আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুজুগ

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। হুজুগ মোহাম্মদ ইসহাক খান তার হুজুগের শুরু হয়েছিলো একটি বই পড়ে। এক বন্ধু তার জন্মদিনে সুন্দর র্যা পিং পেপারে মুড়ে, লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে একটা ছোটখাটো গল্পের বই উপহার দিয়েছিলো।

প্রিয়জনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার নাকি বই। আদপে সে বই পড়ত না। "পড়ার বই" ছাড়া যে আর কিছু "পড়া" যেতে পারে, সেটাই সে জেনেছে বেশ খানিকটা ডাগরডোগর হবার পর। কিন্তু বন্ধু একটা বই উপহার দিয়েছে, সেটা ফেলে রাখে কী করে? কাজেই সে একদিন খুলে বসলো বইটা। আর তখুনি তার সামনে একটা নতুন দরজা খুলে গেল।

আহা! বই পড়তে এত আনন্দ! দারুণ বই তো! সে ঐ বইটি পড়ে শেষ তো করলই, বই পড়া ভাল লেগে গেছে বলে আরও বই খুঁজতে লাগলো। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো, তার ঘরে গল্পের কোন বই নেই। বেশ অপমানিত বোধ করে সে, নিজের কাছেই। দোকানে চলে যায়। সস্তায় যেকোনো ধরণের বই কিনতে হলে নীলক্ষেতের কোন বিকল্প নেই।

কাজেই সে সেখানে গিয়ে কিনে আনল একগাদা বই। বাংলা এবং ইংরেজি। হালকা সস্তা বই থেকে শুরু করে ঢাউস উপন্যাস, কবিতা, গল্প - যা তার মনে ধরল, প্রথম দেখায়, কোন বাছবিচার না করেই যেটা চোখে লাগলো সেটাই, কখনো প্রচ্ছদ সুন্দর, কখনো ছাপার কাগজ সুন্দর, কখনো লেখকের নাম সুন্দর, কখনো বইয়ের নামটি সুন্দর। বলা বাহুল্য, দাঁও বুঝে কয়েকজন ধড়িবাজ দোকানদারে তাকে বেশ ঠকিয়ে নিলো। কিন্তু ছেলেটি তখন আছে এক আশ্চর্য আনন্দময় ঘোরের ভেতর, তার এসব চোখে পড়বে কেন? তারপর? তারপর সে দরজা লাগিয়ে বিছানায় শুয়ে বই পড়তে শুরু করলো।

কয়েকটা দিন নাওয়াখাওয়া ভুলে শুধু বই আর বই। কত বই যে সে কয়েক সপ্তাহে পড়ে ফেললো, ইয়ত্তা নেই। যতই পড়ে, ততই তার নেশা গভীর হতে থাকে, মন বলতে থাকে, আরও বই পড়া চাই, আরও, আরও। সে ভাল করে চিনল দেশী এবং বিদেশী লেখকদেরকে। রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, হুমায়ূন আহমেদ, এরিখ মারিয়া রেমার্ক, জীবনানন্দ দাশ, শেক্সপিয়র, আগাথা ক্রিস্টি, আলবেয়ার কামু, আন্তন শেকভ, বিভূতিভূষণ, বনফুল, ড্যান ব্রাউন, আইজ্যাক আজিমভ, জিম করবেট, জুল ভার্ন, কাহলিল জিবরান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ওমর খাইয়াম, পরশুরাম, সত্যজিৎ রায়, শরৎচন্দ্র, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সৈয়দ মুজতবা আলী - বাদ গেলেন না কেউ।

বড় আনন্দময় ভ্রমণ ছিল সেটি, এক লেখকের বই থেকে আরেক লেখকের বইতে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো। যে বই পড়ে, সেটাই পড়ে সে মুগ্ধ হয়ে যায়, আহা আহা, মরি মরি, লেখক কি সুন্দর লিখেছেন। এমন কয়েকটা বই পড়ে সে বিহ্বল হয়ে বসে রইলো, লেখকের প্রজ্ঞার তারিফ করতে লাগলো মনে মনে, যেগুলোকে সবাই এক কথায় বলেন "বাজে বই। " কিন্তু তার মস্তিষ্ক তখন এমন স্বাদ পেয়েছে, যা পড়ছে তাই ভাল লাগছে। পিতামাতা ভাবলেন, আহা, ছেলে একটা ভাল জিনিস নিয়ে পড়েছে, থাকুক।

বই পড়া খুবই ভাল। *** বই পড়াতে বিরক্তি এসে যেতে তার খুব বেশীদিন লাগে নি, বড়জোর কয়েক মাস। দিবারাত্রি বই পড়তে পড়তে তার অন্তঃকরণ হয়ে পড়েছিলো ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। তাই তার খোলা জানালা দিয়ে যখন একটা গানের সুর এসে ঢুকল, তখন সে বইটা পাশে ফেলে রেখে জানালার শিক ধরে দাঁড়ালো। আহা, বড় সুন্দর গান।

সেই থেকে তার গান শোনা শুরু। গান যে সে আগে শোনে নি তা নয়। তবে পাগলের মতো গান শোনা এই প্রথম। নিজেকে ধমক দেয় সে, এই মধুর গানগুলো বাদ দিয়ে সে এতদিন খসখসে বইয়ের পাতায় ডুবে ছিল? সহসা সে ঠিক করে ফেলে, পৃথিবীর যত ভাল ভাল গান আছে, তার শুনে ফেলা চাই। গান যোগাড় করতে শুরু করলো সে, দিনরাত দরজা লাগিয়ে উঁচু ভলিউমে শুধু গান আর গান।

সে শুনল শিরোনামহীন, আর্টসেল, লালন; সেই সাথে চিনল মেটালিকা, ভেঙ্গা বয়েজ, লিঙ্কিন পার্ক, টেইলর সুইফটের গান। মানুষ সবরকমের গান শোনে না, একেকজনের একেক রকম পছন্দ। কেউ ধীর লয়ের ধ্রুপদী গান শোনে তো কেউ হার্ড রক। কিন্তু ছেলেটি কোন বাছবিচার করলো না, বই পড়ার সেই সদ্য হারানো শখটির মতোই সে সব গান সমান মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো, আর সবগুলোকেই বলতে লাগলো "দারুণ"। "সুরের ভুবনে হারিয়ে যাওয়া" যাকে বলে।

সমঝদার মানুষজন, শুভানুধ্যায়ীরা এবং বন্ধুরা বলতে লাগলো, ছেলেটি হয় গান ব্যাপারটি বোঝে না, নয়তো তার মাথায় কিঞ্চিৎ গোলমাল আছে। *** এক দিন সে হঠাৎ করেই বন্ধ করে দিলো তার গানের প্লেয়ার। অযাচিত বিশ্রাম পেয়ে অবাকই হল বুঝি যন্ত্রটি। ছেলেটির গান শুনতে আর ভাল লাগছে না। কতদিন ধরে গান শুনেছে সে? বেশীদিন না, কয়েক মাস।

তবে? কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো। সে যোগাড় করেছে একটা গেমের ডিভিডি। আজকের যুগের কমবয়সী ছেলেপুলেদের একটা বড় অংশের নেশা যে কম্পিউটার গেম। বন্ধুকে বলেছিল, ভাল লাগছে না, কী করি বল তো? বন্ধু জবাব দিয়েছে সাথে সাথে, গেম খেলো, ভাল লাগবে। ছেলেটি আবার ডুবে গেল।

এবার কম্পিউটার গেমের জগতে। আহা, কত সুন্দর সুন্দর সব গেম, এতদিন সে কি ভুলই না করেছে, এই চমৎকার সব গেম না খেলে। কোথায় লাগে এর কাছে খসখসে বইয়ের ন্যাকা ন্যাকা গল্প, কোথায় লাগে সর্দি বসা গলায় গাওয়া গান! সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চৌকোণা বাক্সটির সামনে বসে কাটিয়ে দিচ্ছে। সে খেলেছে ফিফা, ফুটবল নিয়ে দৌড়েছে সারা মাঠে, ভার্চুয়াল খেলোয়াড়দেরকে হারিয়ে দিয়েছে নানান কারিকুরি করে। সে খেলেছে কল অফ ডিউটি আর ব্যাটলফিল্ড, যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন হাতে নিয়ে ছুটেছে স্পেশাল সব অপারেশনে, ব্যবহার করেছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র, যাদের দাঁতভাঙা সব নাম; বিকট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছে শহর, নগর, বন্দর।

সে খেলেছে নিড ফর স্পিড, চোখ ধাঁধানো সুন্দর আর ব্যয়বহুল সব গাড়ি নিয়ে ছুটে বেরিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, রেসারদেরকে হারিয়ে দিয়েছে ক্রমাগত, কখনো পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সে কুৎসিত আর ভয়ংকরদর্শন ভূতেদের সাথে লড়াই করেছে ডেড স্পেসে, সে রাজপুত্র হয়ে দেয়াল ধরে তলোয়ার হাতে ছুটে বেরিয়েছে প্রিন্স অফ পার্সিয়াতে। বলা বাহুল্য, এবারও সব গেম সে সমান উপভোগ করছিলো। গেমগুলোর চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স আর রেজুলেশন আজকের যুগে বাস্তব আর কল্পনাকে এক করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ছেলেটির মনে হচ্ছিল, কম্পিউটারের ভেতরে যা হচ্ছে, সেটাই আসল, বাইরের এই ম্যাড়ম্যাড়ে জীবনটি নকল, কল্পনা, স্বপ্ন, অলীক।

এক স্বপ্নময় রাজ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল, সে তাতে সাড়া দিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো, গেম থেকে বেরুনোর আগ পর্যন্ত সে নিজেকে বিবেচনা করতো গেমেরই একটি চরিত্র হিসেবে, ভুলে যেত যে সে একজন রক্তমাংসের মানুষ, সে রাইফেল চালাতে জানে না, গাড়ি চালাতে পারে না, দেয়াল ধরে ধরে চলতে পারে না। একটি মিশন অসম্পূর্ণ রেখে সে রাতে ঘুমুতে যেতে পারতো না। *** ভাল প্রিন্টের একটা মুভি পেয়ে সে গেম খেলাও ছেড়ে দিলো। আরে, এটাই তো আরও ভাল বিনোদন, কোন পরিশ্রম করতে হয় না, চোখ দুটো মেলে রাখা শুধু। আগের তিনটি ক্ষেত্রের মতোই সে সবরকমের সিনেমা নিয়ে পড়লো, কমেডি, ট্রাজেডি, অ্যাকশন, ক্লাসিক, সস্তা, দামী, হালকা, ভারী, গুরুগম্ভীর মেসেজওয়ালা আর্ট ফিল্ম কিংবা মেসেজ ছাড়া সাধারণ, আটপৌরে ফিল্ম।

সে জোয়ান অফ আর্কের সাথে আগুনে পুড়ল, জেমস বন্ডের সাথে এমআই সিক্সের মিশনগুলোতে গেল, কমেডি তারকাদের সাথে মিশে গিয়ে হা হা করে হাসল, হরর মুভি দেখে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে বসে রইলো, সুপারহিরোদের সাতে আকাশে উড়ল এবং পাতালে নামলো। বন্ধুরা বলল, ছেলেটা একটা "মুভি ফ্রিক"। একটা সময় দেখা গেল, সে অনেক মুভি দেখে ফেলেছে, অনেক। আর ভাল লাগছে না। *** গত কয়েক মাস ধরে ছেলেটি এক অবসর থেকে আরেক অবসরে, এক বিনোদন থেকে আরেক বিনোদনে শান্তি আর স্বস্তি খুঁজেছে, পেয়েছেও।

কখনো তাকে দেখা যায় নি যে সে এমনি এমনি বসে আছে কিংবা মন খারাপ করেছে। একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিল সবসময়। একটা কাজ ভাল না লাগলে আরেকটা কাজ ছিল তার সামনে, এক দরজা বন্ধ করে ঢুকেছে আরেক দরজা দিয়ে। সে ভেবেছিলো, এমনি করেই হয়তো চলবে, ছন্দপতন ঘটবে না, সে সবসময় কিছু একটা নিয়ে মেতে থাকতে পারবে। কিন্তু তার অনুমান সঠিক হয় নি।

মনের ওপর তো হাত নেই। এমন কিছু সময় আসে, যখন কিছুই ভাল লাগে না। ছেলেটি এই মুহূর্তে জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সময়টি কাটাচ্ছে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। না বই, না গান, না কম্পিউটার গেম, না সিনেমা, কিছুই না।

খেতে ভাল লাগছে না, ঘুমুতে ভাল লাগছে না। এটা কত দুঃসহ, ভুক্তভোগীই জানে। সে আর সব পারে, কিন্তু একেবারে বেকার হয়ে বসে থাকতে পারে না। (১০ এপ্রিল, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.