চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার, চার দশক জুড়ে বাংলা মননচর্চার অন্যতম স্তম্ভ লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক শ্রী সন্দীপ দত্তের সঙ্গে সরকারী ও সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত লাইব্রেরীতে নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্র রাখার ফতোয়া নিয়ে আজকের দেশব্রতী পত্রিকার পক্ষে কথা বলেন সৌভিক ঘোষাল। খুব স্পষ্টভাবেই সন্দীপবাবু জানান এই ফতোয়ায় শোনা যাচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের কন্ঠস্বর। পাঠকের কাছে সেই আলাপচারিতা আমরা এখানে তুলে দিলাম।
দেশব্রতী – কীভাবে দেখছেন গ্রন্থাগারে সংবাদপত্র রাখার বিষয়ে সরকারী এই ফতোয়াটিকে ?
সন্দীপ দত্ত – এরকম কথা বলা যায়, সরকার এরকম কোন নির্দেশ দিতে পারে, এটা দেখে আমি স্তম্ভিত। লাইব্রেরীতে এই কাগজ থাকবে, ওই কাগজ থাকবে না – এটা কখোনই বলা যায় না, বলা উচিৎ নয়।
সংবাদপত্রে সময়ের সমীক্ষা থাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্র বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা করে। পাঠকের সমস্ত রকম দৃষ্টিকোণ জানারই অধিকার আছে। সাধারণ লাইব্রেরীগুলোতে মানুষ বইয়ের পাশাপাশি সংবাদপত্রও পড়তে যান। অনেক জায়গাতেই সংবাদপত্রের আলাদা স্ট্যান্ড রাখা থাকে।
সেখানে বিভিন্ন ধরণের সংবাদপত্র রাখা থাকে। এখানে নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্র চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই আসতে পারে না। মত জানার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে যদি খর্ব করা হয় সেটা একটা আধিপত্যবাদের প্রকাশ। এটা সবসময়েই প্রতিবাদযোগ্য। কিছু পত্রিকা রাখার কথা বলা হয়েছে।
তার বাইরে অন্য পত্রিকা রাখা হলে কী করবে সরকার কে জানে। গ্র্যান্ট বন্ধ হবে কিনা জানি না। পাঠক স্বাধীন, সংবাদপত্র স্বাধীন – এই অবস্থাটা বজায় রাখা জরুরী।
দেশব্রতী – এরকম ফতোয়ার আর কোন নজির কি সম্প্রতিকালে এখানে আছে ?
সন্দীপ দত্ত – বামফ্রন্ট আমলের শেষদিকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্বের সময় আমরা দেখেছি এমনকী মাওয়ের বই বাড়িতে রাখার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুটি লিটল ম্যাগাজিন, ব্যাস ও স্ফুলিঙ্গ, এদের সম্পাদকদের সিঙ্গুর নিয়ে রবীন্দ্রসদন চত্বরে পোষ্টার মারার জন্য আটক করা হয়েছে।
এর প্রতিবাদে সেইসময় আমি সরকার আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা বয়কট করি। তারপর আরো অনেক পত্রিকা সরকারী লিটল ম্যাগাজিন মেলা বয়কট করেন। স্বাধীন উদ্যোগে আলাদা মেলা হয়।
দেশব্রতী – বামফ্রন্ট আমলের শেষদিকে বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্রের জন্য পথে নেমেছিলেন। এখন তাঁদের কোন অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন ?
সন্দীপ দত্ত - বামফ্রন্ট এর শেষদিকে বিশেষত নন্দীগ্রামে অনেক মানুষের হত্যার পর বুদ্ধিজীবীরা পথে নামলেন।
গণতন্ত্রের জন্য আওয়াজ তুললেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রলোভনে তারাও অনেকেই সবুজ শিবিরে চলে গেলেন। শঙ্খ ঘোষ, নবারুণ ভট্টাচার্য, কৌশিক সেন এর মতো কয়েকজন ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন এর মধ্যে। তাঁরা বর্তমান সময়ের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু অনেকেই নিশ্চুপ।
আবার যে সাংবাদিককে এম পি করা হল তিনি চ্যানেল টেন এ ফতোয়ার স্বপক্ষে কন্ঠস্বর তৈরির চেষ্টা করছেন। এখন যে ঘটনা চলছে, পাটুলি ও নোনাডাঙায় উচ্ছেদ, সেখানেও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই চুপ করে আছেন। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশের চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।
দেশব্রতী –উচ্ছেদের কথা যখন উঠলই, তখন এই দিকটা নিয়ে কিছু বলুন
সন্দীপ দত্ত –পরপর ঘটনা ঘটছে। ফতোয়ার পরেই এল উচ্ছেদ অভিযান।
আগে বিরোধী থাকার সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উচ্ছেদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলেন। দ্রুত সেগুলো বদলে গেল। উচ্ছেদের প্রতিবাদে মিছিল মিটিং পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারী চলছে। সরকার যেন মনে করছে জনগণ বোকা।
বামফ্রন্টের আমলে দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরতন্ত্রের একটা ধরণ তৈরি হয়েছিল, নতুন সরকার দ্রুতই স্বৈরতন্ত্রের আর একটা চেহারা হাজির করছে। ১৪ নভেম্বরের মহামিছিলে আমরা সবাই হেঁটেছিলাম স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সংবাদপত্র নিয়ে এই ফতোয়া আর তারপর মুখ্যমন্ত্রীর কথা “কি পড়বে তা তো এখনো বলিনি” – একটা ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্রের ইঙ্গিৎ।
দেশব্রতী – এই প্রেক্ষিতে সংবাদপত্র, লিটল ম্যাগাজিন, গ্রন্থাগার, পাঠক – কি অবস্থান নেবেন বলে আপনার মনে হয় ?
সন্দীপ দত্ত –জেলার সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপণগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার আগের মত আর সেখানে বিজ্ঞাপণ দিচ্ছে না।
[ অনেকগুলো জেলার কাগজ দেখালেন সন্দীপবাবু। ‘যুগের ডাক’, ‘সূর্যাবর্ত বার্তা’, ‘খড়গপুর গ্লোবাল নিউজ’, মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশিত ‘ঝড়’ ইত্যাদি। ] অথচ স্থানীয় সংবাদকে সামনে আনার ক্ষেত্রে জেলার কাগজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজ্যের সংস্কৃতি বাজেট অনেক বেড়েছে। অথচ ছোট কাগজ, জেলার কাগজের জন্য অনুদান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
পুরস্কার নীতি, সংবর্ধনা নীতিটা ঠিক কীভাবে চলছে সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিৎ। কিন্তু লিটল ম্যাগ নিজের ক্ষমতাতেই চলে। সে সরকারী অনুগ্রহ মানে না। আর ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গ্রন্থাগারই করবে। গ্রন্থাগার নিজস্ব কন্ঠস্বরে কথা বলবে।
আর মানুষের সামনেও ছদ্মবেশ ক্রমশ খুলে যাচ্ছে। সে ফতোয়া মানবে না। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।