মনে প্রাণে ঘৃণা করি রাজাকার। পাকিস্তানের দালালি করার শখ থাকলে এখানে ল্যাদাতে না আসার জন্য বলা হচ্ছে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ আমার এই পোস্টে কোনরূপ অসুস্থ তর্ক শুরু করা যাবে না। ডাক্তার 'কসাই' অথবা ডাক্তার 'মহাপুরুষ' এই জাতীয় ক্যাচাল তৈরি করা এই পোষ্টের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য নিছক বিনোদন দেয়া।
আমি আমার চাকরি জীবনের মজার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করব বলে লিখতে বসেছি। তখন কেবল ছয় মাস হয়েছে আমার সরকারী চাকরি পাবার। আমার পোস্টিং সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায়। যারা এর নাম আগে শোনেননি তাদের কে বলছি- এটি সিলেট শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলো উত্তর পশ্চিমে। অত্যন্ত অবহেলিত একটি জায়গা, শিক্ষার আলো খুব কমই পৌঁছেছে সেখানে এখনো পর্যন্ত।
প্রতিদিনই সেখানে এমন কিছু রোগী আসতো যাদের কাহিনী শুনলে অবাক না হয়ে পারা জেতনা। মনে করুন ছেলের মা তার পুত্রবধুকে বলল একটা কাজ করতে, বউয়ের সেটা পছন্দ হল না। এক কথা দু কথায় তর্ক শুরু হয়ে গেল। ফলাফল হবে- বউ বা শাশুড়ি কেউ একজন একটা বটি বা দা দিয়ে আরেকজনের মাথায় কোপ। মাথায় দুই ইঞ্চি ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে এসেও একজন আরেকজনকে গালাগাল করছে! থামানোই যাচ্ছেনা! এরকমই খুব সামান্য ঘটনা নিয়ে এমন তুল-কালাম রক্তারক্তি কাণ্ড আমি আর কোথাও হতে দেখিনি, তাও এমন অহরহ।
একই পরিবারে অসংখ্য সন্তানও এখানে খুব সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার। একবার নয়টা সন্তানের এক মা কে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এত সন্তান কেন নিচ্ছেন? তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তার স্বামীর ইচ্ছা তাই। আমি যখন তাকে বললাম যে আপনি আর আপনার স্বামী জন্ম নিয়ন্ত্রণ কোন পদ্ধতি কেন নিচ্ছেন না তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন- নাউজুবিল্লাহ! তাইলে তো সোজা দোযখে যাইতে হইব! আর তাছাড়া এই কাজ করলে তো ইমাম সাব, এলাকার ময় মুরুব্বী সবাই মিলা এক ঘরে কইরা দিব! বুঝুন এইবার! এই হল সেখানকার অবস্থা।
যা হোক ভূমিকা একটু গুরুগম্ভীর হয়ে গেল কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল একটা মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। সেখানেই ফিরে যাই।
তবে এই বেলা আরেকটি বিষয় আগেই পরিস্কার করে নেয়া ভাল—যারা ধর্মানুরাগী লোকজন আছেন তারা আমার এই সত্যি ঘটনাটির কোন ভুল ব্যাখ্যা করবেন না অনুগ্রহ করে। কোন বিশেষ ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাঙ্গ করার কোনরূপ অভিপ্রায় আমার নেই।
এবার ঘটনাটি বলা যাক—
সন্ধ্যার একটু পর আমি আমার চেম্বারে বসে রোগী দেখছিলাম। এমন সময় একজন লোক ঢুকল , দেখে বুঝলাম তিনি খুবই ধর্ম পরায়ণ একজন। আলখাল্লা পড়া, ঘন সুন্দর দাড়ি।
মাথায় টুপি। শরীর থেকে সুন্দর আতরের গন্ধ ভেসে আসছে। ওনাকে সালাম দিয়ে বসালাম। এরপর কথাবার্তা বলে জানতে পারলাম তিনি কাছে পিঠের একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। তিনি তাঁর সমস্যার কথা আমাকে বললেন।
আমি কিছুক্ষণ তাঁকে নানা প্রশ্ন জিগ্যেস করে আমার যা জানা দরকার জেনে নিলাম। রোগটাও নির্ণয় করলাম। কি রোগ সেটা এখানে উল্লেখ করছিনা কারন অনেকেই হয়তো জানেন মেডিক্যাল এথিক্স্ অনুসারে কোন রোগীর অনুমতি ছাড়া রোগ সংক্রান্ত যে কোন তথ্য এমনকি রোগীর স্বামী বা স্ত্রীর কাছেও বলা নিষিদ্ধ। যা হোক আমি তাঁর সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম, প্রায় আধ ঘণ্টা। কারন তাঁর যে রোগ সেটা ভাল করতে হলে ওষুধের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সঠিক কাউন্সিলিং।
গল্প-সল্প করেই তাঁকে আমি অনেক পরামর্শ দিলাম, যদিও কাজটা আমার জন্যে খুব একটা সহজ ছিলোনা যেহেতু তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। অবশেষে অনেক প্রচেষ্টার পর আমি ওনাকে কিছুটা পথে আনতে পারলাম। কিভাবে তাঁর সমস্যা দূর হতে পারে সে সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারনা তিনি পেলেন বলেই মনে হল। এভাবে প্রায় একঘণ্টা পার হল। উনি উঠি উঠি করছেন।
হঠাৎ করে তিনি আমার কলমটা হাতে নিয়ে বললেন "ডাক্তার সাব, আপনার কলমডা তো খুউব সুন্দর! আমার এই রকম একটা সুন্দর কলমের খুউব শখ ছিল! "
পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলছি- কলমটি কোন ঔষধ কোম্পানির দেয়া কলম ছিলোনা। আমার ছাত্রজীবনের বান্ধবী (বর্তমান সহধর্মিণী) তার মাসের হাত খরচের টাকা জমিয়ে খুব শখ করে প্রায় দুহাজার টাকার পার্কার কলমটি আমাকে এক জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। বেচারা রোগীকে তো আর আমি তা বলতে পারিনা, তাই ব্যাগ থেকে খুব সুন্দর আরেকটি কলম বের করে তাঁকে দিয়ে দিলাম। উনি খুশিও হলেন বেশ। এরপর তিনি তাঁর পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢোকালেন।
পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কি জন্যে? আমিও ঠিক তাই ভাবছিলাম আপনাদের মতই। হয়তো এবার আমার ভিজিট দিয়ে উনি রওনা হবেন বাড়ির দিকে। কিন্তু না! আমার জন্য আসলেই আরও চমক অপেক্ষা করছিল তা কে জানতো?
উনি পকেট থেকে একটা রশিদ বই বের করলেন। হাসিমুখে আমাকে বললেন- ডাক্তার সাহেব মসজিদের তরফ থেকে কিছু সাহায্য তুলতেছি সকলের কাছ থেকে। আপনিও যদি শরিক হন তাহলে খুব খুশি হতাম! আমি তখন মানিব্যাগ থেকে একশ টাকা বের করে দিলাম তাঁকে।
তিনি আমাকে একখানা রশিদ ধরিয়ে দিয়ে লম্বা একটি সালাম দিয়ে হাসিমুখে প্রস্থান করলেন ! বলাই বাহুল্য এমন অদ্ভুত রোগীর দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।
শেষ কথাঃ- আমি এখন আর গোয়াইনঘাটে নেই। বছর খানেক হল চলে এসেছি। কিন্তু সেই ভদ্রলোক আমাকে ভোলেননি এখনো। এইতো কিছুদিন আগে ঝুম বৃষ্টির এক রাতে বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছিলাম।
রাত আড়াইটার দিকে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো আমার মোবাইলে, স্বভাবতই একটু বিরক্ত হলাম । পেশাগত কারনে আমি ঘুমের সময়ও মোবাইল বন্ধ বা সাইলেন্ট করতে পারি না, কখন কার মারাত্মক জরুরী প্রয়োজন পড়ে তার যেহেতু কোন ঠিক নেই তাই। তো ফোন ধরার পর প্রথমে অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না কে কথা বলছে ওপাশ থেকে। একসময় বুঝতে পারলাম এটি সেই ভদ্রলোক। আমি এত রাতে ফোন করার কারন জানতে চাইলাম, বললেন তাঁর নাকি পেটে একটু গ্যাসের সমস্যা ! এখন সে একটি 'রেনিডিন' ট্যাবলেট খেতে চায়, আমাকে ফোন করেছে খাওয়া ঠিক হবে কিনা জানার জন্য !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।