আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের খুনের রাজনীতি



২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে লালগড়ে হিংসাশ্রয়ী নৈরাজ্যের আন্দোলন শুরু করার পর থেকে এই সময়ের মধ্যে মাওবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে একশো জনের বেশি মানুষকে খুন করেছে। কারা নিহত হয়েছেন? যদি রাজনৈতিক চরিত্র বিচার করেন তাহলে দেখবেন, নিহতদের সিংহভাগই সি পি আই(এম)-র কর্মী, সমর্থক এবং নেতা। কয়েকজন পুলিসকর্মীও রয়েছেন। কয়েকজন সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসী এবং কয়েকজন সরকারী কর্মী, ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি পেশাজীবীও নিহতদের তালিকায় রয়েছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখলে নিহতদের বেশিরভাগই গরিব খেতমজুর, ছোট কৃষক, সামান্য দোকানদার বা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

সম্প্রদায়গতভাবে বেশিরভাগই হয় গরিব তফসিলীজাতির অথবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের। স্পষ্টতই, মাওবাদীরা মুখে যাদের মুক্তির আন্দোলনের কথা প্রচার করে বাস্তবে তাদের হিংসায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারাই। মাওবাদীদের দাপটে লালগড় এবং সংলগ্ন এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্তব্ধ হয়ে গেছে। এমনিতেই গরিব মানুষগুলির রুটি রুজি আরো বিপন্ন হয়েছে। কেন্দুপাতার ব্যবসা থমকে গেছে, শালপাতা ডাঁই হয়ে গরিবের ঘরে জমা হয়ে রয়েছে, কিন্তু কেনার লোক নেই।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এন আর ই জি এ অথবা অন্যান্য গ্রামোন্নয়ন প্রকল্পগুলি ব্যাহত হচ্ছে। এসবের সরাসরি মাশুল গুণতে হচ্ছে গরিব গ্রামবাসীদের। এককথায় পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার কয়েকটি ব্লকে মাওবাদীরা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে গরিবের বিরুদ্ধে।

লালগড়ে মাওবাদীরা পুলিসী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নাম করে আন্দোলন শুরু করার পর থেকেই একদল বুদ্ধিজীবী এবং বামফ্রন্ট বিরোধী সমালোচক মাওবাদীদের আড়াল করতে নৈরাজ্যের আন্দোলনকে বঞ্চনা এবং অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকে। সারা দেশজুড়ে এই অপপ্রচার করা হয় বামফ্রন্ট সরকারকে হেয় করতে। এই অপপ্রচার জঙ্গলমহলের এবং আদিবাসীদের উন্নয়নে, জমির আন্দোলন থেকে শুরু করে পরিকাঠামো উন্নয়নে বামফ্রন্ট সরকারের সমস্ত উদ্যোগ এবং সব বাস্তব তথ্যকে অস্বীকার করে। আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নের যাবতীয় সত্যকেও অস্বীকার করে। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না।

মাওবাদীদের আন্দোলনও যে আদৌ অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে উন্নয়নের দাবিতে নয়, তা অচিরেই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। মাওবাদীদের প্রকাশ্য সংগঠন জনসাধারণের কমিটি যে ১৩ দফা দাবিতে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে আন্দোলন শুরু করেছিলো তার দিকে চোখ বোলালেই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। ঐ ১৩ দফা দাবির মধ্যে ছিলো, পুলিস সুপারকে কান ধরে ওঠবোস করতে হবে, নাক খত্‌ দিতে হবে, সি আর পি এফ ক্যাম্পগুলি তুলে দিতে হবে, পুলিসের টহল বন্ধ করতে হবে, মাওবাদী অভিযোগে ধৃতদের ছেড়ে দিতে হবে, মাওবাদী নেতা শশধর মাহাতোর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে ইত্যাদি। এই দাবিপত্রের একটি দাবিও উন্নয়ন সংক্রান্ত ছিল না। সবই ছিলো মাওবাদীদের খুনের রাজনীতির সুবিধা ঘটানোর জন্য তোলা দাবি, পুলিসকে নিস্ক্রিয় করার দাবি।

দুঃখের কথা, এতদ্‌সত্ত্বেও বামফ্রন্ট বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা মাওবাদীদের আন্দোলনের মধ্যে আদিবাসীদের উন্নয়নের দাবি দেখতে পেয়েছেন। যদিও মাওবাদীদের কর্মতৎপরতা যত বেড়েছে, জঙ্গলমহলের উন্নয়নের কাজ ততই ব্যহত হয়েছে। আন্দোলনের নামে জঙ্গলমহলের হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যা আদিবাসীদের সংস্কৃতির সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। মাওবাদীদের হিসাবে জঙ্গলমহলের উন্নয়নের মানে পশ্চিমবঙ্গের এই অঞ্চলে একই সঙ্গে প্রশাসনের গতিবিধি অবাধ হয়ে যাবে, এবং পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের সমর্থন আদায়ে মাওবাদীদের অসুবিধা হয়ে যাবে। মাওবাদীদের কাছে তাই এই উন্নয়ন কাম্য নয়, তাদের মতে আদিবাসীদের জঙ্গলের অনুন্নত জীবনই যাপন করা উচিত এবং সেই ভাবেই অপেক্ষা করা উচিত বা সশস্ত্র জনযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত পুঁজিবাদকে ডিঙিয়ে একবারে সমাজতন্ত্রে পৌছোনোর জন্য।

মাওবাদীরা নিজেরাও জানে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত জেলাগুলির গ্রামাঞ্চলেই তাদের কর্মপরিধি সীমিত। অর্থাৎ উন্নয়নের জন্য শ্রেণীসংগ্রাম নয়, বরং শ্রেণীসংগ্রামের শর্ত হিসাবে অনুন্নয়নকে ধরে রাখা। উদাহরণ হিসাবে বেলপাহাড়ীতে রাস্তা নির্মানে বাধা দেওয়ার কথা বলা যেতে পারে। রাস্তা হলে মানুষের কি সুবিধা হবে সেটা মাওবাদীদের কাছে বড় কথা নয়, কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে অসুবিধা হবে, সেটাই বড় কথা। একই কারণে মাওবাদীরা শালবনীতে জিন্দালদের নির্মীয়মাণ ইস্পাত কারখানায় বাধা দিয়েছে।

প্রকল্পের বেশিরভাগটাই সরকারের খাস জমিতে হচ্ছে, অনুর্বর জমির এই এলাকায় কৃষিকাজ মানুষের জীবিকার চাহিদা মেটাতে পারে না। ইস্পাত কারখানার মাধ্যমে লক্ষাধিক আদিবাসী যুবদের কর্মসংস্থান হতে পারে। এই উন্নয়ন মাওবাদীরা চায় কি করে! তাই তারা পরিবেশের নাম করে, সেজের নাম করে, আজগুবি নানা প্রচার করে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে চলেছে। শুধু বৃহৎ শিল্পপ্রকল্পই নয়, একশো দিনের কাজ, পুকুর কাটা, গ্রামীন রাস্তা নির্মাণ, এসবই মাওবাদীদের বাধার মুখে পড়েছে। এমনকি যে আদিবাসীদের বনাঞ্চলের অধিকার দেওয়ার কথা মুখে মাওবাদীরা বলে থাকে, সেই কাজেও মাওবাদীরা বাধা সৃষ্টি করেছে।

রাজ্য সরকার আদিবাসীদের বনাঞ্চলের পাট্টা দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলেও মাওবাদীদের ভয়ে জঙ্গলমহলে সরকারী কর্মীরা পরিদর্শনের কাজ করতে পারছে না। ফলে রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে দ্রুত পাট্টা দেওয়ার কাজ এগিয়ে চললেও জঙ্গলমহলে তা থমকে যাচ্ছে। মাওবাদীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের তফাৎটা এখানেই। দন্ডকারণ্যে মাওবাদীরা আদিবাসীদের আদিম সমাজের মতো দারিদ্রের সাম্য দিতে চায়। আর বামফ্রন্ট শালবনীসহ জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের উন্নয়নের সুযোগ পৌছে দিতে চায়।

বামফ্রন্ট একথা জানে যে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। কিন্তু যে উন্নয়ন করা সম্ভব তার সুফল পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীরা পাবেন, তার ফলে তাদের শ্রেণীচেতনার আরো বিকাশ ঘটবে, শ্রেণীসংগ্রাম আরো শক্তিশালী হবে। কিন্তু যে মাওবাদীরা কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনকে তাদের অর্থনৈতিক নীতির জন্য সংশোধনবাদী আখ্যা দেয়, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে তারা পুঁজিবাদী বলে গাল দেবে এতে আর আশ্চর্যের কি আছে! দেশের অন্যান্য অংশের মাওবাদী তৎপরতার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের সক্রিয়তার যে কিছু রাজনৈতিক পটভূমিগত পার্থক্য রয়েছে, সংবাদমাধ্যমের দৌলতে তা এখন মোটামুটি সকলেই জানেন। মাওবাদীরা এরাজ্যে লালগড়সহ সেই অঞ্চলেই তাদের ভিত্তি জোরদার করেছে যেখানে বামবিরোধী শক্তিগুলি(কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, ঝাড়খন্ডী পার্টি) আগে থেকেই শক্তিশালীভাবে বিরাজ করছে। ঝাড়খন্ড সীমানা ব্যবহার করে মাওবাদীরা এই অঞ্চলে বামফ্রন্টবিরোধী শক্তিগুলির সহায়তায় ঢুকে খুন সন্ত্রাস চালিয়ে পুলিস প্রশাসনের তৎপরতা থেকে বাঁচতে ফের ঝাড়খন্ডে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

জঙ্গলমহলের ভৌগোলিক এলাকাও মাওবাদীদের তৎপরতায় সহায়ক হয়েছে। খুন করে পালিয়ে যাওয়ার রাজনীতি তারা সহজেই চর্চা করে চলেছে। নৈরাজ্যের এই রাজনীতি চর্চা করতে করতে মাওবাদীরা এখন আর গোপনে বামফ্রন্টবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করছে না, প্রায় প্রকাশ্যেই তারা একটি বামফ্রন্টবিরোধী জোটে অংশ নিয়ে ফেলেছে। এব্যপারে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে হাত মেলাতে মাওবাদীরা কোনোরকম দ্বিধা করেনি। সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসাবে তারা বেছেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে।

মাওবাদীদের যে সে নেতা নন, স্বয়ং পলিটব্যুরোর সদস্য কিষেণজী বলেছেন, ‘মমতাই পশ্চিমবঙ্গের যোগ্যতম মুখ্যমন্ত্রী। ’ আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় যে ভাবে মানুষের দাবি মেনে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছেন, তাতে তিনিই পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য যোগ্যতম। আমরাও তাই চাই। ’ এই সহজ কথাটি বলার জন্য ভুলে ভরা তত্ত্বকথার অপ্রয়োজনীয় ধুম্রজাল সৃষ্টি করতে হয়েছে কিষেণজীদের। মমতা ব্যানার্জি আর তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রেণীচরিত্র, বুর্জোয়া বিকল্প, বিপ্লবী চরিত্র-এসব জটিল কথা আউড়েছেন মমতা ব্যানার্জির হয়ে সাফাই গাওয়ার জন্য।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত মাওবাদীরা প্রকাশ্যে তৃণমূল কংগ্রেসকে বুর্জোয়া দল বলেই গাল দিত। তখনো অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের স্বার্থ খুব একটা নজরে আসেনি তাদের। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা কিছুটা পালটেছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই(এম)-র বিরুদ্ধে আক্রমণ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। মাওবাদীরাও ‘কেবল আমরা ভালো, বাকি সবাই খারাপ’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে এই লড়াইতে বন্ধু খুঁজে পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে।

মমতা ব্যানার্জিও পালটা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এর আগেই তিনি লালগড় থেকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিসবাহিনীর যৌথ অভিযান প্রত্যাহারের দাবি করেছিলেন। এখন তিনি একথাও বলছেন যে, ‘মাওবাদীদের সাহায্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিস ব্যবস্থা নিলে রাজ্যে আগুন জ্বালানো হবে। ’ এর আগে অবরুদ্ধ লালগড়ে যখন প্রশাসনের কেউ ঢুকতে পারছিলেন না, তখনো মমতা ব্যানার্জি নিজে ভিতরে গিয়ে মাওবাদীদের মুখপাত্র ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে একমঞ্চে ভাষণ দিয়ে নৈরাজ্যের আন্দোলনকে সমর্থন করে এসেছেন। মাওবাদীরা রাজধানী এক্সপ্রেসকে আটকে হিংসাত্মক তান্ডব চালালেও রেলমন্ত্রী চোখ বুঁজে থেকেছেন।

তিনি এসবের পিছনে ‘সি পি এমের কারসাজি’ দেখেছেন, কিন্তু মাওবাদীদের অপরাধ দেখতে পাননি। এমনকি সেজন্য রেলের এফ আই আর–এ মাওবাদীদের নামও করেননি। তৃণমূলের আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশির অধিকারী তো বলেই ফেলেছেন, তিনি নাকি আগের দিন সন্ধ্যাতেই জানতেন রাজধানী অপহরণ কান্ড ঘটবে। প্রতিদিন মাওবাদীদের হাতে খুন হওয়া সত্ত্বেও মমতা ব্যানার্জি মাওবাদীদের আড়াল করতে বলে গেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী বলে কিছু নেই, মার্কসবাদীরাই মাওবাদী। ’ বোঝাই যাচ্ছে, পেয়ালায় পেয়ালা ঠুকে মমতা ব্যানার্জি ও কিষেণজী পরস্পরের বন্ধুত্ব দৃঢ় করার শপথ নিচ্ছেন।

সি পি আই(এম) দীর্ঘদিন ধরেই মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের গভীর সম্পর্কের কথা বলে আসছে। কাজেই কিষেণজী যে খুব একটা অজানা কথা ফাঁস করে দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন, বামবিচ্যুতি চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত তা দক্ষিণপন্থায় পর্যবসিত হয়। বাম হঠকারীরা যাত্রা শুরু করে দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে তোপ দেগে এবং বামপন্থার সঠিক অবস্থানকে আপোষকামী বলে গাল দিয়ে। ভুল পথে এগোতে এগোতে হতাশা বাড়ে, সাফল্য দূরের কথা, প্রতিনিয়ত ব্যর্থতা নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে।

আদর্শগত অবস্থান গলতে থাকে, তরল হতে হতে ছড়িয়ে যায়, মাখামাখি হয়ে যায় জঞ্জালের সাথে। তখন আক্রমণের সূচীমূখ দক্ষিণপন্থীদের বদলে ঘুরে যায় সঠিক অবস্থানকারী বামপন্থীদের দিকেই। আর এই বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইতে বামহঠকারীরা শেষপর্যন্ত বন্ধুত্ব পাতায় দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গেই। ইতিহাসে এমন ঘটনা অনেকবার দেখা গেছে। রাশিয়াতেও বামসন্ত্রাসবাদী নারদনিকরা একসময়ে দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই লেনিনকে আক্রমণ করেছিলো, একথা কেউ ভুলে যাবে কি! মাওবাদীরা আজ দক্ষিণপন্থী শিবিরে নিজেদের প্রত্যক্ষ অবস্থান নির্দিষ্ট করে নিয়ে সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টিকেই আক্রমণ করছে।

শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও আন্দোলনকে ধ্বংস করে দক্ষিণপন্থীদের সুবিধা করে দিতে চাইছে, পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের সরকারে চরম দক্ষিণপন্থী তৃণমূল কংগ্রেসকে বসানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবু বাজারে ব্র্যান্ডের একটা ওজন রয়েছে। নিজেদের বামপন্থী সাজানোর চেষ্টা তাই কিষেণজীরদের প্রবলভাবেই রয়েছে। তাই মমতা ব্যানার্জিকে তিনি বুর্জোয়া বিকল্প হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মার্কসবাদের দফারফা করে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আউড়ে বলেছেন, ‘তৃণমূল ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল।

মমতার কথাতেই দল চলে। তাই শ্রেণীচরিত্রের বাইরে গিয়েও গরিব কৃষক আদিবাসীদের পক্ষে তৃণমূলের কাজ করা সম্ভব। ’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিষেণজীরা থাকলে নিশ্চয়ই তাঁরা জার্মানীর নাৎসী পার্টির মধ্যে ভালো ভালো গুণ আবিষ্কার করতেন এবং তাদেরই সমর্থন করতেন। সমর্থন করতেন ইতালির ফ্যাসিস্টদেরও। কারণ হিটলার এবং মুসোলিনী দুজনেই দল চালাতেন ব্যক্তিকেন্দ্রিকভাবে।

ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তই যেখানে দল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ সেখানে তো শ্রেণীচরিত্রের উর্ধ্বে উঠে গরিবের ভালো করাই যায়। লাল সোভিয়েতকে ধংস করতে হিটলারদের পিছনে ইউরোপের পুঁজিপতিদের যে প্রবল মদত ছিলো সেটা কিষেণজীরা অবশ্যই অস্বীকার করবেন। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে ধ্বংস করতে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ দেশীয় পুঁজিপতিদের মদতও যে কিষেণজীরা দেখতে পাবেন না, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে! বন্ধু হিসাবে মাওবাদীরা যে শুধু তৃণমূল কংগ্রেসকেই বেছেছে তাই নয়, সুশীল সমাজ এবং বুর্জোয়া মিডিয়াকেও বেছে নিয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকার যে সংবাদে মমতা ব্যানার্জিকে মাওবাদীদের পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী বলে ছাপা হয়েছে, সেখানেই লেখা হয়েছে, ‘শনিবার আনন্দবাজারে ফোন করে কিষেণজী বলেন,....’। বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রে মাওবাদীদের আস্থা না থাকলেও বুর্জোয়া মিডিয়ার ওপরে মাওবাদীদের আস্থা কতটা প্রবল বুঝে নিন।

তাই এতদিন বুর্জোয়া মিডিয়াকে গালি দিয়ে এসেও এখন প্রতিদিন গামছায় মুখ ঢেকে তাদেরই সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে। টেলিফোন করে খবর দিতে হচ্ছে। কারণ শেষপর্যন্ত তো এই বুর্জোয়া মিডিয়াও সি পি আই(এম)-র বিরুদ্ধেই লড়ছে। সাধারণভাবে সুশীল সমাজ(সিভিল সোসাইটি) এবং এন জি ও-গুলি যে নীতিতে বিশ্বাস করে তা মাওবাদীদের ঘোষিত নীতির বিপরীতধর্মী। মাওবাদীরা রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাকেই অনিবার্য সত্য বলে মনে করে।

এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে সেই রাষ্ট্রকে মোটামুটি সর্বাত্মক ধাঁচে চালাতে চায়। সুশীল সমাজ এবং এন জি ও-রা এর বিপরীত। তারা সমাজে রাষ্ট্র ও রাজনীতির অস্তিত্বকে ন্যূনতম করে আনতে চায়। তারা সিভিল সোসাইটির পক্ষে। এই দুই বিপরীতধর্মী শক্তির মেলবন্ধন কোনো নীতি ও আদর্শগত দিক থেকে সম্ভব নয়।

কিন্তু মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের যখন সমঝোতা হয়ে যাচ্ছে তখন এই প্রশ্ন অবান্তর। সুশীল সমাজ যখন পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই(এম)-র বিরুদ্ধে লড়ছে তখন তাদের বন্ধু বানাতে মাওবাদীদের অসুবিধা কি! সি পি আই(এম) এবং বামফ্রন্টের গণভিত্তি দুর্বল করার জন্য মাওবাদীরা এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও সমর্থন করছে। তাই দার্জিলিঙের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাসহ এরাজ্যের সব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলিকে মাওবাদীরা সমর্থন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা দপ্তর একথাও জানতে পেরেছে যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গেও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে মাওবাদীরা। আমাদের রাজ্যের কিছু তথাকথিত মানবাধিকারবাদী লালগড়ে স্কুলবাড়িতে পুলিস ক্যাম্প চালানোর জন্য রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে চলেছে।

মাওবাদীরাও একই কথা বলে চলেছে। রাজ্য সরকার জানিয়েছে, স্কুলবাড়ি আটকে রাখার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই, যতদ্রুত সম্ভব পুলিস ক্যাম্পের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু মাওবাদীরা কি সত্যিই শিশুদের অধিকার রক্ষায়, এবং তাদের পঠনপাঠনে আগ্রহী? তথ্য বলছে, মাওবাদীরা নিজেরাই বহু স্কুলবাড়িতে হামলা চালিয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের অনেক স্কুলে ঢুকে শিশুদের সামনে তাদের মাস্টার মশাইদের গুলি করে মেরেছে। এমনই একটি ঘটনায় ছোট্ট মার্শাল মুর্মুকে সংবাদের শিরোনামে এসেছে।

তৃতীয় শ্রেণীর এই ছাত্র শ্রেণীকক্ষে মাওবাদীদের গুলির হাত থেকে তার প্রিয় মাস্টারমশাইকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছিলো। এসব ঘটনা অবশ্য মাওবাদীদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা উল্লেখ করেন না। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে আরো অনেক ভয়ানক অপরাধের অভিযোগ ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোয়েন্দারাই জানাচ্ছেন, মাওবাদীরা অনেকগুলি রাজ্যে স্কুলের ছাত্রদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে অথবা মগজ ধোলাই করে নিজেদের সশস্ত্র বাহিনীতে ঢোকাচ্ছে, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। চাইল্ড সোলজার বা শিশু যোদ্ধা তৈরির এই অভিযোগ এতটাই মারাত্মক যে রাষ্ট্রসঙ্ঘ পর্যন্ত এতে উদ্বিগ্ন।

অভিযোগের সত্যতা জানতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ‘চিলড্রেন অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট’ বিভাগের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর করাও শুরু হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর আগেই রিপোর্ট পেয়েছিল কয়েকটি রাজ্যের পুলিসের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে নিজেরাও অনেকগুলি তথ্যের বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ঝাড়খন্ডে মাওবাদীরা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ শিশুদের বাহিনীতে অন্তুর্ভূক্ত করছে। শুধু প্রোপাগান্ডা করা এবং গোপনে খবর চালাচালি করার জন্যই নয়, শিশুদের আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা শ্রীলঙ্কার এল টি টি ই এবং নেপালের পূর্বতন মাওবাদীদের কাছ থেকে শিশুদের যুদ্ধে ব্যবহার করা শিখেছে ভারতের মাওবাদীরা।

স্বরাষ্ট্রদপ্তরের কাছে সুনির্দিষ্ট খবর আছে, পশ্চিমবঙ্গের কাছেই ঝাড়খন্ডের ধানবাদ ও গিরিডির জঙ্গলে কমপক্ষে ৩০০ কিশোরকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। ওড়িশায় বাল সঙ্ঘম নাম দিয়ে এই বাহিনী চালায় মাওবাদীরা। ছত্তিশগড়ে এই বাহিনীরই নাম ক্রান্তিকারী আদিবাসী বালক সঙ্ঘ। ঝাড়খন্ডে এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছে চাইল্ড লিবারেশন আর্মি। বর্তমানে লালগড় ব্লকেও কয়েকটি জায়গায় স্কুল ছাত্রদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

শুরুতে মাওবাদীরা শিশুদের শুধুই পুলিসের সামনে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতো। এখন মাওবাদীদের হামলাকারী সশস্ত্র বাহিনীতেও শিশুকিশোরদের ব্যবহার করছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মাওবাদীরা শালবনীতে এক সি পি আই(এম) সমর্থককে খুন করতে যে বাহিনী পাঠিয়েছিলো তাতে দাঁড়ি গোঁফ না ওঠা একদল কিশোরকে ব্যবহার করা হয়েছিলো বলে জানা গেছে। যে মাওবাদীরা এই ভাবে শিশু কিশোরদের জীবনকে ধ্বংস করে অপরাধী গড়ে তোলে তাদের মুখে কোনো মানবাধিকারের কথা শোভা পায় কি?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.