♠ ব্লগার ইমন জুবায়ের ♠ মেঘের আড়ালে থাকা একটি নক্ষত্রের নাম
০১.
সাহেরা চলে গেছে দূর দিগন্তে। হয়তো তারা হয়ে আছে। হয়তো মিটিমিটি আলো দেয়।
হয়তো খানিকটা আফসোসও করে।
মিটিমিটি আলো নিয়ে জোনাক জ্বলা রাতে।
তারা হয়ে থাকে আকাশে। আকাশে তার বাড়ি এখন। সে সাহেরা।
যে দুটো জীবন এনে দিয়েছিলো ধরণীর বুকে তাই শ্রেষ্ট উপহার স্বরুপ তাকে অন্তিম বিদায় দিয়েছে ধরণী। তাকে বিদায় দিয়েছে গগনবিদারী চিৎকার সমেত।
সে অসহায় ছিলো; উত্তাল জোয়ারে যেমন অসহায় থাকে জেলেরা নিজেকে নিয়ে।
নারী হয়তো কখনো কখনো সব সইবার জন্যই তৈরি থাকে। থাকে অবলীলায় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে; আর তাই সাহেরার জীবনে ঘটে গেছে সেটা।
ছেড়ে গেছে তার প্রিয় আবাস ভূমি ও তার প্রিয় সন্তানদের। তার ছোট্ট মেয়েটা
ট্যা ট্যা করে কাঁদে এক ফোটা দুধের জন্য ; বুড়ো দাদী রওশন বিবি দুধ যোগান দিতে হিমশিম খায়।
কিন্তু সন্তানের জন্মদাতা সাহেরার স্বামীর ভ্র“ক্ষেপ নেই সেদিকে। মায়ের সাথে সাথে সন্তানটাকেও অপরাধীর চোখে দেখে।
স্বামীর চোখে অপরাধ হয়েছে মস্ত সাহেরার; কেন সে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে পারলোনা ?
সে নারী !! সে মায়ার শিকলে বন্দি একজন মা ।
সে মাতৃত্বের স্বপ্ন গায়ে জড়িয়ে পেটে ধরেছিলো সন্তানটাকে। কিন্তু ধরনীর বুকে যে মুখটির আবির্ভাব ঘটলো সেটা তো ট্যা ট্যা করে কাঁদছে; তার কান্না আজ ঘুড়েফিরে আসছে বাতাসে ভেসে ভেসে।
বলতে ইচ্ছে করে হতভাগী পোড়ামুখী কাদঁ আরো জোরে একফোটাঁ দুধও মিলবে না গগনফাঁটা চিৎকারে। গগনফাঁটা তবু আওয়াজ পৌছাবে না তোর জন্মদাতার কানে; সে বধির হয়েছে !!!!!
কিন্তু সেই জন্মদাতা বধির হলেও হাতটা তার বড় সোয়ানা। যে হাতে সে তোকে আদর করবে; সে হাত খুনির হাত রক্তে রঞ্জিত হবার; কিংবা সে হাত শ্বাসরুদ্ধ করবার। সে হাত আস্তাকুঁড়েও ফেলতে পারে !! পোড়ামুখী তুই যতো জোরে পারিস কাঁদ ?
তবুও যদি সাড়া মেলে ...............
০২.
সময়টা তখন আকালের। সেই আকালের দিনে এক দুপুরে সাজ সাজ রব।
লাল নীল কাগজে রাঙানো উঠোনে নতুন বউ হয়ে দাড়িয়ে আছে সাহেরা। চারপাশ থেকে সুন্দর আমেজে নিয়ে আসে তার স্বপ্নরা; একটা সুন্দর সংসার বাধঁবে বলে। সাহেরা ভালোবাসার আবেশে কাছে টেনে নেয় পতি দেবতাটিকে। ঘর সংসারের কাজের ফাকে দু’জনার খুনসুটি জমে উঠে সকাল দুপুর। কখনো কখনো মান অভিমানের পালা চলে।
এভাবেই কাটে দিন এক সময় নতুন অতিথির আগমনি বার্তা আসে। স্বভাবতই বাবা হবার আহ্লাদে খুশি হয় সাহেরার স্বামী। বাবা ডাক শোনার আকুলতাটা তাকে পেয়ে বসে। এক ভর বিকেলে এক হাড়ি মিষ্টি তুলে দেয় সাহেরার হাতে সবাই মিষ্টি মুখ করে।
কিন্তু সময়ের ধারা বয়ে যে নতুন অতিথি আসে; প্রথম সন্তানের আনন্দটা ঠিক ভাবে তাকে স্পর্শ করতে পারেনা।
কন্যা সন্তান হওয়ার তদ্রপ তার মনের আকাশে কেমন যেন ক্লেশ জমা হয়।
কপট হাসিতে বলে কি আর করা যাইবো ?
সেই সন্তান কে ঘিরে যখন সাহেরার উচ্ছলতা বাড়ছে ক্রমশই ।
কিন্তু নতুন মুখ পুরোনো হবার আগেই আর একটা নতুন মুখের তাগিদ দেয় সাহেরার স্বামী। একটা ছেলে সন্তান তার চাই-ই-চাই। আমি মইরা গেলে তোরে কে দেখবো একটা পোলা থাকলো তো সমস্যা হইবো না।
সাহেরা বলে মাইয়া আমার পড়ালেখা শিইখ্যা বড় হইয়া আমাগো দেখবো। কিন্তু স্বামী মানেনা। একটা ছেলে সন্তানের সুফল বর্ণনায় সাহেরাকে বোঝায়।
তাই সে আরেকটা নতুন মুখ ধারণ করে ফেললো পেটে। কিন্তু সাহেরা ঘুনাক্ষরেও টের পেলনা যে ভ্র“নটা জন্মেছে তা আবারও মেয়ে সন্তান।
যদি জানতে পারতো তাহলে হয়তো ঠেকে যেত একটা অকাল মৃত্যু।
সাহেরা জানতে পারেনি।
যখন আবারো ভূমিষ্ট হলো কন্যা সন্তান তখন স্বামীর ভালোবাসা আর থাকলো না বিষের গোলা হতে লাগলো আস্তে আস্তে।
শুরু হলো অকথ্য নির্যাতন।
এভাবেই চলতে চলতে একদিন শেষ হয় যন্ত্রণা
সেদিন সন্ধ্যেয়
আকাশটা থমকে দাড়াঁয় মুখ কালো করে।
সাগর কখনো কখনো একটু থামে একটু উত্তাল তরঙ্গ মেলে। কেমন যেন ধূসর লাগে সব । আকাশ কাঁদে বাতাস কাঁদে। কি,যে আহাজারি করেছিলো সাহেরা। পায়ে পড়েছিলো।
সাহেরা বাচঁতে চেয়েছিলো কন্যা সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
সাহেরা বলেছিলো তুমি দেইখো আমাগো মাইয়া বড় হইয়া লেখাপড়া শিইখা তোমার কষ্ট দূর করবো। হু করবো কচু করবো বলে রেগে উঠে সাহেরার স্বামী। তারপর পাশে থাকা শক্ত কাঠের টুকরোটা তুলে মাথায় বসায় রক্তের একটা ধারা বয়ে চলে....
০৩.
মায়ের কাছে সন্তান সবচেয়ে দামি। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে।
হোক সে বাকশূন্য কিংবা অন্ধ। সন্তানের মূল্য মায়ের চোখে কখনো কমতি হবার নয়। তার সেই কন্য সন্তান আজ কাদছে এক ফোটা দুধের জন্যে। কান্নাটা ফিরে ফিরে আসছে। যদি না মেলে বেঁচে থাকার উপকরন গুলো তাহলে সেও হয়তো একদিন তারা হয়ে জ্বলবে আকাশে সাহেরার মতই।
যদি এভাবেই চেতনা শূন্য হয়ে পড়ে থাকে গ্রাম্য সমাজ তাহলে হয়তো এভাবেই একদিন একটি একটি করে সাহেরা হারাবে অবমূল্যায়নের প্রান্তরে।
শুধু শান্তনা আর উপদেশ দিলেই থেমে যাবেনা এরকম হাজারো সাহেরার মৃত্যু। সেই সব পুরুষদের প্রতি রুখে ধারাতে হবে। যারা এখোনো ভ্রান্ত পথে চলছে আর নারী সত্তা কে গলাটিপে ছুড়ে ফেলেছে আস্তাকুড়ে। তাকে চেতনায় ফেরাতে হবে কেননা সেও একদিন এসেছিলো পৃথিবীতে কোন এক নারীর অবদানে।
রচনাকাল/২০১০
১৫ই মার্চ-রাত-১১টা-৪৫মিঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।