আমি কাল্পনিক তবে অবাস্তব নই, আমি দুঃখকে কল্পনার সুখে রূপান্তর করি...... ঐ হারামজাদা উঠ। জমিদারের বাচ্চা কত ঘুমাস???
স্টেশনের পিয়নের গালাগালিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় রফিকের। কোনমতে ছেড়া কাঁথাটা গুছিয়ে চোখ ডলতে ডলতে উঠে যায় রফিক।
কেও নেই তার। ভালভাবে বুঝতে শেখার আগেই মা বাবা মারা গেছে।
তারপর বস্তির এক মহিলা তাকে আগলে রেখেছিল দুই বছর। যদিও সেই মহিলা তার কিছুই লাগতো না, তবু নিজের ছেলের মতই আদর করত। রফিক তাকে চাচী বলে ডাকতো। কিন্তু যেবার প্রচণ্ড জ্বরে বিনা চিকিৎসায় চাচী মারা যায়, তার কয়দিনপর তার বদরাগী ছেলেটা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় রফিককে।
বড় একা হয়ে যায় সে।
দিনের ঝলমলে আলো শেষে আঁধার নেমে আসলে মাথা গোজার ঠাই পর্যন্ত নেই। একা একা ঘুরতে থাকে পথের ধারে। ঘুরতে ঘুরতেই পরিচয় হয়ে যায় ওর মতই কয়েকজন পথশিশুর সাথে। তারপর থেকে ওদের সাথেই আছে রফিক। ওদের মতই তারও আজ একটা নতুন পরিচয় আছে।
সে একজন টোকাই।
সারাদিন শহরের এদিক সেদিক কাগজ আর প্লাস্টিকের বোতল খুঁজে বেরায়।
যেদিন ভাগ্য সহায় থাকে সেদিন ভালোই পায়। কিন্তু যেদিন তেমন একটা টোকাতে পায়না, সেদিন পেটভরে দুবেলা ভাতও খেতে পায়না।
আজ তার মাথা গোজার ঠাই বলতে স্টেশন।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আগের দিনের রাখা টাকা থেকে দশটাকা দিয়ে রাস্তার পাশে থাকা খোলা দোকান থেকে একটা রুটি আর একটা কলা খেয়ে নেয় রফিক। তারপর মহাজনের দোকানের দিকে যায়। টিনের একটা ভাঙ্গাচোরা দোকানে মহাজনের ব্যবসা। দিনশেষে ওঁরা সবাই মহাজনের কাছে কাগজ প্লাস্টিকের বোতল বিক্রি করে।
মহাজনের দোকান থেকে প্লাস্টিকের বস্তাটা নিয়ে রফিক বেরিয়ে পরে কাগজ টোকানোর জন্য।
সকাল বেলা যখন দেখে ওর বয়সি ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়, তখন নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে স্কুলে পড়তে না পারার দীর্ঘশ্বাস।
বেঁচে থাকার জন্য দুমুঠো খাবার খাওয়াটাই যেখানে অনিশ্চিত সেখানে স্কুলে পড়া তো অনেক দুরের বিষয়। তাই শব্দহীন কান্নার জলে চাপা পরে যায় দীর্ঘশ্বাস। মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে বড় বেশি নিষ্ঠুর মনে হয় তার কাছে।
তার বাবা মা বেঁচে থাকলে হয়ত সেও আজ স্কুলে পড়তে পারত।
হয়ত তার পরিচয় আজ পথশিশু না হয়ে, হতে পারত এক স্কুল ছাত্র। হোকনা ভাঙ্গাচোরা কোন বস্তির স্কুল।
হাটতে হাটতে কুঁড়াতে থাকে রাস্তার ধারে পরে থাকা কাগজ, আর মানুষের ফেলে দেয়া পানির অথবা জুসের বোতল। প্লাস্টিকের বোতলের চাহিদা বেশি। কাগজের থেকে দামও বেশি।
কম করে হলেও কাগজের থেকে কেজিতে ১০/১২ টাকা বেশিতে বক্রি করা যায়। তাই রফিকের চোখদুটো দিশেহারা হয়ে খুঁজে ফেরে প্লাস্টিকের বোতল, যা তার অন্ন যোগাবে।
চিরচায়িত নিয়মে সকাল গরিয়ে দুপুর হতে থাকে। আর রফিক ছুটে বেরায় এই রাস্তা থেকে সেই রাস্তায়, এই পার্ক থেকে সেই পার্কে। পার্কে রোজগার ভালোই হয় কিন্তু মাঝে মাঝে পার্কের গার্ড দেখতে পেলে নির্দয়ের মত মারে।
কখনো লোকে মিথ্যে চোর বানিয়ে মারে। তবু সে পার্কে টোকাতে যায় একটু বেশি কিছু পাবার আশায়।
দুপুরের রোদে পার্কে গাছের ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয় সে। তারপর চলে মহাজনের দোকানের দিকে। সকাল থেকে পাওয়া সবকিছু মহাজনের কাছে বিক্রি করে দেয়।
সেই টাকা দিয়ে বস্তির হোটেল থেকে খেয়ে নেয় ডাল নামক মশলার পানি দিয়ে দুমুঠো ভাত।
সাড়া বিকেল ঘুরে যদি কিছুপায় তাহলে রাতের খাবার হয়। আর যদি না পায় তাহলে না খেয়েই কাটায়। যেদিন ভীষণ ক্ষিদা পায় সেদিন স্টেশনের রাস্তার পাশে থাকা ওয়াসার ট্যাঁপ থেকে পানি খেয়ে নেয়।
তারপর স্টেশনে বসে অপেক্ষা করে কখন আরও রাত হবে, কখন লোকজন কমবে।
তারপর ছেড়া কাঁথাটা বিছিয়ে ঘুমাবে সে।
ছেড়া কাথার উপর শুয়ে শুয়ে আগামী কালের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরে রফিক।
হয়ত এভাবেই চলবে তার অনিশ্চিত জীবনযাপন . . . ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।