আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার স্মৃতিতে বাবা খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন--- লুনা খোন্দকার

আমার বাবা প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সম্পর্কে আমার এতো স্মৃতি কথা, রয়েছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না, তবুও কিছু স্মৃতি না লেখলেই নয়, .............. তিনি আমার বাবাই ছিলেন না, আমার বন্ধুও ছিলেন। সব ব্যাপারে তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করতাম, তিনিও করতেন। আমার বাবাকে বিএনপি-র মহাসচিব পোস্টটা দেবার আগে আমি বাবাকে বলেছিলাম তুমি এই পোস্টটা নিও না। বাবা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললেনÑ কেন এই কথা বলছো, মা? আমি বললাম ওরা আমার দুই ভাইকে আটকিয়ে ফেলবে। বাবা বললেন— মা, ঘাবড়িও না, দলের এই দুর্দিনে আমাকে হাল ধরতে হবে, তা-না হলে দেশ এবং দলের অনেক ক্ষতি হবে।

তুমি আল্ল¬াহর উপর ভরসা রাখো। আল্ল¬াহ আমার সন্তানদের দেখবেন। এই কথা শুনে আমিও সাহস পেলাম ও আব্বার জন্য নতুন পাঞ্জাবী কিনতে গেলাম। কারণ আমি চেয়েছি আব্বা মহাসচিব হওয়ার প্রথম দিন নতুন পাঞ্জাবী পরবেন এবং আমার দেয়া সেই পাঞ্জাবী পরে আব্বা জিয়ার মাজারে গেলেন। আমিও সাথে ছিলাম।

তারপর শুরু হলো সংগ্রাম। একের পর এক প্রেস ব্রিফিং। আব্বা শারীরিক দিক দিয়ে অসুস্থ হলে কি হবে, মনের দিক দিয়ে খুব শক্ত ছিলেন। একবার ২০০৬ সালের কথা, আব্বা প্রায়ই বলতেন বুকে ব্যথা, কিন্তু এতো সিরিয়াসলি নিতেন না। কারণ খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন তিনি।

উনার জন্য কেউ কষ্ট করবে এটা চাইতেন না। কিন্তু আমি জোর করেই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা বোর্ড করে সিদ্ধান্ত জানালেন তাড়াতাড়ি দেশের বাইরে নিয়ে যেতে। আমি ২০০৬ এর ২৯ জুলাই আব্বাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল হাসপাতালে গেলাম। ওখানে ডা. ওংপুসিং আব্বাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাকে ও আব্বাকে জানালেন আব্বার বাম দিকে ফুসফুসে ক্যান্সার lungLহয়েছে।

অপারেশন করলে ঠিক হয়ে যাবে অর্থাৎ একটি ফুসফুস কেটে ফেলে দিতে হবে। ডা. বললেন ঘাবড়াবার কিছু নেই অনেকেই ১টা ফুসফুস নিয়ে বেঁচে আছে। .............শুধু অর্ধেক কেটে ফেললেই ঠিক হয়ে যাবে। আব্বার প্রথমে মন খুব খারাপ হলো, কিন্তু পরে নিজেকে শান্ত করে সামলে নিয়েছি। আমি বললাম, আব্বা এসেছি যখন চিকিৎসাটা নিয়ে দেশে ফিরি।

আব্বা টাকা-পয়সার ব্যাপারে চিন্তা করবে না। নিশ্চয়ই সরকার সাহায্য করবে। পরে আমরা চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরি। ২০০৮ সালে জানুয়ারিতে আমার বিয়ে হয়। স্বামীর কর্মস্থল অষ্ট্রেলিয়ায়।

সুতরাং আমাকেও অষ্ট্রেলিয়ায় আসতে হলো। আমি চলে আসার পর আব্বা প্রায়ই বলতেন, মা তুই আমার লাঠি ছিলি, এখন আমার লাঠিটি নেই। আমি তো যতদিন ছিলাম আব্বাকে ছায়ার মতো আগলে রাখতাম। এই যে আমি আজ ডাক্তার হয়েছি, সেটাও উপরে আল্ল¬াহ এবং আব্বার ইচ্ছার কারণে। আমি যখন কলেজে পড়ি, আমার মা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু আব্বা বলেছেন না, এখন বিয়ে কিসের? আমার মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করে তারপর বিয়ে দেব। আমার বাবা খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। আব্বা বলতেন মানুষের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়াবে, সুখের দিনে নয়। আমার বাবা কতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন, চিন্তাই করা যায় না। আমাদের পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় বাসা।

আমি একবার বললাম আব্বা তুমি নতুন ঢাকায় একটা বাড়ি নাও। কারণ তোমার এখান থেকে সংসদে যেতে এবং কাজকর্ম করতে কষ্ট হয় (যানজট প্রচুর আরমানিটোলায়)। আব্বা বললেন নিজের নামে একটা বাড়ি থাকলে আর করা যায় না। আমি বললাম সন্তানদের নামে নাও। সবাই তো সন্তানদের নামে নেয়।

আব্বা বললেন, সন্তানরা যার যার মতো করে নেবে। এই হলো আমার বাবা, নীতির প্রশ্নে কখনো আপস করবেন না, সে যেই হোক না কেনো। আগে আমার সাথে আব্বার প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো। হঠাৎ আমার বড় ছেলে উজায়ের গরম স্যুপে বুক পুড়ে যাওয়ায় ওই সময়টা ঠিকমতো কথা হয়নি। উজায়ের পোড়ার কথা শুনে আব্বা যে কতো কষ্ট পেয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

মনে হয় আব্বাই পুড়ে গেছেন। ২২ ফেব্রয়ারি ২০১১তে আব্বুকে ফোন করলাম, আব্বা আমার কাছে কাছেই ছিলেন। আমি বললামÑ আব্বা কি হয়েছে, আব্বা বললো আমি মনে হয় বাঁচবো না আমি দশদিন ধরে কফ এবং বেশ অসুস্থ। কিন্তু উনি কাউকে বুঝতে দিতেন না। আমি বললাম আব্বা চিকিৎসা নাও।

তাড়াতাড়ি শক্ত থাকতে সিংগাপুরে যাও কারণ অন্য কোন সমস্যা হয়েছে কিনা দেখতে হবে। এখানে তোমার ডায়াগনোসিস করতে পারবে না। আব্বা বললেন দেখি, আব্বা দিব্বি এই শরীর নিয়ে দলীয় সব প্রোগ্রাম করেছেন। আব্বার সবকিছু মনে থাকতো। উজায়ের ২য় জন্মদিন ছিলো ১লা মার্চ ২০১১।

আব্বার শরীর তখন খুব খারাপ। আব্বা ঠিকই ১লা মার্চ ফোন করলেন উজায়েরকে শুভেচ্ছা জানাতে। উজায়ের ঘুমিয়ে ছিলো, কারণ পোড়ার জন্য ডা. মরফিন দিয়েছিল। পরেরদিন অর্থাৎ ২ মার্চ ফোন করলেন এবং উজায়ের ও আমার সাথে শেষ কথা হলো। আমাকে বললেনÑ মা আমার খুব খারাপ লাগছে, আমি তোমার সাথে পরে কথা বলবো।

আমার ভাইকে দেখে রেখো। এটাই ছিলো আমার সাথে আব্বার শেষ কথা। কে জানতো এটাই আমার সাথে বাবার শেষ কথা হবে। রাজনীতি প্রসংগে কিছু কথা না বললেই নয়, আমার বাবাই প্রথম দু’নেত্রীকে মাইনাস করা যাবে না বলেছেন। কারণ সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলেছিল দু’নেত্রীকে মাইনাস করতে।

আমার বাবা ৫২-এর ভাষা আন্দোলন করেছেন, ২১শে পদক পেয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন একটা মানুষের এতো গুণ চিন্তাই করা যায় না। আর ছিলেন অনেক ধৈর্য্যশীল। একবার আব্বার সাথে অসুস্থ মাজেদুল হক চাচা (বিএনপি-র সাবেক কৃষি মন্ত্রী) কে ল্যাব এইড হাসপাতালে দেখতে গেলাম। উনি আব্বাকে বলেই ফেললেন দেলোয়ার আমি যদি ২য় বার জন্ম নিতাম আল্ল-াহকে বলতাম ২য় দেলোয়ার হোসেন হয়ে আমাকে বানাও। কারণ তোমার মতো ধৈর্য্যশীল মানুষ আমি দেখিনি।

আমি কলেজ থেকে প্রায়ই আব্বার অফিসে যেতাম। কারণ দুপুরে আব্বা সময় মতো খেতেন না, আমি যেয়ে আব্বাকে খাওয়াতাম। কারণ লোকজনকে বসিয়ে আব্বা খেতে চাইতেন না, বলতেন ওদের কাজগুলো শেষ করে তারপর খাই মা। ততক্ষণে ৪/৫ টা বেজে যেতো। আব্বার ডায়াবেটিস ছিলো সময়মতো না খেলে সমস্যা হতো।

আমার বাবা মানুষ হিসেবে খুব ভালো ছিলেন। তিনি বাবা হিসেবে, স্বামী হিসেবে, নেতা হিসেবে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন, সবদিকে উনার দৃষ্টি ছিলো। আমার মাকেও বাবা আগলিয়ে রাখতেন। ২০০৪ সালের কথা আব্বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। আব্বার ১০৪◦ জ্বর কিন্তু ডাক্তাররা ধরতেই পারলেন না কি হয়েছে! আব্বাকে আমরা দেশের বাইরে নিয়ে যাব।

টিকিট করা হয়ে গেছে কিন্তু আব্বা কিছুতেই মাকে ছাড়া যাবেন না। কি আর করা যাবে নিয়ে গেলাম। ছোটবেলার কথা, আব্বা বলতেন কোর্টে যেদিন আব্বা আমাকে সালাম দিয়ে যেতেন, সেদিন নাকি অনেক টাকা পেতেন (অনেক ...)। মনে পড়ে ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আব্বার সাথে গোল্লাছুট সহ বিভিন্ন খেলাধুলা করতাম। আমি অনেক সময় চালের বস্তা কিংবা খড়ের গাদার উপর উঠে আব্বাকে বলতাম আমাকে ধরতে পারবা নারে।

আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো মা এই যে ধরেছি। এই রকম কতো স্মৃতি। আব্বা প্রতি শুক্রবার মানিকগঞ্জ-এ আমাদের গ্রামের বাড়ি পাঁচুরিয়া যেতেন। আমাকে না নিয়ে যেতেই চাইতেন না। আমিও যেতাম আব্বাকে সঙ্গ দিতে।

মানুষ যে বয়সে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘোরে আমি ঘুরেছি আমার বাবার সাথে। কলেজে পড়া অবস্থায় কেউ কিছু বললে সাথে সাথে বাবাকে বলতাম, কোথাও যাওয়ার কথা বললে বলতাম, বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। উল্লেখ্য বড় চাচার নামে ল’ কলেজটি আব্বা করেছেন। আমার আব্বা সব সময় বলতেন বড় চাচার জন্য উনারা এতো বড় হয়েছেন। আব্বা নিজের জন্য কিছুই করতে চাইতেন না।

আমি একবার বললাম আব্বা তোমার নামে একটা কলেজ করতে চাই। আব্বা রাগ করে বললেন কলেজ করবে জায়গা কোথায়! আমি বললাম আমাদের যে মানিকগঞ্জে ল’ কলেজ আছে (বড় চাচার নামে) সেই কলেজ আমরা ভাড়া নেই। তারপর আমার উদ্যোগে সকলের ইচ্ছায় কলেজ হলো আব্বার নামে। আব্বা দেশের জন্য, মানুষের জন্য অনেক করেছেন, আমার ইচ্ছে ছিলো আব্বা বেঁচে থাকতেই আব্বার নামে মানিকগঞ্জের সড়কটি করতে (বাসষ্ট্যান্ড থেকে আমাদের সেওতা বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত) যেখান থেকে আব্বা রাজনীতি করেছেন। আব্বার জীবনী বের করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আব্বা সময় দেয়নি।

এই দু’টা কাজ বাকি। আব্বা আমার হাতের রান্না করা কোরমা খুব পছন্দ করতেন। আমি ঈদের সব রান্না করলাম আব্বার জন্য। আমার সাথে আব্বার ২০১০ সালে শেষ দেখা এবং ঈদের দুদিন আগে অষ্ট্রেলিয়ায় আমার সাথে কথায় আব্বা বললেন, মা ঈদটা করে যাও, আমার সাথে আর ঈদ নাও করতে পারো। আমার বাবা অসুস্থের সময় নাকি বলেছেন, আল্ল¬াহ তুমি আমাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ কর, আমি আমার উজায়ের ভাইয়ের কাছে যাবো।

কিন্তু আব্বার সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না। আমার ইচ্ছে ছিলো আমার সংসারে আব্বা আসলে অনেক যত্ন করে খাওয়াবো। কারণ আমার সংসার তো আব্বা দেখেনি। আমি এখন কতো কিছু রান্না করতে শিখেছি। কিন্তু আব্বাকে খাওয়াতে পারলাম না।

আব্বাকে নতুন কিছু রান্না করে দিলে খুব মজা পাবেন খেতে। আমার সারা জীবন এই আফসোস থাকবে। আমার ছোট ছেলে আদিয়ানকেও দেখতে পেলো না। শুধু আমার ছোট বোনের কাছে ছবি দেখেছিল। আব্বা যেদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, আমার কান্না দেখে উজায়ের বললো আম্মু কান্না করো কেন? আমি বললামÑ নানা ভাই ব্যথা পেয়েছেন, তাই আল্লাহ নিয়ে গেছে।

ও আমাকে বললো আম্মু নানা ভাইতো প্লে¬নে আছে কান্না করো না। এখনো কান্না করলে বলে প্লেনে .... আম্মু। (কারণ আমি বলেছিলাম নানা ভাই প্লে¬নে করে এখানে আসবে। ) তাই ওর ধারণা নানা ভাই এখনো প্লেনে আছে। আব্বার মৃত্যুর পর দেশে গেলাম উজায়ের আব্বার রুম নক করে বলে নানা ভাই দরজা খোলো, দরজা খোলো, ওতো আর জানে না যে নানা ভাই যেখানে গেছেন, ওখানের দরজা আর কোনদিন খুলবে না।

আব্বার মৃত্যুতে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আমাদের আর কোন গার্জিয়ান নাই। আব্বা ছিলেন আমাদের বটগাছ। আব্বার জায়গা পূরণ হবার নয়। আমরা এবং দেশ একজন ভালো মানুষ হারালো।

আব্বা আমার গান খুব পছন্দ করতেন। সুতরাং তুমি মা সঙ্গীত চর্চা ছেড়ো না। বাবা গাড়িতে উঠলে আমার গানের সিডি ছাড়া অন্য কারো গানের সিডি ছাড়তে দিতেন না। একবার আমার বাবা সম্মেলন এর জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। সম্মেলন শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমার জন্য স্কেল হারমোনিয়াম ও তানপুড়া কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং অনেক বেছে ভাল একটি বড় তানপুড়া কিনেছেন।

ভেংগে যাবে ভেবে বাবা বড় তানপুরাটা নিজ হাতে ক্যারি করেছেন। বাবাকে নিয়ে আমি একটি গান করেছি গানের ভিডিওতে বাবা ছিলেন আমার সাথে। গানের কথা (হাজার দুঃখ শোকে হৃদয় ব্যথায় যখন কাতর, হাত বুলিয়ে বাবা আমার মাথায় করে আদর ... তোমায় আমি একা করে)। সেই বাবা আমাকে ছেড়ে কতো দূরে। এ রকম আরো কতো স্মৃতি, এতো স্মৃতি যে লিখে শেষ করা যাবে না।

ডা. লুনা খোন্দকার : খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বড় মেয়ে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।