আমাদের এই পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগ জুড়েই আছে পানি। আবার এরই মাঝে আছে সাত সাতটি মহাদেশ। অনেকগুলো দেশকে নিয়ে গড়ে উঠে মহাদেশ। তবে এই সাতটি মহাদেশের কথা কিন্তু কেউই আগে থেকে জানতো না। এগুলো রীতিমত আবিষ্কার করতে হয়েছিলো।
আজকের পৃথিবীকে আমরা সভ্য পৃথিবী বলি। এই সভ্য পৃথিবীর শুরুটা হয়েছিলো ইউরোপ আর এশিয়া মহাদেশ থেকে। এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের সমৃদ্ধির জন্যে বিভিন্ন দেশ থেকে সম্পদ নিয়ে আসতো। কখনো এই সম্পদ আনতো ব্যবসার মাধ্যমে আবার কখনো আনতো দেশ দখল করে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালীয় নাবিক ও ঔপনিবেশিক।
বিশাল বিশাল সব মহাসাগর জাহাজে করে পাড়ি দিয়ে তবেই পার হতে হতো সেই পথ। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাওয়ার সাগর পথ কিন্তু মানুষ শুরু থেকেই চিনতো না। সেই পথ খুঁজে নিতে হয়েছে, পার হতে হয়েছে বিশাল সাগর। তাতে অনেক প্রাণ ঝরে গেছে, কিন্তু সাহসী মানুষ এক সময় সফল হয়েছে, নতুন নতুন দেশ খুঁজে বের করেছে। নতুন কোনো দেশ খুঁজে পেলে সেখান থেকে সম্পদ লুট করা হতো কিংবা সেই দেশের বাসিন্দাদের সঙ্গে ব্যবসা করা হতো।
আর যেই নাবিক তা খুঁজে বের করতেন এই সমুদ্র পথ; তার মিলতো উপহার, অঢেল ধন-সম্পদ আর রাজকীয় সম্মান। ১৫০৬ সালে, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার ধারণা ছিলো তিনি ভারতেই এসেছেন। অবশ্য পরে তার এই ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন আরেক ইতালীয় নাবিক, আমেরিগো ভেসপুচি।
এশিয়ার আরব, পারস্য, ভারত, চীন ছিলো সমৃদ্ধশালী দেশ। আর ইউরোপে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি, গ্রিস ছিলো উন্নত দেশ।
আফ্রিকার মিশরও কিন্তু এক সময় অনেক উন্নত ছিলো। ভারতে আসার জলপথ খুঁজতে যে কয়জন অভিযাত্রী সমুদ্রে বের হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছেন কলম্বাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- উনি কোনোদিনই ভারতে যেতে পারেননি। কিন্তু তবুও তার নাম ইতিহাসে লেখা আছে স্বর্ণাক্ষরে। ভারতের জলপথ আবিষ্কার করতে যেয়ে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন এক নতুন মহাদেশ।
কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন আমেরিকা। ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট কলম্বাস তার লালিত স্বপ্ন পূরণের জন্য যাত্রা শুরু করলেন অজানা সমুদ্র পথে। সঙ্গে নিলেন নিনা,পিন্টা ও সান্টামারিয়া নামের তিনটি পালতোলা জাহাজ। স্পেনের উপকূল ছাড়িয়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ পেছনে ফেলে তার জাহাজ এগিয়ে যেতে লাগলো বিশাল সাগরের ঢেউ ভেঙ্গে। মাসের পর মাস জাহাজ চলছে তো চলছেই।
চারদিকে পানি আর পানি। একসময় কলম্বাসের সহযাত্রীরা হতাশ হয়ে পড়লেন। বহু কষ্টে কলম্বাস তাদের বোঝালেন। তিন মাস পর হঠাৎ তারা দেখলেন,একটি গাছের তাজা ডাল ভেসে আসছে। আনন্দে নেচে উঠলো।
তাদের মন। ভাবলেন, হয়ত আশেপাশে কোথাও ডাঙা রয়েছে। কলম্বাস ভেবেছিলেন তিনি হয়ত সত্যি সত্যি পূর্বের দেশ ভারতবর্ষে এসে পৌঁছে গেছেন। স্থলভাগগুলো ছিল সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ। এই দ্বীপে তারা স্পেনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন।
বিজয় বার্তা নিয়ে ৭ মাস পর স্পেনে ফিরে এলেন কলম্বাস। রাণী তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিলেন সঙ্গে প্রচুর উপহার। এরপর আবার তিনি যাত্রা করলেন পরবর্তী আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। আবিষ্কার করলেন জ্যামাইকা,হাইতি ও কিউবা দ্বীপসমূহ। আমেরিকা হলো কলম্বাসের জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
এক তাঁতী পরিবারে তার জন্ম। টাকার অভাবে ছেলেবেলাতেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পড়ালেখা ছেড়ে বাবার সঙ্গে কাপড় বুনতে বাধ্য হন। কিন্তু ঘরে তাঁর মন বসে না। কলম্বাসের জন্ম ১৪৫১ সালে ইতালির ছোট শহর জেনোয়ায় ।
ছেলেবেলায় কলম্বাস প্রতিদিন সমুদ্রতীরে এসে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন জাহাজগুলোর দিকে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেয়ার পরপরই একদিন এমনই এক জাহাজে কাজ নিলেন। বেরিয়ে পড়লেন সমুদ্র যাত্রায়। সেই শুরু। বহুদেশ ঘুরলেন।
অবশেষে এসে পৌঁছলেন পর্তুগালে। সমুদ্র যাত্রা সম্পর্কে নানাধরনের বইপত্র পড়তে পড়তে তিনি একসময় সমুদ্রযাত্রায় পরিকল্পনা করলেন কিন্তু এজন্যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আর্থিক সাহায্যের জন্য সাক্ষাৎ করলেন পর্তুগালের তৎকালীন রাজার সঙ্গে। তিনি রাজাকে বোঝালেন, পৃথিবী যেহেতু গোলাকার সেজন্য পশ্চিম দিক থেকে যাত্রা শুরু করে নির্ঘাত পূর্বদিকে পৌঁছুতে পারবেন। শুধু তাই নয় ভারতবর্ষে গিয়েও পৌঁছুতে পারবেন।
কিন্তু কলম্বাসের পরিকল্পনা রাজার কাছে খুব উদ্ভট বলে মনে হলো। কলম্বাস তো আমেরিকাকেই ভারত ভেবেই একসময় মারা গেলেন। আর সেটা যে ভারত না, তাও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জানা হয়ে গেলো। কলম্বাসের এই সমুদ্রযাত্রার কয়েক বছর পরেই; ১৪৯৭ সালে, পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। উদ্দেশ্য, ভারতে যাওয়ার সমুদ্রপথটি আবিষ্কার করা।
তার এই যাত্রার সব সাহায্য করেছিলেন পর্তুগালের রাজা। ৪টা জাহাজের বহর নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ভাস্কো ডা গামা। এই জলপথ আবিষ্কারের মাধ্যমেই কিন্তু শুরু হয়েছিলো ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য। এই জলপথ ব্যবহার করেই ইউরোপীয় বণিকেরা আসা শুরু করে ভারতে। শুরু করে তাদের বসতি স্থাপন।
একে একে আসে স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বণিকেরা। এই জলপথ আবিষ্কার এর সঙ্গে সুচনা হয় এই অঞ্চলের নতুন ইতিহাসের।
কলম্বাস ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী। কিন্তু অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে ভাগ্য ছিল নিতান্তই প্রতিকূল। তাই অতিকষ্টে জীবন ধারণ করতেন কলম্বাস।
কলম্বাসের ভাই তখন লিসবন শহরে বাস করত। ভাইয়ের কাছ থেকে ডাক পেয়ে কলম্বাস লিসবন শহরে গিয়ে বাসা বাঁধলেন। কলম্বাসের বয়স তখন ২৮ বছর। কলম্বাস জাহাজ নিয়ে ভারতবর্ষের খোঁজে বের হয়ে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর একটা দ্বীপে গিয়ে পৌঁছান। অল্পদিনের মধ্যেই ছোটখাটো একটা কাজও জুটে গেল।
কাজের অবসরে মাঝে মাঝে গির্জায় যেতেন। একদিন সেখানে পরিচয় হলো ফেলিপা মোয়িস দ্য পেরেস্ত্রল্লো নামে এক তরুণীর সাথে। ফেলিপার বাবা বার্তলোমিউ ছিলেন সম্রাট হেনরির নৌবাহিনীর এক উচ্চপদস্থ অফিসার। কলম্বাসের জীবনে এই পরিচয় এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পরিচয় পর্ব অল্পদিনের অনুরাগে পরিণত হলো।
তারপর বিবাহ। বিবাহের পর কলম্বাস শ্বশুরের গৃহেই থাকতেন। শ্বশুরের কাছে শুনতেন তার প্রথম যৌবনের সমুদ্র অভিযানের সব রোমাঞ্চকর কাহিনী। অন্য সময় লাইব্রেরি ঘরে বসে পড়তেন দেশ-বিদেশের নানা ভ্রমণ কাহিনী। এই সময়ে একদিন তার হাতে এলো মার্কো পোলোর চীন ভ্রমণের ইতিবৃত্ত।
পড়তে পড়তে মনের মধ্যে প্রাচ্য দেশে যাওয়ার স্বপ্ন নতুন করে জেগে উঠল। কলম্বাস চিঠি লিখলেন সে যুগের বিখ্যাত ভূগোলবিদ Pagolo Toscanelli কে। Pagolo কলম্বাসের চিঠির জনাবে লিখলেন, তোমার মনের ইচ্ছার কথা জেনে আনন্দিত হলাম। আমার তৈরি সমুদ্রপথের একটা নকশা পাঠালাম। যদিও এই নকশা নির্ভুল নয়, তবুও এই নকশার সাহায্যে প্রাচ্যের পথে পৌঁছতে পারবে।
যেখানে ছড়িয়ে আছে অফুরন্ত হীরা, জহরত, সোনা-রূপা, মণি-মুক্তা, মাণিক্য।
সম্রাটের কাছ থেকে অর্থ পেয়ে তিনখানা জাহাজ নির্মাণ করলেন কলম্বাস। সবচেয়ে বড় ১০০ টনের সান্তামারিয়া, পিন্টা ৫০ টন, নিনা ৪০ টন। জাহাজ তৈরির সময় কোনো বিঘ্ন দেখা গেল না। সমস্যা সৃষ্টি হলো নাবিক সংগ্রহের সময়।
কলম্বাসের সাহায্যে এগিয়ে এলো পিনজন ভাইরা। তাদের সাথে আরো কিছু বিশিষ্ট লোকের চেষ্টায় সর্বমোট ৮৭ জন নাবিক পাওয়া গেল। কলম্বাসের বিরুদ্ধে নির্বুদ্ধিতার অভিযোগ আনা হলো- কারণ কলম্বাস কোনো সম্পদশালী দেশ আবিষ্কার করার পরিবর্তে সম্পদহীন দেশ আবিষ্কার করেছেন। যার জন্য সম্রাটের বিরাট পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে। এই অভিযোগে প্রথমে বন্দি করা হলো কলম্বাসের ভাই ও পুত্রকে।
তারপর কলম্বাসকে। কলম্বাসকে শৃঙ্খলিত করে নিয়ে আসা হলো স্পেনে। তাকে রাখা হলো নির্জন কারাগারে। সেখান থেকেই রানি ইসাবেলাকে চিঠি লিখলেন কলম্বাস। ১৫০২ সালের ১৯ মে কলম্বাস শুরু করলেন তার চতুর্থ সমুদ্রযাত্রা।
তার ইচ্ছা ছিল আরো পশ্চিমে যাবেন। পথে তুমুল ঝড় উঠল। নিরুপায় কলম্বাস আশ্রয় নিলেন এক অজানা দ্বীপে।
কলম্বাস পৌঁছেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দ্বীপে। সেখান থেকে ফিরে যান জ্যামাইকা দ্বীপে।
ক্রমশই তার দেহ ভেঙে পড়ছিল। অজানা রোগে তার সঙ্গীদের অনেকেই মারা গিয়েছিল। দু বছর পর নিরুৎসাহিত মনে স্পেনে ফিরে এলেন।
কলম্বাস অনেকের কাছে আজ আর আমেরিকার আবিষ্কারক নন বরং ঐতিহাসিক মিথ্যুক ও প্রতারক হিসেবে আজ মানুষ তাকে জানছে। কলম্বাস কলম্বিয়ান এক্সচেঞ্জ নামের এক ধরনের বিনিময়প্রথা চালু করেছিলেন স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে।
এই বিনিময়প্রথার মাধ্যমে সহজ-সরল আদিবাসীদের ঠকিয়ে তাদের সম্পদ, জমিজিরাত মায় তুচ্ছ জীবনটুকুও হস্তগত করতেন কলম্বাস। আজকের মার্কিন শাসকদের সাথে কী ভীষণ মিল কলম্বাসের!আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন কে? — এই প্রশ্নের জবাবে যারা এতদিন কলম্বাসের নাম বলেছেন, তাদের সচেতন হবার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে শিশুরা প্রশ্ন তুলেছে : যদি কলম্বাস আসার আগেই আমেরিকায় মানুষের বসবাস থেকে থাকে, তবে কী করে কলম্বাসকে আমেরিকা-আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া যায়? টেক্সাসের স্কুলগুলোতে পঞ্চম শ্রেণীর বইতে কলম্বাসের ‘কলম্বিয়ান একচেঞ্জ’ নামের একটি অধ্যায় আছে। এই বিনিময়প্রথার মাধ্যমে সহজ-সরল আদিবাসীদের ঠকিয়ে কলম্বাস জাহাজ ভর্তি করে সোনা আর শস্য নিয়ে গেছেন। বিনিময়ে দিয়েছেন নানা সংক্রামক ব্যাধি,যার ফলে নির্বিচারে মারা পড়েছে আদিবাসীরা।
টেক্সাসের স্কুলশিক্ষক লুরি ক্রফোর্ড বলেন, ‘শিশুদের ভাষায়, সে একটা অতি খারাপ লোক। ’ মায়ামি, ডালাস, লস এঞ্জেলেস এবং সিয়াটলের স্কুলগুলো সোমবার খোলা ছিল। এই রাজ্যের মানুষজন কলম্বাসের স্মরণে সরকারি ছুটি পালন করেনি। এই অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী আমেরিকানদের কাছে দিনটি একটি কালো দিন। ‘প্রত্যেক নায়কই অন্য কারও কাছে খলনায়ক।
আসলে বীরত্ব আর খল চরিত্র একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।