আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধু অমলিন: আনন্দমোহন বসু ও মৌলভী হামিদ উদ্দিন-ময়মনসিংহ ও ইতিহাসের স্বার্থপরতা

বিশ্বটাকে সুন্দর করে সাজানোর জন্যই এত কথা বলি.. । বন্ধু। এখানে নেই রক্তের বন্ধন কিন্তু সর্ম্পক অমলিন, জগতের সেরা। বাংলার ইতিহাস থেকে, অজানা এক বন্ধুত্বের কথা বলবো আপনাদের। অজানা এই কারণে যে, জোর করে ইতিহাস থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এই বন্ধুত্ব।

এক বন্ধু ইতিহাসের অংশ অন্য জনের শুধুই নামটি আছে কোথাও খোদায় করে লেখা নেই। শত বছরের পুরোনো দুই সাথীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো যারা আজ শুধুই স্মৃতি। যারা বাংলাদেশের ইতিহাস সর্ম্পকে জ্ঞান রাখুন তারা ময়মনসিংহের আনন্দমোহন বসুর নাম শুনে থাকবেন, তিনি হচ্ছেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সমাজসংস্কারক ব্যারিস্টার। [link|http://bn.wikipedia.org/wiki/আনন্দমোহন_বসু|আনন্দমোহন বসু বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহেই।

ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। এফএ এবং বিএ পরীক্ষা দেন প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। উভয় পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন। ১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড যান।

সেখানে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা তথা ট্রাইপস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণী লাভ করে প্রথম ভারতীয় র‌্যাংলার হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। [১] ১৮৭৪ সাল থেকে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ] ছবি: আনন্দমোহন বসু। ১৮৯৯ খ্রীঃ আনন্দমোহন বসু কলকাতায় তৎকালীন সরকারী শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

ময়মনসিংহ জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা অনুরাগিতার নিদর্শনে কাজ করেছিলেন তিনিই প্রথম। নিজের অর্জিত টাকায় চালাতেন অনেক গুলো প্রতিষ্ঠান, যেখানে রাজা-জমিদাররাও ছিলেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় বিমুখ। এবার চলুন পরিচয় করিয়ে দিই অখ্যাত বন্ধু মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহাম্মদ সাহেবের সাথে। তিনি ছিলেন ময়মনসিংহের প্রথম মুসলমান গ্রেজুয়েট এবং উকিল। উকালতি পেশার মাধ্যমে সম্মান ও সম্পদের মালিক হয়েছিলেন, তিনিই ছিলেন আন্জুমান ইসলামিয়া'র তৎকালীন সভাপতি।

ময়মনসিংহে মুসলমানদের অধিকার ও ইংরেজদের মুসলমান বিমুখতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। শিক্ষা বিস্তার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখা সত্ত্বেও ইতিহাসে তার নাম পাওয়া যায় নি, ময়মনসিংহের মানুষের উদাসিনতার কারণে। রাজা-জমিদারদের তাচ্ছিল্যতার কারণে। যতটুকু জানা যায়, ময়মনসিংহের অন্যতম প্রবক্তা পুরুষ, ধর্ম পরায়ন মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহাম্মদ ছিলেন শিক্ষানুরাগী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। দুই বন্ধুর একজন ইতিহাসে অম্লান, জায়গায় জায়গায় নাম খোদায় করা কিন্তু অন্যজন অখ্যাত রয়ে গেলেন।

কালের বিবর্তনে ব্যারিস্টার আনন্দ মোহন বসু ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছেন কিন্তু মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহাম্মদ রয়ে গেছেন ইতিহাসের ছাইচাপা আগুনে। দুই বন্ধুই ছিলেন আনন্দ মোহন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই সিপাহশালার। ময়মনসিংহ শহরের হামিদ উদ্দিন রোড মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ এর স্বাক্ষ্য বহন করছে আজও। কিন্তু আজকের প্রজন্ম হইত জানেই না এই হামিদ উদ্দিন কে! এমন কি খুঁজে একটা ছবিও পেলাম না উনার! বন্ধুত্বের শুরুটা হয় কলকাতা কলেজে পড়াশেনা করতে গিয়ে। একই কলেজের সহপাঠী বন্ধু ও ময়ময়সিংহের ছাত্র হিসেবে উভয়ের মাঝে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল।

সময়টা ১৮৭০ সালে যখন বন্ধুত্বের শুরু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে। ময়মনসিংহ শহরে শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন একসাথে। মুসলমানদের শিক্ষায় উন্নয়নে মৌলভী হামিদ উদ্দিন ময়মনসিংহের প্রবাদ পুরুষ। তাদের বন্ধুত্বে ধর্ম কখনও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শহরের সিটি কলেজিয়েট স্কুলকে ১৮৯৯ সালে দুই বন্ধুর প্রচেষ্টায় কলেজে রুপান্তরিত করা হয়।

১৯০৬ সালে আনন্দমোহন বসু পরলোক গমন করলে অচলাবস্থা শুরু হয় ময়মনসিংহের শিক্ষা ব্যবস্থায়। ১৯০৮ সালের মে মাসে কলিকাতার সিটি কলেজ কাউন্সিল কলেজটি তুলে নেয়। ময়মনসিংহের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের চ্ছেদ পরে এর ফলে। নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন প্রিয় বন্ধু হামিদ উদ্দিন। নতুন কলেজের জন্য জমি দিতে রাজি হননি তৎকালিন রাজা-জমিদারগণ, কে কার থেকে বেশি টাকা দিতে পারেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত এবং নিজেদের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত যখন, তখন মৌলভী হামিদ উদ্দিন জমি দেয়ার জন্য সামনে আসেন কিন্তু শর্ত একটায় তা হল, কলেজ হতে হবে আনন্দমোহন বসুর নামে।

প্রিয় বন্ধুর সারাজীবনের র্কীতি অম্লান রাখা মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ এর মতো একজন প্রজ্ঞা সম্পন্ন উদার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্বের কারণেই আজ এটা সম্ভব হয়েছে। আনন্দ মোহন কলেজ প্রতিষ্ঠার আড়ালে যে মানুষটি বন্ধুর অবদান ও ভালবাসার জন্য সেই সময়ে ২৬ বিঘা জমি নিঃশ্চিন্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দিয়ে দিতে পারেন তিনি তো আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়। সে সময় প্রতিষ্ঠানের পাশে জমিদারের জমি নকশাতে পড়ে কিন্তু তারা তা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় হামিদ উদ্দিনের ইঙ্গিতে হুকুম দখল আইনের আশ্রয়ে প্রয়োজনীয় জমি স্থায়ী ভাবে অধিগ্রহন করা হয়। আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুতে ময়মনসিংহের অপুরণীয় ক্ষতির কথা মৌলভী হামিদ উদ্দিন গভিরভাবে অনুভব করতেন যার, বন্ধুর স্মৃতি ও স্বপ্ন পূরণে হামিদ উদ্দিন মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এই যে, কলেজের নামকরন ও প্রতিষ্ঠায় হামিদ উদ্দিনের নাম পাওয়া যায় না, কারণ পরবর্তীতে স্থানীয় একটি মানসম্পন্ন মাসিক পত্রিকায় কলেজ প্রতিষ্ঠা সর্ম্পকে প্রতিবেদন ছাপা হয় যেখানে বন্ধুর জন্য বন্ধুর এমন কাজের কোন কিছুই প্রকাশ করা হয় নি।

এটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল, কারণ তখনকার জমিদার, রাজারা প্রতাপ-প্রতিপত্তি ও ভাবগরিমার সামনে সাধারণ সমাজের মানুষের মহৎ কাজে অবদান রাখার ব্যাপারে তাচ্ছিল্যতা দেখাতো, তারা ইংরেজদের খুশি করতে প্রচার করে দিল, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও তৎকালিন রাজা যোগেন্দ্রকিশোরের নির্দেশে তৎকালিন ঢাকা বিভাগের ব্রিটিশ কমিশনার মি. নেথান এর সম্মতিতে এটি আনন্দমোহন কলেজ নাম করণ করা হয়। ছবি: আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এভাবেই হারিয়ে যায় এক বন্ধুর ভালবাসা ও মহানুভবতার পরিচয় আরেক বন্ধুর জন্য, ইতিহাস থেকে। কিংবদন্তী এই প্রাণ পুরুষ মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ এর কাছে সবিনয় ঋণ স্বীকার করে তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখা। তার বন্ধু, আনন্দ মোহন বসু আজ যদি দেখতে পেতেন তারই বন্ধু মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহাম্মদ এর আনীত প্রস্তাবে তার নামটির পাশে তার বন্ধুর নামটি নেই, তাহলে তিনি কি কষ্ট পেতেন না? আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্ররা জানেনা আসল ইতিহাস, কিভাবে বন্ধুত্বের অবদানে গড়ে উঠেছে এই প্রতিষ্ঠান, কার প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠেছে আজকে দেশের এই অন্যতম বৃহত্তম ও সেরা প্রতিষ্ঠান।

এক বন্ধুর ভালবাসা অন্য বন্ধুর জন্য, আজ হারানো ইতিহাস। এই মহান বন্ধু ও সমাজ, শিক্ষা সংস্কারের ইতিহাস ভুলতে বসেছে ময়মনসিংহ, আমরা চাইতেই পারি এই মহান ব্যাক্তির জন্য কিছু প্রতিষ্ঠা করতে, কোন খোদায় করা নাম আনন্দমোহন কলেজে বন্ধুর নামের পাশে। নতুন করে ইতিহাস লিখে তাতে মহান বন্ধুর অবদান জাতিকে জানাতে। ইতিহাস স্বার্থপরদের আখড়া, সেখানে অনেক কিছুই জোর করে ভুলিয়ে রাখা হয়। আমরা বর্তমান প্রজন্ম খুঁড়ে খুঁড়ে ইতিহাস বের করে এই বন্ধুত্বের স্বীকৃতি দিতে বদ্ধ পরিকর।

দুই বন্ধুর সৌজন্যে আজ বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষার নগরী বলে খ্যাত। তথ্য সুত্র সংগ্রহ: ১. ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন- দরজি আবদুল ওয়াহাব। ২. ‌আনন্দমোহন কলেজ আড্ডা গ্রুপ ৩. ময়মনসিংহের রাজা, মহারাজা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.