اللهم هب لي الحجة البالغة والحكمة الموهوبة
পৌষ মাসের মাঝামাঝি একটি সকাল যেমন হতে পারে চারিদিকে তেমন পরিবেশই বিরাজ করছিল। প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও এককাপ চা মুখে দেওয়ার জন্য হোসেনের চায়ের দোকানটির সামনে প্রায় জনা ত্রিশেক লোকের ভীড়। শীতের মুকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণে কেউ কোনো ত্রুটি করেনি, যে যার সাধ্যমতো মোটা কাপড় গায়ে চেপেই বাড়ি থেকে বের হেয়েছে। তবে শীতের প্রকপ এতটাই বেশি যে, তা সকল প্রস্তুতিকে হার মানিয়ে মাংস আর চামড়া ভেদ করে সরাসরি হাড়ে গিয়ে বিধছে। চায়ের দোকানটির যে জাগাতে জনা দশেক লোক জটলা পাকিয়ে গল্পগুজব করছে তার অদূরেই একটি গাছে হেলান দিয়ে ঠক ঠক করে কাপছে গোরবা বুড়ো।
স্থানীয় ভাষায় গোরবা মানে ভীনদেশী। এই বৃদ্ধ লোকটির নাম গোরবা হওয়ার ইতিহাস আছে।
প্রায় বছর পাচেক আগে এক রাতে কাল বৈশাখী ঝড় হয়। সে ঝড়ে গ্রামের কোরো বাড়িই অক্ষত ছিল না। সকালে সবাই যখন বিধ্বস্ত গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখছিল তখনই একটি ঘরের পড়ে থাকা ছাউনীর নিচে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি এখানেই আছেন। কেউ তাকে খুজতে আসেনি তিনি নিজেও কথা বলতে পারেন না। গ্রামের লোক তাকে নিয়ে নানা কথা বলে। কেউ বলে এ লোক আজন্মা বোবা, কেউ বলে দূর্যগে সহায় সম্বল হারিয়ে শোকে বোবা হয়ে গিয়েছে হয়তো। কোন্ এলাকায় তার বাড়ি এখানে কিভাবে আসলেন তা নিয়েও চলে জল্পণা কল্পণা কিন্তু এই বৃদ্ধ মানুষটার সঠিক পরিচয় কারো কাছেই নেই।
তার নাম যে আসলে কি সেটাও অজানা। শুধু ভীনদেশ থেকে আসার কারণেই মানুষ তাকে গোরবা বলে ডাকে। ঘটনা যাই হোক মানুষ তাকে অনেক শ্রদ্ধা সম্মান করে। লোক হিসাবেও তিনি খারাপ নন। প্রথমে কদিন খুব কষ্ট করেছেন।
সারা দিন মাঠে ঘাটে ঘুরে ফিরে বেড়াতেন। সুযোগ পেলেই কৃষকদের হাতের কাজে লাগতেন বিনিময়ে দুপুরের খাবারটা তাদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতেন আর যেখানে সেখানে মাথা গুজে রাত কাটাতেন। পরে আকবার আলী নিজের প্রয়োজন আর অসহায়ের প্রতি দয়াপরবশ গোরবা বুড়োকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেন। প্রায় ডজন খানেক গরু আর গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিশালায়তন চাষের জমি সামাল দেওয়ার জন্য তার বাড়ি সবসময় প্রায় ৭/৮ জন কৃষান খাটে। তার মতো লোকের পক্ষে দু' চারজন বাস্তুহীনকে আশ্রয় দেওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়।
সেই থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে আকবার আলীর বাড়ি কৃষাণ হিসাবে থাকে গোরবা বুড়ো। আকবার আলী নিজে পাচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। তার ছেলে মেয়ে পরিবার পরিজন সবাই ধার্মিক মুসলমান।
গোরবা বুড়ো জড়ো সড়ো হয়ে গাছটিতে হেলান দিয়ে বসে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল এ বেলা হয়তো আর উঠবেন না।
কিন্তু তাকে এভাবে বসে থাকলে চলবে কি করে, তার তো অনেক কাজ দুহাত উপরে তুলে শরীরটাকে ডানে বায়ে ঝাকিয়ে নিজেকে কাজের জন্য প্রস্তুত করে উঠতে যাবেন সে সময় আকবার আলী চায়ের দোকানে প্রবেশ করলেন। মমতার দৃষ্টিতে গোরবার দিকে একনজর তাকিয়ে চা ওয়ালাকে বললেন,
এই হাসু, গোরবারে এক কাপ চা দে তো।
চায়ের কথা শুনে আবার নিজ স্থানে জেকে বসে বৃদ্ধ। চা হাতে পেলে পরম তৃপ্তির সাথে চুমুক দিতে থাকে।
এর মধ্যে হাজির হয় ভুতো ।
এর ভাল নাম চান্দু। ছোট বেলায় একবার নাকি ভুতে পেয়েছিল সেই থেকে গ্রামের লোক বলে ভুতো। ভুতো ধনী পিতার একমাত্র সন্তান। কয়েক ক্লাস লেখা পড়াও করেছে। বাবার ধন দৌলতের কারণে একসময় গ্রামের লোক ভুতোকে যথেষ্ট কদর করতো।
তবে এখন সে সবার দুচোখের বিষ। শহরে লেখা পড়া করে ফিরে এসে সে আল্লাহ, রসুল নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে। দু - ক্লাস লেখা পড়া করলেই ইসলাম নিয়ে খাবার মন্তব্য করতে হবে এটা কেমন কথা। আর কেউ কি লেখা পড়া করে নি! গ্রামেরই আরেক ছেলে রহীম তো শহরে পড়ে। সে তো ভুতোর মতো কথা বলে না।
ভুতোর সাথে তার মাঝে মাঝে তর্কও হয়।
ভুতোকে হাজির হতে দেখে সবাই যে যার মতো বিরক্তি প্রকাশ করে। দোকনে আসা মাত্র ভুতো হাসুর কাছ থেকে এক কাপ চা নিয়ে এক স্থানে বসে হুস হুস করে পান করতে থাকে। মানুষ জন তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে যে যার গল্পে মন দেয়। এর মধ্যে হাজির হয় রহীম।
রহীমকে আসতে দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে আবার চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এবার নিশ্চয় ভুতোর সাথে রহীমের তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যাবে। ঠিক তাই হলো। রহীমকে দেখা মাত্র ভুতো বলে উঠলো,
আচ্ছা রহীম তুমি আমার সাথে কথা বল না কেনো? আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি?
ময়লা আবর্জনার দিকে মানুষ যেভাবে তাকায় সেভাবে ভুতোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে রহীম বলে,
তোমার সাথে আমার কি কথা, তুমি তো একজন নাস্তিক, আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করো না।
রহীমের কথাটি শুনে ভুতোর মুখে যেনো জুতো পড়লো।
জোর করে মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলল,
তুমি কি বলতে পারো আল্লাহকে কেনো বিশ্বাস করতে হবে? কি কারনে তার গোলামী করতে হবে?
বহু কষ্টে রাগ সংবরণ করে রহীম বলে,
কারণ তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। একবার নিজের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখো, কতো জটিল পদ্ধতিতে এই মানব দেহ ও এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। একজন সুকৌশলী স্রষ্টা ছাড়া এটা সৃষ্টি হওয়া কখনও সম্ভব নয়। দেখো তোমার হাতে যে চায়ের কাপটি রয়েছে যদি কেউ বলে এটি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছে তবে তা কি তুমি তা মেনে নেবে? এই চায়ের কাপটি যদি এমনি এমনি সৃষ্টি না হতে পারে তবে তারচে বহু জটিল এবং অনেক বেশি রহস্যময় এই মানুষ কিভাবে এমনি এমনি সৃষ্টি হতে পারে? যারা এমন কথা বলে তারা কি পাগল নয়?
ভুতো মাথা নাড়ে।
তুমি সত্য বলেছো বটে।
এই সৃষ্টিরাজীর দিকে দৃষ্টি দিলে সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্বের কথা স্বীকার না করে পারা যায় না। কিন্তু আর একটা প্রশ্ন আছে। আমি মেনে নিচ্ছি যে একজন স্রস্ট্রা এসব এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন কিন্তু প্রশ্ন হলো যে স্রষ্টা এগুলো সৃষ্টি করেছেন তাকে কে সৃষ্টি করলো বা তিনি কিভাবে অস্তিত্বে আসলেন। এই প্রশ্নের উত্তর কি তুমি জানো?
রহীম বলে,
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ বাতাস সৃষ্টি করেছেন। এর বেশি তার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
আমরা শুধু তার কাজ সম্পর্কে জানি। তার আনুগত্য করার জন্য তার কাজ সম্পর্কে জানাটাই যথেষ্ট তার বিস্তারিত পরিচয় জানা শর্ত নয়।
ভুতো যেনো সুযোগ পেয়ে গেলো।
যার পরিচয় জানা যায় না তার কাজের কি মুল্য আছে?
ভুতো এই কথা গুলো বলার সাথে সাথেই রহীম কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলছিল ঠিক সেসময় গোরবা চিৎকার করে উঠল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশে গেড়ে রাখা বুক পর্যন্ত লম্বা বাসের খুটিটি তুলে নিয়ে দেহের সবটুকু শক্তি দিয়ে ভুতোর মাথায় আঘাত করলো।
ভুতো বিকট চিৎকার দিয়ে অকুস্থলে কুপকাত হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত জনতা সম্ভিত হারিয়ে ফেলে। ভুতোর দুই ভাই সেখানে উপস্থিত ছিল তারা গোবরার দিকে পা বাড়ানোর সাহস না পেয়ে ভুতোর দিকে মনোযোগ দিল। তাকে টেনে হেচড়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো।
ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর পর্যন্ত গ্রামে টান টান উত্তেজনা বিরাজমান ছিল।
ভুতোর দু-ভাই প্রতিষোধ নেওয়ার জন্য গোরবাকে খুজে বেড়াচ্ছিল। তবে গ্রামের প্রায় সবাই গোরবার পক্ষে ছিল। যা ঘটেছে তার তেমন কিছুই চচ্ছিল। সবাই সতর্ক করে দিয়ে বলল, গোরবার কিছু হলে কাউকে ছাড়া হবে না। যা হবার বিচারের দিন হবে।
এদিকে ভুতোর চিকিৎসাহ চলছিল। সে একটু সুস্থ হয়ে উঠলে ভাইদের সাথে পরামর্শ করে প্রেসিডেন্ট এর কাছে অভিযোগ নিয়ে গেলো। তখনকার দিনে কয়েক গ্রামের উপর একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হতো তাকে প্রেসিডেন্ট বলা হতো। সেসময় বেশিরভাগ মামলা মোকাদ্দমার ফয়সালা স্থানীয়ভাবেই করা হতো। কোর্ট বা থানা পর্যন্ত খুব কম মামলাই নেওয়া হতো।
প্রেসিডেন্ট সাহেব বললেন,
আপনারা ফিরে যান আগামী শুক্রবার গ্রামে এর ফয়সালা হবে আমি হাজির থাকবো।
প্রেসিডেন্ট সাহেবে কথায় তারা গ্রামে ফিরে আসলো।
শুক্রবারদিন যথা সময়ে প্রেসিডেন্ট সাহেব হাজির হলেন। ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ তখনো তিনি জানতেন না। গ্রামের মানুষের মুখে যখন সব কিছু শুনলেন তখন তিনিও ভুতোর উপর বেজায় চটলেন।
মনে মনে নাস্তিককে যোগ্য শাস্তি দেওয়ার সংকল্প করে ফেললেন। ফয়সালা শুরু হলে চারিদিককার সাক্ষে গোরবার অপরাধ প্রমানিত হলো। ভুতোর বাবা ও ভাইয়েরা বারবার অপরাধীর কঠিন শাস্তি প্রার্থনা করছিল। সাধারণ জণগন নিরব ছিল। প্রেসিডেন্ট সাহেব এবার কথা শুরু করলেন,
গোরবা যে বাশের লাঠি দ্বারা চান্দু ওরোফে ভুতোর মাথায় আঘাত করেছে এ কথা কি সত্য?
সাধারণ জণগন যে যার মতো মাথা নাড়লো।
তারা কেউই মিথ্যা কথা বললো না।
প্রেসিডেন্ট সাহেব আবার কথা শুরু করলেন,
ঠিক আছে। গোরবা যে, একাজ করেছে তা তো দেখছি প্রমানিত হয়ে গেলো কিন্তু তার পরিচয় কি? সে কোথা থেকে এসেছে, কিভাবে এসেছে? এস সম্পর্কে তোমাদের কেউ কি কিছুই জানো? সবাই নিরব থাকলো। আসলে তারা কেউ তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। প্রেসিডেন্টসাহেব ভুতোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
তুমি কি এসব প্রশ্নের উত্তর জানো?
ভুতো মাথা নাড়ে অন্যদের মতো তারও গোরবার পরিচয়ের ব্যাপারে কিছুই জানা নেই।
প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেন,
তবে তো তার কাজের কোনো বিচার হতে পারে না। যারা পরিচয় জানা নেই তার কাজের কি মূল্য আছে?
একথা বলে প্রেসিডেন্ট সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। সাধারণ জনগনের মধ্যে উৎসবের আমেজ পড়ে যায়। ভুতো থতোমতো খেয়ে বলে,
হুজুর। তার কাজ যখন প্রমানিত হয়েছে তখন পরিচয়ের কি দরকার।
যে যা কাজ করে বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া না গেলেই কি সে তার প্রতিদান পাবে না?
প্রেসিডেন্ট সাহেব এবার তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেন,
আল্লাহর এই সুবিশাল সৃষ্টিকর্ম ও এই অবদান নিজ চোখে দেখে প্রমান পাওয়ার পরও যারা তিনি কোথা থেকে আসলেন কিভাবে আসলেন এটা না জানা পর্যন্ত তার অবদানের স্বীকার করতে চায় না বা তার আনুগত্য করতে চায় না তাদের মস্তিষ্ক কতখানি বিকৃত তা এবার কল্পণা করে দেখো! এই বিকৃত মস্তিষ্ক সোজা করার জন্য একটা আঘাত জরুরী ছিল গোরবা সেই কাজটিই করেছে সুতরাং তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।