কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
সোলায়মান সাহেবকে তার বাসার সবাই একটু বোকা টাইপ লোক হিসেবেই চেনে। সত্যিকার অর্থে, রিটায়ার্ড এবং ষাটোর্ধ সব লোক সম্পর্কেই তার পরিবারের মোটামুটি একই ধারণা থাকে। সোলায়মান সাহেবের স্ত্রী জীবিত, বড় ছেলে, মেজ মেয়ে আর ছোট ছেলে নিয়ে মোটামুটি শান্তির সংসার।
কিন্তু, ছেলেমেয়েদের সাথে তার স্ত্রীর যতটুকু সম্পৃক্ততা, তা তার সাথে নেই।
তার স্ত্রী রাতের বেলা তার সাথে এক খাটে পাশ ফিরে ঘুমায়। এটুকুই তাদের মধ্যে এখনও অবশিষ্ট।
দিনের পরে দিন অবহেলিত, লাইক হি ডাজনট এক্সিস্ট। এমন না যে তাকে কেউ বিরক্ত করে বা তার কোন সমস্যা হয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে তার সাধারণত কোন কিছুর অভাব হয় না। কিন্তু এখন আর কোন কিছু নিয়ে তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না।
আগেও স্ত্রী সালমা বেগম যা বলেছেন, সোলায়মান সাহেব তার উল্টোটা করে পরিবারে সমস্যা বাড়ান নি। স্ত্রীর কথা মতই চলেছেন। কিন্তু এখন স্ত্রী ছেলে মেয়ে পার্টি অনুষ্ঠান বান্ধবীদের নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি বড় ছেলের বউ মিলির সাথেও সোলায়মান সাহেবের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। উপরে উপরে মিলি আর সালমা বেগমের মধ্যে খাতির থাকলেও ভেতরে কর্তৃত্ব নিয়ে কিছুটা রেষারেষি আছে।
সোলায়মান সাহেব রাতে অনেকক্ষণ জেগে থাকেন। উনাকে যে দুধ খেতে দেয়া হয়, সেটা উনি পর পর এক সপ্তাহ না খেয়ে চেক করে দেখলেন। কারও চোখে ধরা পড়েনি, এমনকি পাশে ঘুমন্ত সালমা বেগমও এত দিনে খেয়াল করে নি। উনার এখন আর আফসোস হয় না। বুড়ো বয়সে কিছু ভীমরতি ধরে উনি সেগুলোকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলেন।
আশেপাশের সবার অবহেলায় উনি গোমড়া মুখে থাকেন না, তার অপছন্দের কাচকলা পর পর তিনদিন রান্না হলেও চুপচাপ খেয়ে যান। কখনও পেটে অসুখ করলেও চোখেমুখে কাতর ভাব দেখিয়ে সহমর্মিতা আদায়ের চেষ্টা করেন না। উনি নিজের মত শুয়ে থাকেন তখন। কিন্তু ভীমরতি এড়িয়ে চললেও উনার খুবই ইচ্ছা করে হারিয়ে যেতে। আসলে বুড়ো বয়সে হয় না।
সাহস পান না।
পাশে শোয়া ঘুমন্ত স্ত্রীকে দেখলেন। সালমা বেগম। এখনও পার্লারে যেয়ে রূপচর্চা করে আসেন। পার্টিতে কী পড়বেন, বড় বউ কী করল, বান্ধবীরা কী কিনল এসব নিয়েই ব্যস্ত অনেক বছর।
ইদানীং নতুন নারী অধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। এটা নাকি হাল ফ্যাশন। সোলায়মান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। একদিন একটা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিলেন মায়ের ইচ্ছায়। মা নেই, এখন সেই মেয়েটাও কিশোরী নেই।
যৌবনের কষ্টগুলোও কেন এখন এত সুন্দর লাগে? উনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে পড়তে থাকে, কত লজ্জা ছিল এই মেয়েটার চোখে সেদিন। বছর কয়েক পরে সোলায়মান সাহেবকে নিয়ে কত আহ্লাদ ছিল তার। বাবুর চিন্তা নিয়ে কত মাথা ঘামাত। আহ, সেই দিন গুলোতে বোঝা যায়নি যে একদিন এইদিনগুলোর কথা মনে করে উনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বেন।
সোলায়মান সাহেব উঠে বসলেন। মশারী তুলে বাইরে ব্যালকনীতে এসে দাঁড়ালেন। যত গভীরই হোক, ঢাকা শহরের রাস্তায় একটা না একটা মানুষ থাকবেই। চারতলা থেকে নিচের দিকে তাকালেন উনি। অস্পষ্ট ছায়ার মত একটা অবয়ব বাসার নিচে দিয়ে আসছে।
ল্যাম্পোস্টের আলোটা বিদ্যুৎ চমকের মত জ্বলে আর নেভে। অন্ধকার আরও জমাট বেঁধে যায়। কালো অন্ধকারে চোখ সয়ে যাবার আগেই সাদা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বয়স হলে যা হয়, ইদানীং সব কিছুতে পুরোন স্মৃতি মনে পড়ে উনার। মনে পড়ে ছোট বেলায় নরসিংদীর কলোনীতে থাকতেন।
সেখানে অনেক ঝোপের মত ছিল তখন। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে ঝোপের উপর জোনাকী পোকারা উড়ত। ছোট্ট সোলায়মান তখন ভাবত জোনাকীগুলোকে কাচের বয়ামে ভরে রেখে দেবেন।
একদিন অনেকগুলো জোনাকী পোকাকে ধরেছিলেন কাচের বয়ামে। প্রায় সারা রাত আলো দিয়েছিল ওরে।
সকালে দেখেন সবগুলো মরে পড়ে আছে। নিজের বোকামীতে অনেক কেঁদেছিলেন সেদিন।
পুরোনো দিনের কথা সারাদিন মনে আসা খারাপ লক্ষণ। মৃত্যুর কাছাকাছি যাবার সময় হয়েছে। রাস্তাটা ধরে যে কালো অবয়বটা আসছে তার জন্য মায়া লাগছে উনার।
এত রাতে কাজ করতে হয়, নিশ্চয়ই খুব একটা স্বচ্ছল পরিবারের লোক না। ছোট থাকতেই পিতার মৃত্যুর পর উনাকেও অনেক কষ্টে থাকতে হয়। কলোনী, ব্যবসা, দোকান, জামা কাপড়, চকলেট সব কিছু তখন দূরের বিষয়। তখন একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কোন মতে মাথা গুজবার ঠাঁই। খুব একটা সুবিধা হয় নি।
আবার রাস্তাতেও ঘুড়তে হয়নি। এ বাসা ও বাসা করে কাটিয়ে দিতে হয়েছে জীবনের অনেকটা দিন।
এক সময় খুব ছোট একটা চাকরী পেয়েছিলেন। এত রাত পর্যন্ত খাটতে হত। এই লোকটার মত এত রাতে বাসায় যেতেন।
এ নিয়ে উনার একটা বাজে অভিজ্ঞতা আছে। একবার এরকম রাত আড়াইটার দিকে ভেতরের এক গলি দিয়ে শর্টকাটে বাসায় যাচ্ছিলেন। মনে মনে একটু খারাপ লাগছিল, কারণ মা কে গেট খুলে দেবার জন্য এত রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখতে হয়। অতদিনে নিজেরা বাসা ভাড়া দিয়েছেন। দুই রুম।
এত রাতে বাড়িওয়ালারা গেট খুলে দিতে চায় না, তালা দেয়া হয় ভেতর থেকে। তাই সোলায়মান সাহেবের মা চাবি নিয়ে ভেতরে গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
সোলায়মান সাহেব খুব তাড়াহুড়ো করে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। কালো অন্ধকার গলি। বিল্ডিং এর ভীড়ে তারার আলোরা মাটিতে পড়ছিল না।
চারদিক কেমন যেন একটা রহস্যময় ভাব ধরে ছিল। হঠাৎ কী যেন দেখে উনি প্রচণ্ড ভয় পান। প্রচন্ড ভয়। শকটা এত জোড়ালো ছিল, উনি যে কী দেখেছেন, তা এখনও উনার মনে পড়ে না। উনি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।
সে সময় সালমা বেগমের পিতা শরাফত আলী তাকে রাস্তা থেকে পেয়ে বাসায় নিয়ে যান। শরাফত আলী মাতাল হলেও মনটা ভাল ছিল তার। সোলায়মান সাহেবের পকেট থেকে মানিব্যাগে তার ঠিকানা পেয়ে উনার মার কাছে যান। কয়েক ব্লক পরেই উনার বাসা ছিল। তখন মা এসে সোলায়মান সাহেবকে নিয়ে যান।
সেখানেই সালমা বেগমের পরিবারের সাথে উনাদের পরিচয় হয়।
এক সময় মা প্রায় জোর করে সালমা বেগমের সাথে সোলায়মান সাহেবের বিয়ে দেন। মেয়েটাকে উনার খারাপ লাগত না, কিন্তু তখনই বিয়ে করতে রাজী ছিলেন না উনি। তাও একটা নতুন জীবনের শুরু হয়। খারাপ কী ! আস্তে আস্তে জীবনের ত কতগুলো দিন কেটেই গেল।
নিচের দিকে তাকান সোলায়মান সাহেব। ল্যামপোস্টের বার বার জ্বলা নেভা আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে খালি। সোলায়মান সাহেব লোকটার দিকে আরেকটু ভাল ভাবে তাকালেন। লোকটা উপরের দিকে মুখ তুলে তাকালো।
সোলায়মান সাহেব সাধারণত এতটা ধাক্কা খান না।
উনি অতিপ্রাকৃত কিছুতে বিশ্বাসও করেন না। কিন্তু আজকে খেলেন। লোকটা যখন উপরে মাথা তুলে তাকালো উনি তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন। লোকটা সোলায়মান সাহেব নিজে ছিলেন!
© আকাশ_পাগলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।