সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু আনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।
ছোটোবেলায় ‘কুমির কুমির খেলা’ কত খেলেছি। কমবেশি সবাই মনে হয় খেলেছি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে টিফিন না করেই খেলার মাঠে দৌড় যেখানে বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। সন্ধ্যেবেলা মনে অতৃপ্তি নিয়েবাড়ি ফেরা ।
ইস , বিকেলটা কেন যে আর একটু বড় হয় না। এখন বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হবে। সত্যিই দিনগুলো কি সুন্দর ছিল ! আর আজকাল ছেলেমেয়েরা এসব খেলে না। তাদের আছে কম্পিউটার গেম।
‘কুমির কুমির খেলা’ শিশুরা যেভাবে খেলে :
‘কুমির কুমির খেলা’র ধরণ বা নিয়ম সবারই মনে হয় জানা ।
তবু যারা খেলেনি তাদের জন্য একটু বলি। এই খেলায় একপক্ষ কুমির আর একপক্ষ মানুষ। ছেলেপিলেরা এই খেলার জন্য বেছে নেয় কোনো বাড়ির উঠোন। যেখানে বারান্দা আছে। উঠোনের দু পাশে বারান্দা থাকলে সেটা বেশি মজার।
প্রথমে একজন কুমির হবে। সে থাকবে উঠোনে , নিচে। বাকিরা থাকবে বারান্দায় বা উঁচু জায়গায়। কুমিরকে দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য ছেলেপিলেরা বারান্দা থেকে নেমে এপাশে ওপাশে ছুটে বেড়াবে। কুমির চেষ্টা করবে তাদেরকে ধরার।
আর অন্যেরা চেষ্টা করবে যাতে কুমির তাদেরকে ধরতে না পারে। কুমির তাদেরকে একমাত্র ধরতে পারবে তখনই যখন তারা জলে থাকবে । ডাঙায় উঠে গেলে কুমির ধরলেও ‘মার’ বা ‘মোড়’ হবে না। যদি জলে থাকাকালীন কুমির কাউকে ধরে ফেলে তবে সে মার হয়ে যাবে। কুমির ছুঁতে এলেই খেলুড়েরা ডাঙায় উঠে পড়বে।
আবার অন্য কাউকে ধরতে গেলে অন্য দিক থেকে খেলুড়েরা জলে (মানে ঊঠোনে ) নেমে পড়বে আর কুমিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলবে-
“এক পা জলে
কদমতলে। ”
কিম্বা
‘ও কুমির তোমার জলকে নেমেছি। ’
কুমির এবার এদেরকে ধরতে ছুটে আসবে। এরা আবার ডাঙায় উঠে যাবে । এই জন্য উঠোনের দুদিকে বারান্দা থাকলে খেলার মজাটা ভালো হয়।
তাহলে কুমির সহজে কাউকে ধরতে পারে না। এই ভাবে খেলা চলতে থাকবে।
কিন্তু একা একটা কুমির আর কতক্ষণ পারবে ! তাই খেলাটির আরো বৈচিত্র্য আছে। কুমির যাকে মার বা মোর বা মরা করতে পারবে সেও কুমির হয়ে যাবে এবং এই কুমিরের সাথে সেও অন্যদের ‘মার’ করার চেষ্টা করবে। এইভাবে কুমিরের দলের খেলুড়ের সংখ্যা বাড়বে ।
শেষ পর্যন্ত যে বাকি থাকবে সে হবে পরের দানের(পর্বের) বা খেলার কুমির।
তবে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নিয়ম আছে খেলাটির।
খেলার ভিতরে বাস্তব ইতিহাসের প্রসঙ্গ টানার প্রাসঙ্গিকতা:
খেলা খেলে থাকে শিশুরা। সে যা দেখে তার অনুকরণ করে। এই খেলাটি সম্পর্কেও একই কথা বলা যায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লিপিকা’র ‘বিদূষক’-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ শিশুদের অনুকরণ প্রিয়তার বিষয় দেখিয়েছেন -যার জন্যে শুধু শিশুদেরকেই নয় তাদের মা বাবাদেরকেও চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।
আমি বলতে চাইছি এটাই- শিশুরা যা অনুকরণ করে তা বাস্তবকেই । আদিম মানুষেরাও আসলে মানসিকতার দিক থেকে শিশুই ছিল
খেলার আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা সাধারণ ইতিহাস
এই লোকক্রীড়াটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আদিম সামাজিক লক্ষণ ধরা পড়েছে। সেই আদিম যুগে সমুদ্র , ঝর্ণা বা নদীই ছিল মানুষর একমাত্র জলের উৎস এবং মৎস শিকার সহ অন্যান্য কারণে যখন মানুষকে জলে নামতে হত তখন কুমির সহ নানা রকম হিংস্র জলজ প্রাণির মুখোমুখি তাদেরকে হতে হত।
এই আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা মানুষকে করতে হয়েছে নানা কৌশলে। সমাজের এই ঘটনা ব্যক্ত হয়েছে কুমির কুমির খেলায়।
সাধারণ ইতিহাসের পিছনে আর এক ঈঙ্গিত : সামাজিক বিবর্তন ও দ্বন্দ্ব
তবে এটা একটা সামান্যতম দিক মাত্র। এই লোকক্রীড়ার পিছনে রয়েছে আরো জটিল সামাজিক ইতিহাস। আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে - ইতিহাস মানে কেবল মাত্র রাজ-রাজড়াদের যুদ্ধের কাহিনী নয়, ইতিহাস মানে সমাজ পরিবর্তনের কাহিনী –সমাজ বিবর্তনের কথার ইতিবৃত্ত।
এখানেও সেই সমাজ বিবর্তনের ঘটনা খেলার মোড়কে ধরা আছে।
আদিম মানুষেরা মনে করত তারা কোনো না কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সেই পূর্ব পুরুষকে অবশ্যই তাদের রক্ষা করতে হবে। (লোকসংস্কৃতির ভাষায় এটাকে বলা হয় “টোটেম” ভাবনা। ) এক টোটেম বা গোষ্ঠীর কাছে অন্য টোটেম গোষ্ঠীর লোকেরা স্বাভাবিক ভাবেই শত্রু।
তারা চেষ্টা করত অন্য টোটেমের লোকেরা যেন তাদের ক্ষতি করতে না পারে বা অন্য টোটেমের লোকেদের উপরে তারা প্রভুত্ব কতে পারে। এখানে কুমির টোটেমের (গোষ্ঠির) হাত থেকে অন্য টোটেমের লোকেরা বাঁচার চেষ্টা করছে। কুমির টোটেম কিন্তু বেশ শক্তিশালী এটাও কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। কারণ সে একা এদের সঙ্গে লড়াই করছে , অন্যেরা এর হাত থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
আবার খেলার শেষে যে খেলুড়েটি মোর হতে বাকি থাকবে সে হবে পরের কেলার কুমির।
এর মানে হল দল ছোটো হয়ে গেলে এই কুমিরের মতোই একা একা নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
এই সমাজ বিবর্তনের কাহিনীই আদিম মানুষ বা তাদের শিশুরা খেলার মাধ্যমে তুলে ধরেছে। ইতিহাস খাতা-কলম থেকে হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে । কিন্তু বাচ্চাদের খেলার মধ্যে , লোকক্রীড়ার মধ্যে তা অবিকৃত ভাবে ধরা আছে।
ইতিহাসের আর এক অধ্যায়
এই খেলাটির মধ্যে আরো একটা বিষয় ধরা আছে।
আদিম সমাজে যে দলে বেশি জনসংখ্যা তারা ততবেশি শক্তিশালি। তাই আদিম মানুষ চেষ্টা করত দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। সন্তান উৎপাদন যেমন দলের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর একটা পন্থা তেমনি অন্য পন্থাও তারা অবলম্বন করত। অন্য টোটেম গোষ্ঠি থেকে লোক ধরে এনে নিজেদের গোষ্ঠী ভুক্ত করা হত। এখানেও তেমনি কুমির যাদেরকে ছুঁয়েছে তারা কুমির গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে গেছে।
এখন যে প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবেই মনে উঠে আসে -কাউকে ধরে এনে দলে ঢুকিয়ে নিলেই সে কি নিজের দলভুক্ত হয়ে যাবে মনে প্রাণে ? তা না হবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। কারণ একটোটেম বা গোষ্ঠীর লোকেরা কখনোই বিপক্ষ টোটেমের কাছে হার স্বীকার করতে চাইবে না। তবে জোর করে দাস হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। আর সেটা করলেও কুমির টোটেমের যারা বিপক্ষ তাদের দলের লোকের সংখ্যা কমতে বাধ্য। যার ফলে তার শক্তিহীন হয়ে যাবে।
তবে এক্ষেত্রে সেটা মনে হয় হয়নি।
খেলাটির দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে কুমির যাদেরকে ছুঁয়েছে তার কুমির হয়ে ঐ কুমির গোষ্টীর লোকেদেরকে ঐ খেলার যুদ্ধে সাহায্য করছে। সুতরাং এখানে বিপক্ষ টোটেমকে দাসের মতো ব্যবহার করা হয়নি। যোদ্ধাদের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং উপরের কারণটিকে গ্রহণ করা গেল না।
সম্ভাব্য কারণ হতে পারে -বিপক্ষ টোটেমের শিশুদের ধরে আনা হত এবং প্রথম থেকেই তাদের কে সেইভাবে তৈরি করা হত। যেমন করে এখনকার বিভিন্ন উগ্রপন্থী সম্প্রদায় শিশুদেরকে ধরে এনে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করে সেই ভাবে ট্রেনিং দেওয়ায়।
একটা কথা আছে পৃথিবী থেকে নাকি কোনো কিছুই হারায় না। সত্যিই হয়তো তাই। ইতিহাসের পাতা থেকে যা আপাত ভাবে হারিয়ে গিয়েছে , শিশুদের খেলায় লোকক্রীড়ায় খেলার আঁড়ালে তা সুন্দর করে সাজানো আছে।
শেষের কথা: আপনাদের অনেকের মনে হতে পারে আমি গাঁজাখুরি কিছু মনগড়া কথা লিখলাম এখানে। না আমি এখানে মনগড়া কিছু লিখিনি। এগুলির কোনোটাই আমি আবিষ্কার করিনি। লোকসংস্কৃতির গবেষনায় এগুলো প্রমাণিত। লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্যের একজন ছাত্র হিসাবে পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি এগুলো জেনেছি মাত্র।
কৃতজ্ঞতাতে আমি তথ্যসূত্র উল্লেখ করলাম। উৎসাহী হলে বই গুলো পড়ে নিতে পারেন।
কৃতজ্ঞতা :
***** লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ : পল্লব সেনগুপ্ত
****** বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস : অসীম কুমার দাস
******* বাংলার লোক সাহিত্য : আশুতোষ ভট্টাচার্য
********* দিহান ভাই (কারণ দিহান ভাইয়ের “ছোটবেলায় দেখা রবিনহুডের তীরের কথা মনে আছে? আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি তীর-ধনুকের দুনিয়ায়, আসেন জেনে আসি তীর-ধনুকের ইতিহাস” লেখাটা আমাকে এগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। তীর ধনুকের বিষয়ও লোকসংস্কৃতিতে উল্লেখ আছে। )
*********** এবং আমার স্ত্রী স্বাতী।
********************************************************************
********************************************************************
আমার এই লেখাটি প্রথমে এখানে প্রকাশিত- http://www.techspate.com/sobujer-abhijan/8321/ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।