নানা ধরনের বর্জ্যে অনেক আগেই দুষিত হয়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার পানি। এবার নদীটির পানিতে হাসপাতাল বর্জ থেকে নি:সৃত অ্যান্টিবায়োটিক মিশে যাওয়ার আতঙ্কজনক খবরও পাওয়া গেছে।
এমেক্সাসিলিন, পেনিসিলিন, সিপ্রোফ্লোক্সাক্সিন আর অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়েটিক ভাসছে এ নদীর পানিতে মিশে। এর ফলে ঢাকাবাসীর শরীরে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক।
স্বাস্থা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ ইত্যাদি হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়।
এর ফলে পানিতে মিশছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক।
যারা সরাসরি এ পানি ব্যবহার করছেন তারা তো বটেই, যারা ব্যবহার করছেন না তারাও পড়ছেন এর ক্ষতির আওতায়। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের কারণে এসব দ্রব্য ঢাকাবাসীর দেহে কোন না কোনভাবে প্রবেশ করছে। শাকসব্জি, বায়ু, বন্যার পানি বা মানবদেহ থেকেও মানবদেহে বিস্তার লাভ করছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক।
এছাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজ করছে নানারকম অব্যবস্থাপনা।
ফলে পাইপ লাইন দিয়ে সুয়ারেজের ময়লা এসে সরাসরি মিশে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানিতে। নদীতে চলাচলকারী নৌযান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার কালো তেল, পোড়া মবিল ফেলে বুড়িগঙ্গার পানিকে আরো বেশি দূষিত করা হচ্ছে।
উপরন্তু নদী তীরবর্তী লালবাগ, সোয়ারীঘাট, শহীদনগর, চাঁদনীঘাট, লালকুঠি, মালিটোলা, মিলব্যারাক ইত্যাদি এলাকায় অভ্যন্তরীণ পয়:লাইনের সংযোগ রয়েছে পুরনো ড্রেনেজ লাইনে। বাদামতলী ও শ্যামবাজারের কাঁচা সবজির বাজার থেকে পরিত্যক্ত সবজি ও ময়লা ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানিতে। পাশের শিল্প কারখানার সায়ানাইড, পারদ, ক্লোরিন, নানারকম এসিড, দস্তা-নিকেলসহ মোট ৬২ প্রকারের রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে মিশে যাচ্ছে।
এছাড়া টেক্সটাইল, ব্যাটারি, লোহা, রঙ, রাবার কারখানার বর্জ্য মিশছে নদীতে।
বুড়িগঙ্গার এই পচা পানির কারণে আমাশয়, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে ভুগে প্রতিদিনই কোনো না কোনো হাসপাতালে ছুটছে মানুষ।
২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছিলো- বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এই পানিকে আর পানি বলা যায় না৷ আদালত মনে করেন- এতে সারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে৷
আদালত বলেন, ‘এ অবস্থার আশু সমাধান না হলে নাগরিকরা আরো ব্যধিগ্রস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পরিবেশ রক্ষা যেন কারোরই দায়িত্ব নয়৷`
ওই সময় বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালী এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন লাইন এক বছরের মধ্যে বন্ধ করতেও ওয়াসা চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন আদালত। নদী দূষণরোধে কোন গাফিলতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়। কিন্তু এ উদ্যোগ ওই পর্যন্তই।
বরং দিনে দিনে আরো বেড়েছে নদী দূষণ। কিন্তু অবস্থা পরিবর্তিত হয়নি, বরং দূষণ আরও বেড়েছে।
মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকার প্রাইভেট হাসপাতালগুলো তাদের বর্জ্য গোপনে এই নদীতে ফেলে। আবার তাদেরও না ফেলে উপায় নেই। কারণ, এগুলোর রিসাইকেল করার মতো আধুনিক ডাম্পিং ব্যবস্থা নেই।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনে ফেললেও সেখানে এসব হাসপাতাল বর্জ্য একইভাবে থাকছে। সেহুলো আবার কোন না কোনভাবে পানিতে গিয়ে মিশছে। সুতরাং এখান থেকেই সমস্যা।
মিশে থাকা এসব অ্যান্টিবায়েটিক মানবদেহের ভীষণ প্রভাব রাখে। এসব বর্জ মানবদেহে নানাভাবে প্রবেশ করার ফলে দেহে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে অ্যান্টিবায়েটিক।
তাই হয়তো কোন রোগে অ্যান্টিবায়েটিক খেলেও কাজ হচ্ছে না।
বুড়িগঙ্গা নদীকে গিলে খাচ্ছে পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্পকারখানার বিষাক্ত ক্যামিকেলস ও বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত ক্যামিকেলস, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল, মবিল, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য ও নদীর পাড়ে নির্মিত কাঁচা পায়খানা।
বুড়িগঙ্গায় স্রোত না থাকায় বিষাক্ত বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে সঙ্গে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ। ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এমনকি পারদের মতো ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের ভারে নদীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পরিশোধন করেও এ পানি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।
আজ থেকে ৫০ বছর আগেও বিকাল-সন্ধ্যায় ঢাকার মানুষ চলে যেত বুড়িগঙ্গার নির্মল বায়ু সেবনের জন্য। অনেকে নৌকা ভাড়া করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াত নদীর বুকে। সেই সদরঘাট, সোয়ারিঘাট ও বাকল্যাণ্ডের বাঁধের ধারে ভ্রমণ আর নির্মল বায়ু সেবন এখন অকল্পনীয়।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলেন , বাংলাদেশে অনেক রোগে অ্যান্টিবায়েটিক কাজ করে না। কারণ, নানাভাবে অ্যান্টিবায়েটিক আমাদের শরীরে জমে থাকছে।
এতে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ফলে রোগাক্রান্ত হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেলেও কাজ হচ্ছে না। এ ব্যপারে আমাদের দেশের ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই দায়ী।
প্রতিদিন ১০ হাজার ঘণমিটারের বেশি বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। এছাড়াও নদীর তলদেশে জমা হয়েছে ৮ ফুট পলিথিনের স্তর।
বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পানির বিষাক্ত মাত্রা এতই বেশি যে, নৌকার মাঝিরা পর্যন্ত হাতে-পায়ে গ্লাভস ব্যবহার করে নৌকা চালাচ্ছেন। কিন্ত তাতেও রেহাই পাবার উপায় নেই। কারণ, পানি কোন না কোনভাবে মানবদেহে মিশে যাচ্ছে।
বুড়িগঙ্গার পানি দূষন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যে এভাবে একদিন এ নদী হয়তো হারিযে যাবে। ঢাকা বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত একথা হয়তো আর বলা যাবে না ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।