জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ একটানা দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজ্য শাসনের পর বামফ্রন্টের ভারাডুবির মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে শুক্রবার কংগ্রেস তৃণমূল জোট জয়লাভ করেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান ঘটল। ছয়পর্বে অনুষ্ঠিত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। ইতোমধ্যে তিনি রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে সরকার গঠনের বিষয় আলোচনাও করেছেন। বহুল প্রত্যাশিত ২৯৪ আসনের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়লাভ করে।
বেসরকারীভাবে ঘোষিত ২৯৪ আসনের মধ্যে তৃনমূল জোট ২২৬ আসনে জয় পায়। সিপিআই (এম)-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ৬২ আসন পেয়ে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে। ছয়টি আসনে জয় পেয়েছে অন্যান্য দল। আগেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল যে, মমতা-ঝড়ে মহাকরণের হিসাব এবার পাল্টে যাবে। তবে নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় মমতা ঝড় নয় বয়ে গেছে আসলে মমতা সুনামি।
এ সুনামির টেউ এতটাই উঁচু ছিল যে তাতে রীতিমতো তছনছ হয়ে গেছে দীর্ঘ দিনের বাম ঘাঁটি। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ও পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের যে ঢেউ লেগেছিল তা ২/৩ তিন বছরের ব্যবধানে তীরে এসে আছড়ে পড়ার পর দেখা গেল বামদুর্গ বিধ্বস্ত এক জনপদ। শুক্রবার সকালে ভোটগনা শুরম্ন হওয়ার পর থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে টেনশন নিয়ে ভোটাররা সমবেত হতে থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল শিবিরে আনন্দের ঢেউ লাগতে শুরম্ন করে। দুপুরের আগেই বামফ্রন্টের শোচনীয় পরাজয় এবং তৃণমূলের ভূমিধস বিজয়ের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ভোটের ফলাফলের হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে তা আঁচ করতে পেরে প্রবীণ বাম রাজনীতিক ও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু পরাজয় মেনে নিয়ে বলেন, এ পরাজয় অপ্রত্যাশিত। তবে তাঁরা বলেন, পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের যে সেস্নাগান উঠেছে ভোটাররা তা মেনে নিয়েছে। আমরা ভোটারদের কাছে গিয়েছি এবং তাদের আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। খবর পিটিআই,এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এএফপির।
টানা সপ্তমবারের মতো বিধানসভা নির্বাচনে জয় লাভের পর এবারের অষ্টম বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তনের যে হাওয়া লেগেছিল তা আঁচ করতে পেরেছিলেন সবাই।
পরিবর্তনের সেস্নাগান দেয়ার পর থেকেই এ নির্বাচনের ওপর গোটা ভারতবর্ষের নজর ছিল এ নির্বাচনের দিকে। সর্বশেষ বুথ ফেরত জরিপে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে তৃণমূল জোটের জয়লাভের ইঙ্গিত দেয়া হয়। তবে তৃণমূলের নিজস্ব জরিপে জয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকলেও ব্যবধান যে এতটা বড় হবে তা ভাবেনি। জানা গেছে, তৃণমূলের হিসাব অনুযায়ী ১৬২ থেকে ১৭২ আসনে তাদের জয় আসতে পারে। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট।
শুক্রবার দুুপুর পৌনে ৩টার দিকে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৪৮টি আসন নিশ্চিত হওয়ার পর পরই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের সমর্থকরা উলস্নাসে ফেটে পড়ে। তারা রং ছিটিয়ে, নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। ভোট গণনার সময় তৃণমূল নেত্রী মমতা ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। তবে বাড়ির সামনে সমর্থকদের ভিড় বাড়তে থাকলে তিনি মাঝে মাঝে বাড়ির বাইরে এসে সমর্থকদের শানত্ম থাকার আহ্বান জানিয়ে সংৰিপ্ত বক্তৃতা করেন। জয়ের পর কম দামী একটি সাদা শাড়ি পরে মমতা জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, আমি আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ, আপনারা শানত্মি বাজায় রাখুন।
আমি বাংলার, ভারত বর্ষের এবং এমনকি সারা বিশ্বের যাঁরা এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মমতা ব্যানাজর্ী বলেন, নির্বাচনী ফলে আমি ভীষণ খুশি। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে গত ১৮ এপ্রিল প্রথম দফায় ৫৪ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল ৫০ আসনে, ২৭ এপ্রিল ৭৫ আসনে, ৩ মে ৬৩ আসনে, ৭ মে ৩৮ আসনে এবং সর্বশেষ ১০ মে ১৪ আসনে অবাধ ও শানত্মিপূর্ণ ভোটগ্রহণ হয়। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে কেন্দ্রগুলোতে ভোট গণনা শুরম্ন হয় ।
তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবর্তন আর বামফ্রন্টের ্তুপ্রত্যাবর্তন্থ সেস্নাগানের লড়াইয়ে নির্বাচনের আগেই গরম হয়ে উঠেছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মাঠ। উত্তেজনা বেড়ে চলায় নেয়া হয়েছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। বিশেষ করে রাজ্যের সীমানত্মবর্তী মাওবাদী অধু্যষিত এলাকাগুলোতে তিন সত্মরের নিরাপত্তা নেয়া হয়। জেলার সীমানত্মগুলোতে বসানো হয় বিশেষ নিরাপত্তা চৌকি। এর আগে ২০০৬ সালের ৮ মে সর্বশেষ বিধানসভার নির্বাচনে বামফ্রন্ট পায় ২৩৩ আসন।
আর তৃণমূল-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৫৪টি।
তবে ভারতের রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পরিবর্তনের' ডাকের কারণে পুরো ভারতের চোখ ছিল পশ্চিমবঙ্গের দিকেই। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তিনি এই জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অপরদিকে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট 'অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের' ডাক দিয়ে ভোটের মাঠে নামে। দলের নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০০০ সালের ৬ নবেম্বর থেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজ্যে বিগত পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এবার বিধানসভা নির্বাচনেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো। এই ভরাডুবির পেছনে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, রিজুওয়ান হত্যাকা-সহ বিভিন্ন ইসু্য মুখ্য ভূমিকা রেখেছে বলে রাজনৈতিক বিশেস্নষকদের অভিমত।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন সরকার গঠনের জন্য তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের প্রয়োজন ছিল ১৪৮টি আসন। শুক্রবার সকাল ৮টায় ভোট গণনা শুরম্নর পর দুপুরের আগেই মমতার তৃণমূল জোটের বিজয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দেড়টার দিকে রাজ্যভবনে গিয়ে রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট জয়ী হলে জোট নেতা ও ভারতের রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হবেন কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে নানা জল্পনা কল্পনা ছিল শুক্রবার তাঁর অবসান ঘটালেন মমতা নিজেই। বলেছেন, আগামী ৬ মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মধ্যদিয়ে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার কালিঘাটের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মমতা ব্যানার্জি। রাজনৈতিক জীবন শুরম্ন করেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের মাধ্যমে।
১৯৭৬ সালে মমতা রাজ্য মহিলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে যাদবপুর আসন থেকে প্রথমবারের মতো লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সে সময় তিনি সিপিএম এর শীর্ষ নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে পরাজিত করেন। এর পরপরই অল ইন্ডিয়া যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মমতা। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও পরে তিনি দক্ষিণ কলকাতা আসন থেকে ১৯৯১, ৯৬, ৯৮, ৯৯, ২০০৪ ও ২০০৯ সালে লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। সে সময় থেকেই তিনি দলটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের সমস্যা, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর ও রিজুওয়ান হত্যাকা- নিয়ে সরব ছিলেন এই নেত্রী। কলকাতার সাধারণ মানুষের কাছে ্তুদিদি্থ হিসেবেই পরিচিত তিনি।
বুদ্ধদেব ও তাঁর যেসব মন্ত্রী পরাজিত
হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গেলেন শাসকদল বামফ্রন্টের নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি যাদবপুর আসনে তৃণমূল প্রার্থী মনীশ গুপ্তের কাছে ১৬ হাজার ৭৭৭ ভোটে পরাজিত হন। পশ্চিমবঙ্গের ৬৪ বছরের ইতিহাসে তিনিই হচ্ছেন দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী যিনি বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হলেন। এর আগে ১৯৬৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুলস্ন চন্দ্র সেন প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যান। দলের পরাজয় স্পষ্ট হয়ে ওঠায় শুক্রবার দুপুরেই তিনি রাজ্যপালের কাছে পদত্যাগপত্র জামা দেন।
অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বাম ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু এক যুক্ত বিবৃতিতে এই পরাজয়কে ্তুঅপ্রত্যাশিত্থ বলে উলেস্নখ করেছেন। অবশ্য বুদ্ধদেবের মত ডাকসাইটে আরও যেসব শীর্ষ বামনেতা ও মন্ত্রী মমতার পরিবর্তনের সেস্নাগানের ধাক্কায় হেরে যান তারা হচ্ছেন শিল্পমন্ত্রী নিরম্নপম সেন, অর্থমন্ত্রী অশোক দাশগুপ্ত, গৃহায়ণ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব, পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টচার্যকে। অপরদিকে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের কোন হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়ের খবর পাওয়া যায়নি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০০০ সালের ৬ নবেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি বিধানসভার যাদবপুর আসনে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।
১৯৭৭ সালে কলকাতার কুশি আসন থেকে প্রথম বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিএমের পলিটবু্যরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০০০ সালের নবেম্বরে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালে বুদ্ধদেব তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। এর আগে বুদ্ধদেব বিভিন্ন মেয়াদে স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় রয়েছে। রাজ্যে বিগত পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ব্যাপক ভরাডুবি হয়।
সিঙ্গুর, নন্দিগ্রাম, রেজওয়ান হত্যাকা-ের মতো বিষয়কে এর জন্য দায়ী করেন রাজনৈতিক বিশেস্নষকরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।