নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা ।
ফিরে এসো কৃষ্ণচূড়া ..... ( গল্প )
চৈত মাসের রোদে নিজের ছায়াটাও যেন ভাজা ভাজা হয়ে যাচ্ছে নয়নের এখোন । এমোনটা ভাবার আগেই শিউলি ফুলের মতো টুপটাপ ক’ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়েছে কপাল থেকে । কাঁচের জানালার ওপর বৃষ্টিধারা নেমে আসার মতো জুলফি বেয়েও নেমে এসেছে লবনাক্ত ঘাম সড়সড় করে ।
রুমালটা ভিজে গেছে বেশ অনেক আগেই । ওটাকে ব্যবহার করা আর না করা প্রায় সমান । তাই বসেই থাকলো নয়ন । আর তখনই মনে হ’লো কথাটা । এটা একটা আহাম্মকি কাজ হয়ে গেল মোনে হয় ।
এই রোদ্দুর মাথায় নিয়ে এতোটা পথ আসা ঠিক হয়নি । কেউ একজন তাকে নিতে আসার কথা । অথচ তেমন কাউকেই দেখছে না সে ।
তবে কি ….
তবে যে কি সেটাও এখোন মাথাতে আসছে না । গন্ডোগোলটা পাকানোর জন্যে দায়ী নয় সে মোটেও ।
আবার দায়ী না ই বা কেন ! ঝামেলায় না জড়ালেই পারতো ! তাও তো সে পারেনি । কেন যে কেটে পড়তে পারলোনা সে ! আটকে গেলো কেন আঠার মতো !
গল্পটা লিখে আর তা ছাপার অক্ষরে বেরুতেই এই ঝামেলায় পড়ে গেছে নয়ন । একুশে বইমেলায় গল্পের বইটি বের হয়েছিলো তার । অনেকটাই নতুন লেখক । আবেগের টৈ-টুম্বুর বয়স তাই বইয়ের নামখানাও ছিলো উথাল পাথাল করা- “ ফিরে এসো অনিন্দিতা” ।
সাড়া তেমন একটা না ফেললেও ঝামেলাটার শুরু এখান থেকেই । আর তার নেট রেজাল্ট হ’লো এই । এই ঠা-ঠা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে একজনের অপেক্ষায় বসে থাকা । যিনি অপেক্ষা করিয়ে রাখছেন তিনি কি বোঝেন, অপেক্ষায় লেপ্টে থাকে কতো যন্ত্রনা ! বোঝেন কিনা, এতোদিনের আলাপেও নয়ন বুঝে উঠতে পারেনি । দোষটা যে নয়নের এমোন নয় ।
আলাপ বলতে তো শুধু
ই-মেইলেই যতো কথা । এতে কিছু বোঝা যায়না পরিষ্কার । দু’জনার মাঝে কখোনও ফোনে কথা হয়নি । ওদিকের তরফ থেকে কোনও তাগাদা ছিলোনা সরাসরি কথা বলার ব্যাপারে । কিন্তু নিজের ভেতরে যে সে আকাঙ্খাটুকু একবারও ডানা ঝাপটায়নি একথা হলফ করে কি বলতে পারবে নয়ন !পারবেনা ।
আকারে ঈঙ্গিতে ফোনের নম্বরও চেয়েছিলো সে । তার আকার ঈঙ্গিত উপেক্ষিতই থেকে গেছে । উপেক্ষার অনেকগুলো কারনও সে নিজে নিজে তৈরী করে মনকে বুঝ দিয়েছে ।
এখোন, এই মূহুর্তে চৈত মাসের শেষ হপ্তায় অজানা অচেনা এই রংপুর শহরে ঘেমে নেয়ে একা একা অজানা কারো অপেক্ষায় বসে থাকা ঠিক হলো কিনা এমোন ভাবনার বুঝ পাচ্ছেনা সে । সামনের চায়ের দোকানে ছায়া ফেলা কৃষ্ণচূঁড়া গাছে যে আগুন লাগতে শুরু করেছে তার দিকে চোখ গেলেই বিরক্তিটা নয়নের বাড়ছে আরো ।
অথচ মানিক মিয়া এ্যাভেন্যু’র আয়ল্যান্ডে ফুল ফোঁটার দিন কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার রঙ যে তাকে কতোদিন কতোভাবে যে মাতাল করে দিয়েছে, তা তো সে নিজেই জানে । আর কেউ কি জানে ! জানানোর সুযোগ হয়নি ।
আজ সেই লাল রংয়ের দেখা পেয়েও নয়নের ইচ্ছে হচ্ছে নিজের হাত নিজেই কামড়ানোর । যতোবা্রই তার চোখ কৃষ্ণচূড়ার দিকে গেছে ততোবারই যেন তার গায়ে আগুনের ছ্যাকা লেগেছে । রুমালটা নিংড়ে ঘাড়ে বোলালো সে ।
তাকালো এদিক ওদিক । চায়ের দোকানের পাশে কৃষ্ণচূঁড়া গাছটির নীচে অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বাদে আর সব স্বাভাবিক । একটি শহরে যেমন থাকার তেমনই আছে অথচ তাকে নিতে আসার মতো কাউকে দেখছে না সে । কে আসবে তাকে নিতে ? আর কি অপেক্ষা করা উচিত তার ! ফোন করে জেনে নেয়ারও কোনও সুযোগ নেই ।
ধেত্তেরী... আহাম্মক আর কাকে বলে .. মনে মনে নিজেকেই গাল দেয় নয়ন ।
সে আহাম্মক নয়তো কি ? কেউ এভাবে ক’দিনের মেইল আলাপেই এতোদুর ছুটে আসে ? একটা ঠিকানা নেই, নেই একটা ফোন নম্বর পর্য্যন্ত । শুধু আহাম্মকই নয়, বিশ্ব আহাম্মক । তার কি বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গেছে ? না কি একটা রোমাঞ্চের নাগাল পেতে তার প্রান মন উতলা হয়ে ছিলো বলেই আর কোনও বাস্তবতা তার মাথাতে ঢোকেনি ? মেইলে শুধু আহ্বান ছিলো – আসবেন তো ? এলে আমি লোক পাঠাবো । নয়ন দিন তারিখ সময় সব মেইল করে জানিয়ে ছিলো । ওদিক থেকেও সব ঠিকঠাক থাকবে এই জবাব এসেছিলো ।
নাহ এ নিয়ে এখোন ভেবে কোনও লাভ নেই । অনেক বোকামী হয়েছে । ফিরতি বাস ক’টায় জানতে হবে । আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো সে । পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ঝোলালো ঠোটে ।
এই যাহ... ম্যাচ বা লাইটার নেই । রাখার অভ্যেস ও নেই । হালকা ছোট্ট ট্রলি ব্যাগটা টেনে রাস্তা পেরুতে শুরু করলো নয়ন । সামনে চায়ের দোকান । রাস্তা পেরুতে পেরুতে আড়চোখে আবারো দেখলো মেয়েটিকে ।
দেখার মতোনই । কারো জন্যে অপেক্ষা করছে কি মেয়েটি ? আজকাল প্রায়ই দেখা যায় ছেলেমেয়েরা কেউ একজন অপেক্ষা করে অন্য জনের জন্যে । ঘনঘন ঘড়ি দেখে কিম্বা মোবাইল টিপতে থাকে । অস্থির অপেক্ষা । এরকম কোনও প্রতীক্ষার অভিজ্ঞতা নেই নয়নের ।
এতোদিন না সে কারো জন্যে কিম্বা আর কেউ তার জন্যে অপেক্ষা করে থেকেছে কখোনও । অথচ আজ কয়েক’শো কিলোমিটার দুরে এই চৈত্রের ভর দুপুরে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া এক অজানা অচেনা শহরে বোকার মতো হাজির হয়েছে সে কারো অপেক্ষায় । বিরক্তি নিয়ে দোকানের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে ঝোলানো লাইটার মুখের কাছে ধরে মুখটি নীচু করতেই কানের কাছে ঠুংঠাং আওয়াজ ।
কৃষ্ণচূড়ার মেয়েটি । এতোক্ষনে নয়নের তেতে ওঠা চোখেমুখে স্নিগ্ধ একটা পরশ দোলা দিয়ে গেল যেন ।
তার আরো কাছে সরে এসেছে মেয়েটি । গরমে ঘেমে নেয়ে ওঠা নয়নের বুকের কোথাও অস্থিরতা বাড়লো বটে কিন্তু তেমনতরো অস্থিরতা দেখা গেলোনা মেয়েটির মধ্যে । মেয়েটি মুখের এতো কাছে যে সিগারেটের ধোঁয়াটা গিলেই ফেলতে হলো নয়নকে । মেয়েদের দিকে ধৌঁয়া ছোড়ার মতো সাহস ছিলোনা কোনও কালে নয়নের । এরকম কোনও রুচিও মনে হয় তার ভেতরে গজিয়ে ওঠেনি এখোনও ।
‘সিগারেট খাচ্ছেন কেন ?’ সরাসরি প্রশ্নটি এলো মেয়েটির দিক থেকে । কাকে উদ্দেশ্য করে বলা বুঝতে না পেরে বোকার মতোই বলে উঠলো নয়ন বা বলা চলে তার মুখ থেকে ফসকে বেরিয়ে গেল –‘আমাকে বলছেন?”
এখানে তো আর কাউকে দেখছিনা – কাটা কাটা উত্তর এলো কৃষ্ণচূড়ার দিক থেকে । ভয় পেলো নয়ন । একটা ঝামেলার আভাস পাওয়া যাচ্ছে । এদের কে খুব ভয় নয়নের ।
অবশ্য কৃষ্ণচূড়াকে সে রকম লাগছেনা দেখতে । খুব খটোমটো সাজ, তা নেই । স্নিগ্ধ । আবার একটু যেন কেমন কেমন ।
“ও.. তাহলে আমাকেই বলছেন ?” আর একটু সাহসে ভর করে বলে নয়ন –“ খুব যে গায়ে পড়ে বলছেন ! আমাকে চেনেন আপনি ?” রংপুরের মেয়ের কাছে হারতে রাজী নয় ঢাকার ছেলে ।
কথাটি বলে ফেলেই একটা সন্দেহ চকিতে উঁকি মেরে যায় নয়নের মনে ।
হে খোদা , তাই যেন সত্য হয় !
“ গায়ে পড়া মানে ? গায়ে তো পড়েই আছি । ” তীর্যক চোখের মাধুরী মেশানো বাঁকা একফালি উত্তর উড়ে আসে কৃষ্ণচূড়ার নরোম ঠোট ছুঁয়ে ।
অবাক হয় নয়ন । গল্প লেখার সুবাদে কতোকটা অভিজ্ঞতা আর কতোকটা অনুমান এবং কল্পনা মিলিয়ে তার ধারনা, এরকমটা তো কেবল ঢাকা শহরেই ঘটা সম্ভব ।
এটা ঢাকা নয় । মফস্বলের একটি শহর । মেয়েরা এতো ফার্ষ্ট হয়ে গেছে, এখানেও ! কতো তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে সবকিছু ! তার সাথে তাল মেলাতে পারছে কি সে !
“আপনি নয়ন । ঢাকা থেকে !” প্রশ্ন নয় । মন্তব্য ।
ধাক্কা লাগে নয়নের । এই মেয়েটিই যদি তার পথ প্রদর্শিকা হয়ে থাকে তবে.... । তবের উত্তর ভেবে বের করার আগেই আবার মুখ খোলে কৃষ্ণচূড়া – “ খুব কষ্ট হলো আপনার, নাহ ? যা গরম পড়েছে আজ ! ঘেমে নেয়ে গেছেন দেখছি । ”
এতোক্ষনে ধাতস্থ হতে পারে নয়ন - “আপনিই যদি আমাকে নিতে এসেছেন তবে প্রায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন ওখানটাতে ?” হাত তুলে কৃষ্ণচূড়া গাছটি দেখালো নয়ন ।
এই প্রথম মেয়েটি চোখে চোখ রাখে নয়নের - “ আপনাকে দেখছিলাম ।
”
সুন্দর চোখ । হরিনীর মতো না হলেও চোখ টানে । মনের ভেতরে সাহিত্যিক নয়নের কবিতার লাইনগুলো ঘাই মেরে উঠতে চাইলেও সামলে নেয় নয়ন ।
“ আমাকে দেখছিলেন মানে ? আমাকে চিনতে তো সময় লাগার কথা নয় । বলা্-ই তো ছিলো ক’টার সময় আসছি, কিসে আসছি, পরনে কি রঙের পোষাক থাকবে ।
” ঝাঁঝালো রাগের মাথায় কথাগুলো বললেও তেমন যেন রাগ করতে পারলোনা নয়ন । কৃষ্ণচূড়ার সাথে রাগ করা যায়না । একটু ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় নয়নের চোখের পাতায়, মুখের রেখায় ।
- ‘না..হ, ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না কি করবো আমি । ’ কৃষ্ণচূঁড়ার কথায় যেন একটা দ্বিধার আভাস ।
- ‘ঠিক বুঝলাম না, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ! আমাকে নেয়ার জন্যেই তো আপনাকে পাঠানো হয়েছে তাইনা ?’
- ‘না আমাকে কেউই পাঠায়নি । নিজেই এসেছি । ’ চোখ নত হয় কৃষ্ণচূড়ার ।
নয়নের কি আজ কেবল অবাক হবার দিন ! যার সাথে গেল বেশ কয়েকটি মাস প্রায়ই মেইলে আলাপ- চারিতা চলেছে সে এমোন কেউ একজন হবে কখোনও মনে হয়নি । নয়নের লেখা গল্পের সাথে নাকি তার জীবনের মিল আছে অনেকটাই, বলেছিলো সে লেখায় ।
তাই খুঁজে খুঁজে নয়নের মেইল আইডি বের করেছে বই প্রকাশকের কাছ থেকে । তারপরেই জানতে চাওয়া, নয়ন এই গল্পটি কোথায় পেয়েছে । গল্পের পাত্রপাত্রীকে নয়ন চেনে কিনা । ইত্যাদি হাযারো প্রশ্ন । জবাব দিতে গিয়ে নয়নের মনে হয়েছে, আরো একটি নতুন গল্পের চারাগাছ গজাচ্ছে কোথাও ।
অন্য রকমের গল্প । তাই মেইলে আলাপ চালিয়ে গেছে নতুন কিছুর আশায় । আর পরে, কেমন যেন শিহরন শিহরন জাতীয় একটা ঘোরে । আর তা করতে গিয়ে নয়ন জেনেছে, তার গল্প “ফিরে এসো অনিন্দিতা”র নায়িকার জীবন কাহিনী নাকি অনেকটাই মেইল প্রেরিকার মতো । নামটিও কাছাকাছি – ‘নীতা’ ।
নয়ন এতোসব জানলো কি করে এই নিয়ে জানতে চাওয়ার হুটোপুটি ঐ তরফ থেকে । নয়নের নিজের সম্পর্কেও জানতে চাওয়া । এমোন জলজ্যান্ত টৈ-টুম্বুর তরুনী একজনের সাথে সে যে এতোদিন কথাদের মালা গেথে এসেছে, তা নয়নের ধারনায় ছিলো না । তার গল্পের নায়িকার বয়স ত্রিশের শেষ ঘরে । নয়ন ধরেই নিয়েছিলো মেইল প্রেরিকা এর কাছাকাছি একটা বয়সের ।
বিবাহিতা হতেই হবে নইলে গল্পের সাথে মেলেনা । নতুন গল্পের খোঁজেই নয়ন এখানে আসার আমন্ত্রন গ্রহন করেছিলো । তার গল্প যে কারো জীবনের সাথে মিলে গেছে এতেই অবাক নয়ন । আর অদেখা একজনকে দেখার মোহও যে ছিলোনা এর পেছনে, তা-ই বা সে কি করে অস্বীকার করবে ।
এখোন দেখছে, কিছুই মিলছেনা; যদি কৃষ্ণচূড়া সত্যি কথা বলে থাকে ।
গল্প আর একদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে ভেতরে ভেতরে একটা শিহরন, একটা মিষ্টি আবেশ তৈরী হয়ে যাচ্ছে নয়নের । গল্পের গল্পকেও যেন হার মানিয়ে দিয়েছে অজানা অচেনা রংপুর শহরের এই চৈত্রের খড়দাহে পুড়ে যাওয়া দুপুরের ঘটনাটা । বাস্তব কি এতোই সিনেমার মতো হয় ! দিন যতোই যাচ্ছে নয়নের ভান্ডারে নতুন নতুন অবাক করা কান্ডকারখানা একটা একটা করে জমছে । কি বিচিত্র মানুষ আর তার চারপাশ ! নয়ন কি তবে সেই আদ্যিকালের যুগে পড়ে আছে এখোনও ? নয় কেন ! নয়নের তো তেমন কোনও বন্ধুবান্ধব নেই, আড্ডা নেই । ছলাকলা বোঝেনা, কথা প্যাঁচাতেও পারেনা কখোনও ।
মেয়েদের দিকে সে রকম ভাবে তাকিয়ে দেখাও হয়নি কোনওদিন । নির্মল আছে বলেই বেশ কিছুটা অন্যরকম সাহস আছে বুকে তার । সে সাহসে ভর করেই এগোয় নয়ন এখোন
-“ ও.. তাহলে এতোক্ষন আমাকে এই রোদ্দুরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন কেন ?”
একটু ইতস্তত কৃষ্ণচূড়া । ঝাঁঝের সাথে জবাব আসে – “ বল্লামই তো, ঠিক করতে পারছিলাম না কি করবো আপনাকে নিয়ে । ”
“ আমাকে নিয়ে কি করবেন মানে ?” নয়ন ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা কৃষ্ণচূড়া রেগে গেল কেন ।
“আপনি চলে যান নয়ন । শেষ বাসটি হয়তো ছেড়ে যাবে একটু পরেই । ” কৃষ্ণচূঁড়া বা নীতা যে নামই হোক, সে মেয়েটির গলায় যেন উৎকন্ঠা ঝরে একটু ।
নয়ন হতভম্ব । এ সব কি বলছে মেয়েটি তাকে ! এটা তো ফাজলামোর কোনও ব্যাপার নয়, সে রকম সম্পর্কও নয় ।
দিনে দিনে যে ভালোলাগাটুকু তার তরফ থেকে মিছরির দানার মতো ধীরে ধীরে জমছিলো ওপাশের ছোঁয়ায়, তা কি আসলেই কোনও ভ্রম ! এটা যেন নয়নের জীবনে ঘটেনি ! এত্তোদুর টেনে এনে তার সাথে এমোন মস্করা করার কথা ভাবতেও পারছেনা নয়ন । কিন্তু সে তো স্বপ্নও দেখছেনা । কানে ভুল কিছু শুনেছে কি !
চারপাশে আর একবার চোখ বোলায় নয়ন । নাহ... এই তো সে একটা চা’য়ের দোকানের সামনে দাঁড়ানো । যাকে দেখার তীব্র একটা আকাঙ্খা নিয়ে এদ্দুর সে ছুটে এসেছে, সেই একজনও দিব্যি তার সামনে ।
কোথায় যেন একটা গন্ডগোল আছে । ঠিক ধরতে পারছেনা সে । কৃষ্ণচূঁড়াকে ঘিরে একটা মোহ যেমন লতিয়ে উঠছে তেমনি একটা আতঙ্কও যেন বেয়ে বেয়ে উঠতে চাইছে তার মনের ভেতর । কৃষ্ণচূঁড়ার যা বয়স আর সে ই যদি তার গল্পের নায়িকার চরিত্রটি দাবী করে তবে বুঝতেই হবে আগাগোড়াই মিথ্যে বলা হয়েছে তার সাথে । কিন্তু কেন ?
কিন্তুটি কি এই যে, নয়ন ভয়ঙ্কর কোনও কিছুতে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে ? আবার তার ভেতরের কেউ একজন সায়ও দিতে পারছেনা যেন তাতে ।
নয়নের ভেতরে দু’টো নয়ন বসে আছে যেন মুখোমুখি । যে গল্পকার গল্পের জটের সমাধান দিয়ে ফেলে কলমের এক খোঁচায়, সেই গল্পকারই এখোন তার জীবনের জটিল এক অধ্যায়ের সামনে নবীস খেলোয়ারের মতো মধ্যমাঠে দাঁড়িয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে । তবে কি সে একটা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে ! ভেতর থেকে কে একজন বলে উঠলো, ‘পালাও নয়ন, পালাও’ ।
“আমাকে আপনি চলে যেতে বলছেন ? তাহলে ডাকলেন কেন ?” আর একজন নয়ন এতোক্ষনে কথা বলে । যে ভালোলাগা এতোদিন ধরে একটু একটু করে কুঁড়ি মেলতে শুরু করেছিলো তা যেন হঠাৎ করেই নোংরা কীটদংশনে গুটিয়ে যেতে শুরু করে ।
একটা কষ্ট আর রাগ তার শরীরে আগুন জ্বালাতে থাকে যেন । নিজের এই আহাম্মকীর শেষটুকু দেখে যেতে চায় নয়ন ।
-‘আপনার নাম নীতা নয় । আপনি সম্ভবত আমার সাথে মিথ্যাচার করে এসেছেন এ্যাদ্দিন , তাইনা ?’
উত্তর দিতে সময় নেয় কিছুটা কৃষ্ণচূড়া । সেই সময়টুকুতে গভীর করে একবার চোখ রাখে নয়নের চোখে ।
-‘ নয়ন, এখানে থাকা আমাদের ঠিক হচ্ছেনা । আসুন আমার সাথে । ’
কি একটা আশংকায় একটু কেঁপে ওঠে নয়ন । আবার কৃষ্ণচূড়ার চোখে কি যেন একটা দেখে ভালোও লাগে, ভরসাও পায় । নয়ন কিছু বলার আগেই চলতে শুরু করেছে কৃষ্ণচূড়া ।
অবাক হওয়া আর একটা অঘটনের আশংকায় বুক দুরু দুরু করা নয়নের চোখেও পড়েনা যে, হাটাতেও ছন্দ আছে কৃষ্ণচূড়ার । পেছনটা দুলছে দুলছে... যেন ঢেউ । হাত তুলে রিক্সা থামায় কৃষ্ণচূড়া । চোখের ঈশারায় নয়নকে উঠতে বলে নিজেও উঠে বসে । পরিচিতা কিম্বা অপরিচিতা কারো সাথে এরকম বসার অভিজ্ঞতা নেই নয়নের ।
সংকোচ ঘিরে ধরে তাকে । কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকাতেই তার চোখে অস্বাভাবিক একটা তাড়া দেখে যেন সে । উঠে বসতেই হয় । পথে আর কোনও কথা নয় । পাচঁ মিনিটের মাথায় একটা টিনশেড বাড়ীর সামনে থামে কৃষ্ণচূড়া ।
পথে আসতে আসতে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দেখা মেয়েটিকে কৃষ্ণচূড়া নামেই মনে মনে নামকরন করে ফেলে নয়ন । কিন্তু কতো কথাই তো ছিলো বলার , এতোদিন বসে বসে নয়ন যা ভেবে এসেছে । বলার মতো পরিস্থিতি নেই এখোন । কেমন যেন একটা রহস্য । একটা অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেছে মাঝখানে ।
আহামরি তেমন কিছু নয় বাড়ীটা । বাইরে থেকে বন্ধ । নিজেই তালা খোলে কৃষ্ণচূড়া । পুরোনো ধাঁচের ময়লা সোফায় বসতে হয় নয়নকে ।
-‘ এটা আমার নিজের বাড়ী নয় ।
সিন্ডিকেটের বাড়ী । সংক্ষেপে বলছি আপনাকে । সময় নেই বেশী । ’ মুখ খোলে কৃষ্ণচূড়া, ইতস্তত ।
ঘটনার প্রেক্ষাপট, পরিবেশে এতক্ষনে নয়নের কিছু বোঝার বাকী থাকার কথা নয় ।
থাকলোও না । এরকম ঘটনা সে খবরের কাগজে পড়েছে অনেক । অনেক গল্প ফেঁদে শিকার ধরা । তারপরে মোটা অংকের টাকা । কেলেঙ্কারীর খেসারত ।
যারা এই যুগেও এমোন ঘটনার শিকার তাদের মাথাতে যে সামান্য বুদ্ধিও নেই এটা ভেবে নয়ন মনে মনে বলেছ – ঠিক হয়েছে । এই সব ছেদো গপ্পে যদি কেউ ধরা খায় তবে এমোন আহাম্মকদের আক্কেল সেলামী দেয়াই উচিৎ ।
এখোন নিজেকে কি বলবে নয়ন ? লোভে নাকি পাপ হয়, তা থেকে মৃত্যু । নয়নের কি হবে !
কৃষ্ণচূড়া, তার ত্রস্ত ভঙ্গিমা, কথার ধরন, হুট করে চলে আসা, সব মিলিয়ে মারাত্মক কিছু যে হবে না এটা অনুভব করতে শুরু করেছে নয়ন ।
হাত বাড়িয়ে কথা থামিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়ার – ‘বুঝতে পেরেছি বলতে হবেনা ।
কিন্তু আপনার ধরন ধারন দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে করুনা বলুন আর দয়াই বলুন, তাই ই করছেন । কেন ?’
মনের কথা পড়তে পেরেছে বলেই কৃষ্ণচূড়া অবাক একটু – ‘ কি করে বুঝলেন দয়া করছি ?’
‘আপনার চোখ বলছে । আপনার কথা অনেকটা জড়িয়ে যাচ্ছে, ঠোট কাঁপছে । রিক্সায় বসে আপনি সম্পূর্ণ জমে ছিলেন বরফের মতো । অভিজ্ঞতা না থাকলেও যে একদম কিছু বুঝিনা তা নয় ।
আপনি যে কাজ করেন তাতে আপনাকে তা মানায়নি । আমার খটকা তখন থেকেই । আমি গল্পকার । এধরনের অবস্থায় কি কি হতে পারে আমি তা সাজিয়ে সাজিয়ে লিখি , বুঝলেন কৃষ্ণচূড়া ?’ – নিজের দেয়া নামটি বলে ফেলেই লজ্জা পায় নয়ন ।
-আমাকে একটা নামও দিয়ে ফেলেছেন দেখছি আপনি ? কেন নীতা বলেই তো ডাকতে পারতেন ।
’
-‘নীতা আপনার নাম নয় । আপনার আসল নাম জানতে আমার কোনই ইচ্ছে নেই । আপনার সাথে আমার আসাই উচিৎ হয়নি । ঘৃনা করতে ইচ্ছে করছে ...’ থেমে যায় নয়ন ।
-‘বলুন আর কি কি করতে ইচ্ছে করছে ?’
-‘আর কিছু নয় ।
আপনাকে শুধু ঘৃনা করাই চলে । কিন্তু আপনাকে আমি তা ও করতে পারছিনে এখোন । আচ্ছা বলুনতো, আপনি আমাকে মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন কেন ?’
-‘যে কারনে আপনি আমাকে ঘৃনাও করতে পারছেন না । ’ পৃথিবীর সব রহস্য মাখিয়ে কৃষ্ণচূড়ার চোখ আলতো করে নয়নকে ছুঁয়ে মাটিতে নামে
– ‘আপনাকে যদ্দুর বুঝতে পেরেছি আপনি খুব ভালো মানুষ, সরল । কিন্তু বোকা নন ।
এখোনো আপনার মাঝে একটা ভালো মানুষ আছে বলেই ঐ বইখানার মতো বই লিখতে পেরেছেন । ’ কৃষ্ণচূড়া থামে , দম নেয় -
‘ আর .... আর.. খুব ভালো মানুষ না হলে এই অবস্থাতেও আপনি আমাকে কৃষ্ণচূড়া নামে ডাকতেন না । ’
বুদ্ধিমতী মেয়ে । শিক্ষিতও বোঝা যাচ্ছে । নয়ন অবাক ভেতরে ভেতরে ।
যেসব মেয়ে এই সব কাজে নামে, কৃষ্ণচূড়াকে তাদের সাথে মেলাতে কষ্ট হচ্ছে নয়নের । নিজের থেকে কিছু বলার আগেই কৃষ্ণচূড়া মুখ খোলে আবার –‘আপনাকে বাস ষ্টপেজে প্রথম দেখে অবাক হই । ছেলেরা মেয়েদের সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে । মেইলে আপনার সাথে কথা চালাচালিতে আমার তাই ই মনে হয়েছিলো । আপনার মেইলের লেখাগুলোর সাথে বাস্তবের আপনাতে অনেক মিল ।
সুন্দর, সহজ । আমি ভাবিনি আপনাকে দেখতেও তেমন হবে । আপনি যখন বাস থেকে নামলেন আপনার চোখেমুখে একটা আনন্দ খেলা করছিলো দেখলাম । শিশুর মতো লাগছিলো আপনাকে । তাই দ্বিধায় পড়েছিলাম, কি করবো আপনাকে নিয়ে ।
’ কথা থেমে যায় কৃষ্ণচূড়ার । একটু লালের ছোপ লাগে ওর গালে । চোখে হয়তো মদিরতাও ফোটে একটু । নয়নের চোখে পড়লো কি ?
‘তাই রিস্কটা নিয়েছি । আপনি যান নয়ন ।
যতো তাড়াতাড়ি পারেন আমার থেকে দুরে সরে যান । আমি আপনার ক্ষতির কারন হবোনা , অন্যেরা হতে পারে । হিসেবের বাইরে অনেক দীর্ঘ সময় নিয়েছি আমি আপনাকে এখানে আনতে ……’ কথা শেষ হয়না কৃষ্ণচূড়ার তবুও থামে সে ।
নয়ন চেয়ে আছে, চেয়ে আছে । দেখছে ।
একটি শুয়োপোকার শরীর থেকে আস্তে আস্তে উঁকি দিচ্ছে রঙীন এক প্রজাপতি ডানা । আতঙ্ক আর রাগ ছাড়িয়ে বিস্ময় ঝুলে থাকে নয়নের চোখে । তার সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে কি বাস্তব থেকে এসেছে না কি কল্পলোকের কেউ ! যে ই হোক , নয়নের ভেতরে একফালি মুগ্ধতা গুটিগুটি ডালপালা মেলে । অনুরাগের রেনু ছড়িয়ে যেতে থাকে চৈত্রের বাতাসে বাতাসে ।
ভিজে যেতে থাকে নয়ন কষ্টে ।
আর একটু পরেই হয়তো নয়ন চলে যাবে । মেয়েটির কাহিনী হয়তো আর কোনদিন জানা হবেনা । গল্পের মতোন করে আলবিদাও বলা হবেনা মেয়েটিকে । মেয়েটিও কি কিছু বলতে চাইবে ? এগিয়ে দিতে আসবে তাকে ?
নয়ন যখোন বাসের জানালা দিয়ে উদাস চেয়ে থাকবে বাইরে , তখোন হয়তো এই মেয়েটিই নতুন আর একটি জাল বোনা শুরু করবে । কিন্তু সে জালের আঘাতে নয়নের কোথাও যে একটু ক্ষত হয়েছে তা মুছবে কি ? নয়ন জানেনা ।
ফিরে এসো বললেই যে কেউ ফিরবে এমোন কোনও কথা নেই । এতোদিন নয়নের মনে হয়েছিলো মনের রঙে অন্ধকারে আলো জ্বালানো খুব সহজ । কিন্তু এখোন বোঝে তা যে কতো কঠিন । বাসটি তাকে নিয়ে যখোন ফিরে যাবে তার নিরাপদ আশ্রয়ে, তখোন কি নতুন আর একটি গল্পের মতোন নয়ন পিছু ফিরে বলতে পারবে – ফিরে এসো কৃষ্ণচূড়া ..... ? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।