জানার কোন শেষ নাই। জানার চেষ্টা বৃথা তাই।
আমার মুভি দেখা বয়স বেশি না। অনেক ভালো ভালো মুভি আমার দেখা বাকি। মুভি দেখে কতটুকু বুঝতে পারি আমি ঠিক নিশ্চিত নই।
কিন্তু যেকোন ভালো মুভি দেখলেই সেটা নিয়ে চিন্তা করতে বা আলাপ আলোচনা করতে ভালো লাগে। আমি যত মুভি দেখেছি তার মধ্যে ক্রিস্টোফার নোলানের মুভি গুলো আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দেয়। তার মুভি গুলো শুধু মুভি বা বিনোদন নয়, হিউম্যান সাইকোলজি সম্পর্কে গভীর দর্শন।
নোলান ১৯৭০ সালে লন্ডনে জন্ম নেন। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা করেন।
সাত বছর বয়সেই তিনি চলচ্চিত্র নির্মানে জড়িয়ে পড়েন।
আমি কোন চলচ্চিত্র সমালোচক নই কিন্তু তার চলচ্চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করার লোভ সামলাতে পারছি না। নিচে ব্যাটম্যান সিরিজ সম্পর্কে আলোচনা করছি। আপনারাও অংশ নিন। পরবর্তিতে অন্যান্য মুভিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
ব্যাটম্যান বিগিন্স(২০০৫)ঃ
এই মুভির মাধ্যমেই নোলান বিখ্যাত কমিক বুক ব্যাটম্যান চরিত্রটিকে নতুন করে বড় পর্দায় আনেন(এর আগেও ব্যাটম্যানের আরো মুভি বের হয়েছিল)। কেন্দ্রিয় ব্যাটম্যান চরিত্রে অভিনয় করেন ক্রিশ্চিয়ান বেল(ব্রুস ওয়েন)। এখানে একজন শিল্পপতির ব্যাটম্যানে রুপান্তরের নেপথ্যের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। ব্রুস ওয়েনের ছোটবেলা, তার বাদুরভীতি, বাবা-মার মৃত্যুর পিছনে তার নিজের ভীতিকে দায়ী করা, হত্যাকারীকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়েও নিজের অপারগতা নোলান তুলে ধরেছেন অসাধারন দক্ষতায়। এর মাঝে তার সাথে দেখা হয় লিয়াম নিসনের(হেনরি ডুকার্ড)।
ওয়েন তার গুপ্ত সংঘের কাছ থেকে দীক্ষা নেয়া শুরু করে। নিজের ভীতিকেই শক্তিতে রুপান্তরিত করার অনুপ্রেরনা ওয়েন এখান থেকেই পায়, যা পরবর্তিতে প্রকাশ পায় তার ব্যাটম্যান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যমে। নিজের মনের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা গোপন ভীতির সাথে অনবরত যুদ্ধকে নোলান প্রকাশ করেছেন তার অসাধারন শৈল্পিকতায়। ব্যাটম্যানের উদ্দেশ্য শুধু রাতের আধারে দুষ্কৃতিকারীদের উপর ঝাপিয়ে পড়াই ছিল না, দূর্নীতি, সন্ত্রাসে জর্জরিত গোথাম শহরের মানুষদের আশা প্রদান করা, উৎসাহ প্রদান করাও ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। তার জন্য নিজেকে একটি প্রতীক হিসেবে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা সে উপলব্ধি করে।
আর সেই প্রতীক হিসেবে সে বেছে নেয় নিজের সবচেয়ে দুর্বলতাকে। আর এভাবেই সে পরিনত হয় ব্যাটম্যানে। দিনের আলোতে শিল্পপতি, প্লেবয় আর রাতের আধারে ব্যাটম্যান। এভাবেই চলতে থাকে তার জীবন। মুভিটি দেখার সময় মনে হবে অনেক কিছু খুব তারাতাড়ি হয়ে গেল।
অনেক বড়ো কাহিনি মাত্র সোয়া দুই ঘন্টায় প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক খুটিনাটিই বাদ চলে গেছে। যেমন গুপ্ত সংঘের ব্যাপারে বলতে গেলে কিছুই জানা যায়নি, শুধুমাত্র ওয়েনের প্রশিক্ষনের মাঝেই সংঘের ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকে।
মুভির অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইকেল কেইন(আলফ্রেড), কেট হোমস(র্যাচেল), গ্যারি ওল্ডম্যান(জিম গর্ডন), মর্গান ফ্রিম্যান(লুসিয়াস ফক্স) প্রমূখ।
দা ডার্ক নাইট(২০০৮)ঃ
ব্যাটম্যান সিরিজের সবচেয়ে সাড়া জাগানো মুভি এটি। বিশ্বজুড়ে অসাধারন ব্যাবসায়িক সাফল্য লাভ করে।
এবারও কেন্দ্রিয় ব্যাটম্যান চরিত্রে অভিনয় করেন ক্রিশ্চিয়ান বেল। তবে ব্যাটম্যানকে ছাপিয়ে এখানো মুল আলোচিত চরিত্র ভিলেন জোকার। জোকার চরিত্রে অভিনয় করেন হিথ লেজার। এটি তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ডার্ক নাইট মুক্তি পাবার দিন কয়েক আগে তিনি আত্মহত্যা করেন।
সারা মুভিতে অসাধারন সব ডায়ালগের ছড়াছড়ি। জোকারের "why so serious?"এবং এরন ইকার্টের (হার্ভি ডেন্ট)"you either die a hero or live long enough to see yourself become a villain" তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানব মনের জটিলতর দিকগুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্লেষন নোলান এই মুভিতেই করেছেন। সংক্ষেপে এখানে জোকারের দর্শন হল মনের গভীরে আসলে সবাই কুৎসিত। দুনিয়ার কেউ ভালো না আবার কেউ খারাপ না।
নিরীহ মানুষ বলে আসলে কিছু নেই। সময় ও সুযোগ পেলে সবাই হিংস্র। নিরীহ মানুষ হত্যা করে সে বলতে চায় পৃথিবীতে কেউ আদৌ নিরীহ নয়। জীবন একটা তামাশা, এবং সকল মানুষ একেকজন ভাড় ছাড়া কিছুই নয়। নৈতিকতা/ আদর্শ এসবই আমাদের তামাশার অংশ কারন আমরা কেউই নৈতিক নই, আদর্শবান নই।
নিজেদের প্রয়োজনেই আমরা প্রতিনিয়ত এসবের সংজ্ঞা বদলাই। মুল কাহিনি শুরু হয় যখন গোথাম শহরের মানুষজন তাদের নতুন নায়ক খুজে পায়। এই নায়কের নাম হার্ভি ডেন্ট। তিনি জনসাধারনের মাঝে তুমুল জনপ্রিয়তা পান কারন তিনি ব্যাটম্যানের মত আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়েই গোথাম শহরের অধিকাংশ অপরাধীদের জেলবন্দী করেন। এমন সময় জোকার চ্যালেঞ্জ জানায় ব্যাটম্যানকে।
সে হুমকি দেয় ব্যাটম্যানের আসল পরিচয় জনসম্মুখে প্রকাশ করা না পর্যন্ত প্রতিদিন একজন করে শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হবে। তার আসল উদ্দেশ্য ব্যাটম্যান ছিল না, তার মুল উদ্দেশ্য ছিল হার্ভি ডেন্ট। হার্ভি ডেন্টকে জন্সাধারনের কাছে ঈশ্বরতুল্য আসন থেকে নীচে নামিয়ে আনাই ছিল তার মুল উদ্দেশ্য। মুভির শেষপ্রান্তে এসে ব্যাটম্যান তা বুঝতে পারে, তাই জোকারের নৈতিক জয় এড়ানোর জন্যে সে হার্ভির কৃতকর্মের(জোকারের সাথে ব্যাট্ম্যানের মনস্তাত্বিক লড়াইয়ের মাঝে জোকারের পাতা ফাদে হার্ভি পুলিশ অফিসার গর্ডনকে এবং আরো অনেককে ভুল বুঝে এবং নিজের প্রেমিকা হত্যার প্রতিশোধ নিতে হত্যাযজ্ঞে নামে) সমস্ত দায়ভার নিজের হাতে তুলে নেয়। মানুষের মন থেকে যাতে হার্ভির কীর্তি না মুছে যায়, হার্ভির নিকৃষ্টরুপ যাতে জন্সাধারনের কাছে প্রকাশ না পায়, মানুষের আশা যাতে টিকে থাকে সে জন্যে ব্যাটম্যান নিজেকে মাটিতে নামিয়ে আনে।
এভাবেই শেষ হয়ে যায় ডার্ক নাইটের কাহিনি।
এই মুভির আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ফেরির কাহিনি। জোকার নদীর মাঝপথে দুইটি ফেরি অচল করে দেয়(ফেরিতে আগে থেকেই বোম পাতা থাকে এবং এক ফেরির বোমার ডেটেনেটর অন্য ফেরির মানুষের মাঝে দিয়ে দেয়া হয়) এবং বলে মধ্যরাতের আগে তাদের মধ্যে যেই ফেরির মানুষ অন্য ফেরির বোমা বিস্ফোরিত করবে সেই ফেরির মানুষ বাচতে পারবে। আর কোন ফেরির মানুষই যদি বোমা না ফাটায় তবে সে নিজে দুটো ফেরিকেই বিস্ফোরিত করবে। বলা বাহুল্য এর পিছনে ছিল জোকারের নিজের দর্শন প্রমান করা।
"পৃথিবীতে কেউই নিরীহ নয়। সময় ও সুযোগ পেলে সবাই কুৎসিত"।
মুভিতে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইকেল কেইন(আলফ্রেড), ম্যাগি গিলেনহাল(র্যাচেল), মর্গান ফ্রিম্যান(লুসিয়াস ফক্স) প্রমূখ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।