আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামাজিক উৎকর্ষতা সাধনে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব

সামাজিক উৎকর্ষতা সাধনে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব ফকির ইলিয়াস ====================================== ভেতরে গভীর গর্ত রেখে উপর থেকে কোন গুহার মুখই বন্ধ করা যায় না। এ সত্যটি আমাদের দেশের রাজনীতিকরা ভালো জানেন। ভর্তুকি দেয়া ভালো। কিন্তু সেই ভর্তুকি যদি রাষ্ট্রের গায়ে চিরস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে তবে তা পুষিয়ে নেয়া যাবে কীভাবে? আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিন্তু সাধারণ মানুষের গভীর নিঃশ্বাসের ধ্বনি অনুধাবন করতে পারি।

বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটটি ঘোষিত হওয়ার পর পরই একটি মুনাফাখোর শ্রেণী সাধারণ মানুষের পকেট হাতড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কাঁচামালের বাজারে আগুন। শাক-সবজি, আলু, মুলার দামও হেঁকে ওঠার খবর দেখলাম আমরা বিভিন্ন কাগজে। এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক বলেছেন বেশ চমৎকার কথা। বলেছেন, ফলমূল ব্যবসায়ীদের প্রতারণা থেকে দূরে থাকুন।

অর্থাৎ মন্ত্রী বলেছেন, ফলমূল কৃত্রিম কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হচ্ছে। যা প্রকারান্তরে বিষক্রিয়ার শামিল। বাঙালি জাতির বেশকিছু গর্বের বিষয় ছিল। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এই অহঙ্কারে গর্বিত হয়েছেন আমাদের পূর্ব প্রজন্ম। গ্রীষ্মকালে গাছের আম আর গোয়ালের গাভীর দুধ পান করে নৈশভোজ সারতেন আমার পিতামহ।

গল্পটি আমি পিতামহীর কাছে শুনেছি। এসব উপাখ্যান আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই জানা আছে। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল সেসব দিন। কেন হারিয়ে গেল? গাছ কেটে বন উজাড় করা হয়েছে। নদীগুলো ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা।

হারিয়ে গেছে পুকুরের মাছ। গোয়ালের গরু। দুধের সঙ্গে পানি মেশানোর সুদকষা অঙ্কপাঠ করে এ প্রজন্ম যেন ক্রমে হয়ে উঠেছে চতুর গোয়ালার চেয়েও ভয়ঙ্কর সামাজিক জীব। বিজ্ঞান প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রজন্ম অগ্রসর হবে, তা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু অরাজনৈতিক এবং ভ্রান্ত রাজনীতিকদের পাল্লায় পড়ে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সমাজের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেবে তা তো হতে পারে না।

তা সমাজের জন্য শুভও নয়। আমাদের চারদিকে এই যে অশুভের প্রভাব, সেটাই সমাজের জন্য তীব্র শঙ্কার কারণ হচ্ছে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ নিরুপায় হয়ে নিজেরাই নিজেদের দিচ্ছে পাহারা। আমরা যদি বাংলাদেশে মিডিয়ার উৎকর্ষতার কথা বলি, তাহলে দেখব, যেখানে একসময় একটি মাত্র টিভি চ্যানেল ‘বিটিভি’ ছিল, সেখানে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সংখ্যা এখন প্রায় একডজন কিংবা তারও বেশি। বেড়েছে ভারী পৃষ্ঠাসংখ্যা নিয়ে জাতীয় দৈনিকের আয়োজন।

তারপরে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, অনলাইন দৈনিক, অনলাইন মুক্ত ফোরাম ইত্যাদি আপডেট হচ্ছে তাৎক্ষণিক। প্রতি ঘণ্টার নিউজ, ব্রেকিং নিউজ দেশবাসী, বিশ্ববাসী বাঙালিকে জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক সংবাদ। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিষয়ভিত্তিক অনুসন্ধানী ধারাবাহিক যে রিপোর্টগুলো প্রচারিত হয়, তা রাষ্ট্রপক্ষের শাসকদের কতটা নজরে পড়ে? আর নজরে পড়লে এর বিহিত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় কী-না! কেন নেয়া হয় না? দুঃখজনক হলেও সত্য মিডিয়ায় দলবাজি, মিডিওকারদের পতন, কোন কোন সাংবাদিকের সামাজিক স্খলনের খবরও আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখি। কেউ কেউ অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে হীনকর্মেও লিপ্ত হন, সেসব খবরও দেখা যায়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে এই সেই দেশ, যে দেশ মাওলানা আকরাম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সন্তোষগুপ্ত, বজলুর রহমান কিংবা মোনাজাতউদ্দিনের মতো কৃতী ও বরেণ্য সাংবাদিক জন্ম দিয়েছে। যারা গণস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে শির চির উন্নত রেখেছেন। সমাজের পজিটিভ বিবর্তনে মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর যারা দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, যারা মিডিয়া এখনো রাষ্ট্রভাবনা নিয়ে তাদের সুচিন্তিত মতামত লিখেন, যারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কথা বলেন, তারা এখনো যে হারিয়ে যাননি সেই প্রমাণ সাম্প্রতিককালেও রেখেছেন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে দেখেছি, তাকে নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে সৃষ্ট বাকবিত-া মাননীয় স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ এক্সপাঞ্জ করে দিয়েছেন।

এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্পিকার। বিষয়টি প্রমাণ করেছে, আমাদের আশার আলো এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এখনো সত্যকে ধারণ করার মতো সাহসী মানুষ এ বাংলাদেশে আছেন। অশুভ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার স্থায়িত্ব সাময়িক। তা না হলে একটি রাষ্ট,্র একটি সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না।

বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে সমাজের সৃজনশীল উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়েছে রাজনীতিকদের অনৈক্য। মৌলিক বিষয়গুলোতে অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে অপশক্তিরা বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মানুষকে বন্দী করেছে আঁধারের নাগপাশে। যে বিষয়টি না বললেই নয় তা হচ্ছে, মানুষের বিবেক যখন লুপ্ত হয় তখন কোন নীতিই আর তাকে স্পষ্ট করতে পারে না।

বাংলাদেশে অনেক ‘বিশিষ্ট বলে পরিচিতদের’ বিবেকও আজ রুদ্ধ। এরা প্রকারান্তরে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস যেমন অস্বীকার করছেন তেমনি নিজ দলীয় মতবাদ প্রচারের নামে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। কোন দল কিংবা সরকারের কাজের সমালোচনা করা কিংবা ভিন্নমত পোষণ করা এক কথা। আর ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে অস্বীকার করা ভিন্নকথা। মনে রাখা দরকার, মৌলিক ইতিহাস বিকৃত করে কিংবা স্বার্থ হাসিলের জন্য কাজ করে রাষ্ট্র অথবা প্রজন্মের কল্যাণে কোন মঙ্গলময় কাজই করা যায় না।

এ দেশে দখলবাজি কারা করছে? গাছ কেটে বন উজাড় কারা করছে? নদী ভরাট করে পরিবেশ দূষিত কারা করছে? নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলে পানি দূষণের মারাত্মক সংবাদ আমরা কাগজে দেখছি। এসব কাজ যারা করছে, তাদের হাত অনেক লম্বা। তারা রাষ্ট্রের উচ্চ শ্রেণীর একটি শক্তির মদতপুষ্ট, তা না হলে এত সাহস এরা পায় কোথা থেকে? দখলের প্রয়োজনে ঢাকায় এবং সিলেটে দুটি মর্মান্তিক খুনের ঘটনা আমরা অতিসম্প্রতি খবরে দেখেছি। দুজন মহিলাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে জমি-জিরেতের দখলদারি নিয়ে। বাংলাদেশে ভাগ-বাটোয়ারা আইনের পরিশুদ্ধ সংস্কার দরকার।

জমির দাম যেভাবে বাড়ছে, তা অন্যের জমি দখলের লোভ, হীন মতলবকে শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ লোপ পেলে যা হয়। সমাজ দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই এগিয়ে যায়। পারস্পরিক সংঘর্ষ আলো এবং অন্ধকারের মাঝে থাকবেই। কিন্তু আলো ও আঁধার পরখ করার মতো মানুষ এ সমাজে গড়ে তুলতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রজন্মকে পাঠাভ্যাসে প্রত্যয় করে তোলার জন্য নানা ধরনের স্কিম চালু আছে। নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরি থেকে কোন বই ধার নিয়ে তা সময়মতো না দিলে দিনে পঁঁচিশ সেন্ট করে জরিমানা দিতে হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন স্কিম চালু আছে। প্রতিদিন লাইব্রেরিতে বসে বই পড়। ক্রমে তোমার জরিমানা মাফ হয়ে যাবে।

মানুষ কেন পড়ে? পাঠাভ্যাস কেন জরুরি? গেল ৯ জুন ২০১২ শনিবার ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’র আয়োজন করেছিলেন বিশিষ্ট কবি শহীদ কাদরী। তার সঙ্গে সেখানে কথা বলার, আড্ডা দেয়ার সুযোগ ছিল আমার। কবি বললেন, একজন কবির উচিত সম্ভব হলে ইংরেজি, জার্মান এবং ফ্রান্স এ তিনটি ভাষা রপ্ত করা। কারণ বর্তমান সময়ে একজন কবির বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান খুবই জরুরি। আমিও মনে করি, প্রজন্মকে পাঠাভ্যাসে উৎসাহিত করতে হবে।

জ্ঞানার্জন ছাড়া কোন জাতিই এগোতে পারে না। কথা নয়, কাজই প্রমাণ করুক এদেশের মানুষ সত্যের পথে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। নিউইয়র্ক, ১৩ জুন ২০১২ ------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ১৫ জুন ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.