেছে। অনেক সময় শত লোকের উপস্থিতিকেও লাখো মানুষের সমাবেশ বলে প্রচার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন সংবাদপত্রে প্রধান শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে শাহবাগের খবর। দিনরাত আন্দোলন সরাসরি সমপ্রচার করেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া।
অনেক মিডিয়া হাউজ থেকে এ আন্দোলনে খাদ্য আর অর্থ সরবহরাহের খবরও এসেছে। অন্যদিকে, কিছু মিডিয়া শুরু থেকেই শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। শাহবাগ আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদীদের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তারা। এ যেন বুশ ডকট্রিনে চলছে বাংলাদেশ। হয় তুমি আমার পক্ষে না হয় বিপক্ষে।
এর মাঝামাঝি আর কোন জায়গা নেই। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর দেশব্যাপী সহিংসতার সংবাদ প্রকাশেও সংবাদ মাধ্যমের সত্য লুকানোর প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে। কেউ বলেছেন জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের কথা আবার কেউ বলেছেন শুধু পুলিশের নির্মমতার কথা। শত মানুষের হত্যাকাণ্ডের খবর সে অর্থে সংবাদমাধ্যমে তেমন কোন ঝড়ই তোলেনি। অনেকে এ হত্যাকাণ্ডের সাফাই গাওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
শাহবাগ আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট এই বিভক্তিতে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে সংবাদ মাধ্যমের নিজেরই। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এরই মধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সংবাদ মাধ্যমের খবরকে বিশ্বাস করছেন না মানুষ। বাহন দেখেই মানুষ বার্তা বুঝে নিচ্ছে। আর সত্যকে রীতিমত পাঠানো হয়েছে নির্বাসনে।
ভিন্নমতের সংবাদপত্রে আগুন দেয়া হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সব পক্ষ থেকেই এ ঘটনা ঘটছে। এ যখন অবস্থা তখন রীতিমত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম। বুশ ডকট্রিনের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ না করলে সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাস যোগ্যতার সঙ্কট আরও বাড়বে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই এখন ধ্বংসপ্রায়।
ফোর্থ স্টেট তথা সংবাদ মাধ্যম অতীতে জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে অনেকে বিকল্প পার্লামেন্ট হিসেবেও অভিহিত করেছেন একে। কিন্তু সেই সংবাদ মাধ্যম নিজেই এখন পথ হারিয়েছে। সংবাদ মাধ্যম বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে মানুষ বিশ্বাস করবে গুজবে। যা পুরো জাতির জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এর কিছু আলামত এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। জার্মান দার্শনিক নিটশে বলেছিলেন- মানুষ ভুল করে কোন কিছু করে, ভুল করে যে করেছিল পরে তাও ভুলে যায়। সংবাদ মাধ্যম যেন নিজের ভুল বুঝতে পারে সে প্রার্থনাই করি। ফিরে আসুক সত্য সংবাদ মাধ্যম।
লিঙ্ক:ww.mzamin.com/details.php?nid=NDcwODg=&ty=MA==&s=MTg=&c=MQ== ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।