সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ!
মেঠো পথটার পাশেই ঘন বাঁশের ঝোপ।
ঠিক যে রকমটা আমার দাদা বাড়িতে ছিল। ওপাশটাতে সেজো আব্বাদের বাড়ি করতে জায়গা দিয়েছিলেন আমার দাদা। বাঁশের ঝোপটা যেখানে শেষ হয়েছে তারপরে খোলা মাঠ। এক ফসলি জমি! এত উঁচু যে পানি ধরে রাখতে পারেনা।
বছরে একবার ধান হয়। ঝোপের শেষে দাদীর কবর ওখানে দাদা নিজের হাতে আতার গাছ বুনেছিলেন। দাদা মারা যাবার আগে বলে গেলেন যেন তাকেও সেখানেই কবর দেয়া হয়।
মেঠো পথটা দিয়ে এক জোছনা রাতে আমি যাচ্ছিলাম। এত রাতে আমার এ পথে যাবার কথা নেই।
অথচ গ্রামের ও মাথার একজন হুট করে এই রাতে মরে গেলো। গ্রামটা এমন সব বাড়ির সামনে ছোট খাটো ডোবা। ডোবার পাশে আমের গাছ!
বাঁশের ঘন থোপের ভেতর মাটি কাটা হয়েছে। কি যে তুমুল জোছনা চারপাশে বিলাতি গুড়ো দুধের মত ঝরে যাচ্ছে আজ! ধনুকের মত বাঁকা এ পথটা পার হলেই হয়! অথচ কোথা থেকে সব মৃতরা অদৃশ্য হাতে আমার পিঠ টেনে ধরলো। খুব টেনে নিতে চাইছি পা টাকে! হচ্ছেনা।
কিছুতেই হচ্ছেনা। পেছনে এক চাচী ছিল। বললাম চাচী তোমার ও এমন লাগে? গেঁদি তুই হইলি তুইলা রাশি!
যাহ কি যে বলেননা চাচী! এবার উল্টো পথে ফিরতেই ডোবাগুলো সব ভরা। কেউ কেবল ঝাঁপ দিচ্ছে আর কেউ আগে থেকেই জলে নেমে বসে আছে। এমন দুধেল জোছনায় সব দেখা যায়।
কবর দিয়ে এলে গোসল করে সাফ সুতরো হতে হয়। আমার মনে পড়ে গেল একটু আগেই কিছু আত্মাকে আমি ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। অচেনা সব আত্মা!
আরেকদিনের কথা আমার খুব মনে পড়ছে! এমন বিকেল কচিৎ দেখা যায়। গুঁড়া রোদের বিকেল। মরা পাতার মত অদ্ভুত রঙের বিকেল! মোষের গাড়িতে করে সামনের পথটাকে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম।
উঁচু নিচু মাটির পাহাড়, সদ্য খোঁড়া হয়েছে। কালো আর খয়েরি দু রং এর দুটি মোষ। কিছুতেই এবড়ো থেবড়ো মাটিতে পা ফেলে দ্রুত এগুতে পারছেনা। আমি পেছনে পা দুলিয়ে বসে লেবু পাতা কচলে কচলে ঘ্রান নিচ্ছি। একটু আগেই গাড়ির ভেতর থাকা বয়স্কা কোন রমনী গৃহস্থের বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় ছিঁড়ে নিতে বলেছিলো গাড়োয়ান কে।
সে সুযোগে লেবুপাতা আমিও নিয়েছি হাতে।
তালুতে ঘষে গন্ধ নিলে শুনেছি বিবমিষা দূর হয়! বয়স্কাদের মত আমার অবশ্য তেমন গন্ধের প্রয়োজন নেই। কিন্তু গন্ধ আমি খুব ভালবাসি।
আমাদের বাড়ির উঠানে একটা গন্ধরাজের গাছ ছিলো। আমরা হারিকেনের আলোয় গরমের সন্ধ্যায় উঠোনে পড়তে বসতাম।
বেশির ভাগ সময় কারেন্ট না থাকাটাই ছিল নিয়ম।
আর আমার বড় ভাই একটু দূরের বাথরুমে যেতে চাইতো না। গন্ধরাজের ঝোপটার আড়ালে কাজ সারতে যেতো। আমি লাঠি নিয়ে তাড়া দিতাম।
সেদিন বিকেলে দেখেছিলাম একটা ছায়া তার ঘাড়ে লাঠি নিয়ে লাঠির গোড়ায় পুটলি বেঁধেছে।
আমি দুলতে দুলতে দিব্যি দেখলাম ছায়াটা এগিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা কেউ কি জানে ওরা হাসতে পারেনা?
কাল একটা অদ্ভুত ঘটনা হল। আমরা ক বান্ধবি মিলে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। এমন প্রায়ই হই। একদিন তো স্কুলের ক্লাসে এই ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আরেকজনের মাথা প্রায় ফাটিয়েই ফেলছিলাম।
সে যাই হোক আমাদের স্কুলের সামনেটাতে আবার পেঁয়াজ ফুলের গাছ ছিল । বেগুনি লম্বা ফুল হত পেঁয়াজের মত দেখতে গাছগুলোতে। এক সাথে ছুটির সময় বের হতে গেলে রাস্তার জন্য রাখা বেড়াটুকও ভেঙে ফেলতে চাইতাম আমরা। যা বলছিলাম কাল অন্যরকম একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। এমন না যে সব প্ল্যান করে।
হঠাৎ ই ঘুরতে ঘুরতে হয়ে গেল।
আমাদের কাছে একটা আধ ভাঙা বাইক ছিলো। যাতে চাপানো ছিল আমাদের ব্যাগপ্যাক। মাঝে মাঝে আমরা চালক বদল করছিলাম। ওটা চালাতে হয় হেঁটে হেঁটে।
একটা জায়গায় বেশ কিছু অংশ ছিল সিমেন্ট বালির প্রলেপ মাখানো। কেউ বলছিল পাশ থেকে এটি সেই বালকের জায়গা। যাকে অতিমানব বলা হত যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন। আর মৃত্যুর পর এখানে শুয়ে আছেন। আমার মনে তেমন ভয় ডর বলে কিছু নেই।
জীবিত থাকতে যে মানুষ ভয়ংকর না সে মানুষ মরে গেলে কি করে ভয় দেখাবে। আমি ছিলাম চালক। বাইকটা উঠিয়ে দিলাম কবরের উপর। ইচ্ছে ছিল একটা দূরন্ত রেস খেলে নেব। হলনা।
কিছুতেই চালানো গেলনা। তারপর চুপচাপ নেমে পাশ দিয়ে নিয়ে এলাম বাইকটাকে সামনে। মনে হচ্ছিল হেরে গেছি কোথাও।
যখন চারপাশে ভীষন পাহাড় থাকে, কোথাও একটুকরো সমতল কে খুব শ্রদ্ধা করে মানুষ। ম্যালে এমনটা দেখেছিলাম একসময়।
ওই একটুকরো সমতল এত পবিত্র যে ওখানে মানুষ হেঁটে পার হয়। চালানো সাইকেল অথবা যে কোন যানবাহন থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু এমন পেছনের পিঠ টেনে ধরা আর এই বাইক টা আগাগোড়া থেমে যাবার কি কোন যোগসূত্র ছিল কোথাও।
ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা আমার কোনকালে ছিলনা। ইদানীং কোথাও কোন গন্ডোগোল হয়েছে বোধ হয়।
নতুন দেশটাতে ঢুকতে গেলে টিকিটের বদলে ওরা বলে বিসমিল্লাহ পড়ো। আমার তো এসব সেই ছোটবেলাতেই শেখা। তারপর আলহামদুলিল্লাহিরাব্বিল আলামিন! সকল প্রশংসা সেই রাব্বুল আলামিনের বলে ঢুকে পড়ো এই দেশটাতে। এখানে চটের থলে তে করে চিংড়ির ভাজা বিক্রি হয়। ছোট চিংড়ি আর বড় চিংড়ি আলাদা আলাদা থলে ভরা।
খেতে গেলে অন্য সুরা পড়ো। কিছু সুতি কাপড়ের কাজ দেখলাম হ্যাঙ্গারে ঝোলানো। একশো বিশ একশো আশি কিন্তু এসব দামের শোধ হয়ে যাবে নতুন কোন সুরা শোনালে। কি মুশকিল আমরা কেউই তো এত সুরা শিখিনি।
নতুন জায়গাটাতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
অথচ ফেরার যখন পথ পাচ্ছিলাম না একটা সবুজ রং এর পুরুষ কে বললাম প্লিজ প্লিজ আমাদের ফেরার পথ দেখিয়ে দাও। সে আমার হাত ধরলো। হাতটা ঠিক এমন ভাবে যেন বুকের একপাশটা ছুঁয়ে থাকে। আমার হৃৎপিন্ডের স্পষ্ট আওয়াজ আমাকে ভীত করে তুলছিলো। আমি আলতো করে হাত ছাড়িয়ে বললাম এ রকম দুপাশে চেরী গাছ লাগালো মনোরম রাস্তা আমাদের গাঁয়ের ওদিকে নেই।
হঠাৎ করে দেখি বন্ধুরা নেই। ওদের খুঁজে পাবার জন্য তখন আমার চোখ ভরে আসছিলো জলে।
সিমির সাথে তার একটু আগেই ঝগড়া করছিলাম। ও আর আমার খুব লাগে। টুক কথাতেই আমরা এত চিল্লাতে শুরু করি অন্য সার্কেলের কেউ দেখলে ভাববে বুঝি ঝগড়া।
তার জোড়াটার সাথেও তার এরকম সারাদিন ঝগড়া। সে ভেঙে ফেলবে। আমরা চোখ বড় বড় করে বল্লাম সে কি রে! আল্লাহ তোদের কঠিন শাস্তি দেবে!
সে চোখ বড় বড় করে বললো শাস্তি! তুই জানিস ঐ ব্যাটা ভুল জোড়া তৈরী করেছে এ অপরাধের জন্য কত বড় শাস্তি তাকে দেয়া দরকার। সে বানায়ে বানায়ে গল্প বলায় ওস্তাদ। নিমেষে গল্প বানিয়ে ফেললো।
আমরা হা করে শুনতে থাকলাম। সে হাত নেড়ে নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছিলো। আল্লাতো আকাশ থেকে ধপাস করে পড়ে গিয়ে হাঁটুর ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে ফেরেস্তাকে বলল, কি ব্যাপার? একটু ঘুমিয়েছি আর এর মধ্যেই এমন লন্ড ভন্ড! সিমির জোড়া টা তোমাকে ঠিক করে দিতে বললাম না? কোন কাজ ঠিক মত পারোনা। তোমাকে শোকজ করা হল! যাও ভাগো সামনে থেকে। ওদিকে ইবলিশ দাঁত না মাজা গন্ধ মুখে ভুড়ি দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে।
আর বলছে ব্যাটা নিজেরই জোড়া নাই সে আবার ঠিক জোড়া বানানোর কি বোঝে!
আমি তেড়ে মারতে গেছি ওকে। এসব কথা আর যাই হোক গোপনে গোপনে বলা ভাল। কে জানে কোথায় কে ওঁৎ পেতে আছে!
শেষ মুহূর্তে হঠাৎ আমার মনে হল এবার বোধ হয় আসলেই কোন সিগন্যাল পাচ্ছি তা না হলে এমন অনবরত উদ্ভট আচরন আমার সাথেই কেন হবে! সত্য কি আর বাবল এর মত কিছু যে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলেই নেই! যাই এখন বাবল বানাই...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।