পর্ব ১৪
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৬
গত চার পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট ছয়টি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলাম। যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই তিনটি হাদীসই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত।
এই পর্বে আমরা আরও দুইটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব।
সপ্তম হাদীছ( صحيح بشواهده )
হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, শাবানের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক এবং বিদ্বেষী ছাড়া সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।
উক্ত হাদীসটিঃ
১।
ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২। বাযযার তাঁর মুসনাদে
সংকলন করেছেন।
প্রথম মন্তব্যঃ
এই হাদীছ সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ
“ বাযযার তাঁর মুসনাদে এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদে হিশাম ইবনু আবদির রহমান নামক একজন রাবী আছেন। তাঁর পরিচয় আমি জানি না।
এছাড়া অন্যান্য সকল রাবী ছিক্বাহ। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )
দ্বিতীয় মন্তব্যঃ
মাজমাউয যাওয়াদের মুহাক্কিক উক্ত হাদীছে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ
“ এই হাদীছটিকে হিশামের সমর্থন যোগায় মত কেউ বর্ণনা করেন নি এবং হিশাম থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে গালিব হাদীছটি নিয়েছেন। ইবনু গালিব একজন নির্ভরশীল রাবী। ”
তৃতীয় মন্তব্যঃ
হাদীছ পর্যালোচক শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব এ হাদীছের ব্যাপারে মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বলের টীকায় আব্দুল্লাহ বিন আমরের সূত্রে হাদীছটিকে উদ্ধৃত করার পর বলেনঃ حديث صحيح بشواهده অর্থাৎ অন্যান্য হাদীছের পৃষ্ঠপোষকতায় এ হাদীছটি সহীহ বলে সাব্যস্ত। অতঃপর তিনি হাদীছটির সমর্থনে আরো সাতটি হাদীছ পেশ করেন।
এর মধ্যে ষষ্ঠ হাদীছটি হলো আলোচ্য হাদীছটি। অবশেষে তিনি আবু হোরায়রার উক্ত হাদীছ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেনঃ
“ এসব সমর্থিত হাদীছগুলোর প্রত্যেকটির সূত্রে কিছুটা অসুবিধা থাকলেও সব হাদীছের সমষ্টি দ্বারা মূল হাদীছটি সহীহ ও শক্তিশালী হওয়ার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। অতএব আলোচ্য আবু হোরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত আলোচ্য হাদীছ অন্যান্য হাদীছের সমর্থন পাওয়ায় সহীহ বলে সাব্যস্ত। ”
( মুসনাদে আহমদঃ খ-১১, পৃ-৩১৬ )
সার কথাঃ
হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসটিকে একজন রাবীর দুর্বলতার জন্য অনেক মুহাদ্দিসীনগণ একক ভাবে দুর্বল বলেছেন। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী কোন দুর্বল হাদীসের সমর্থনে জন্য অন্য হাদীস থাকে, তাহলে ঐ হাদীসটি আর দুর্বল থাকে না।
তখন দুর্বল হাদীসটি হাসান পর্যায়ে চলে যায় আর তা বর্ণনাও করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীসটির সমর্থনে আবু বকর ছিদ্দীক (রঃ) এর সহীহ হাদীছ, হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর সহীহ হাদীস, হযরত আবু মুসা আশআরী (রঃ) এর হাসান হাদীছ সহ মোট ৮ টি হাদীস পাওয়া যায়। তাই হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী এটি আর দুর্বল থাকবে না, বরং সমষ্টিগত ভাবে সহীহ বা হাসান হয়ে যাবে। তাই তো প্রখ্যাত হাদীস পর্যালোচক আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) এর বিশিষ্ট শিষ্য শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব উক্ত হাদীসটিকে সহীহ ও শক্তিশালী বলেছেন।
উপরন্তু ফাযায়েলে আমালের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য, এতে ইমামদের ইজমা রয়েছে।
তাই এ হাদীসকে বাতিল বলার কোন অবকাশ নেই।
অষ্টম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده )
হযরত আউফ ইবনু মালিক (রঃ) থেকে বর্ণিত, রসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ আল্লাহ তাতালা শা’বান মাসের পনের তারিখ দিবাগত রজনীতে নিজ সৃষ্টিজীবের উপর বিশেষ রহমত প্রকাশ করেন। তাই মুশরিক ও হিংসাকাতর লোক ব্যতীত সকলকে তিনি ক্ষমা করে দেন।
উক্ত হাদীসটিঃ
১। ইমাম হাইছামী তাঁর মাজমাউয যাওয়ায়েদে
২।
বাযযার তাঁর মুসনাদে
সংকলন করেছেন।
হাদীছটির অবস্থান পর্যালোচনাঃ
উক্ত বর্ণনা সম্পর্কে হাফিয হাইছামী বলেনঃ
“ বাযযার হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছের সনদে আব্দুর রহমান ইবনু যিয়াদ ইবনু আনআম রয়েছে। যাকে আহমদ ইবনু সালিহ ছিক্বাহ বলেছেন। অথচ অধিকাংশ ইমাম তাকে দুর্বল বলেছেন।
আর ইবনু লাহীআহ অনির্ভরযোগ্য। অন্যরা সব ছিক্বাহ তথা নির্ভরযোগ্য। ”
( মাজমাউয যাওয়ায়েদঃ খ-৮, পৃ-৬৫ )
সারকথাঃ
উপরোক্ত পর্যালোচকদের মন্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে, উক্ত হাদীছে কেবল মাত্র একজন রাবী দুর্বল। আর ইবনু লাহী’আহ অনির্ভরযোগ্য হলেও অগ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁর হাদীছ তো হাসান। এছাড়া অবশিষ্ট সকল রাবী নির্ভরযোগ্য।
( উল্লেখ্য, ইবনু লাহী'আহ সম্পর্কে যে দুর্বলতার কথা উল্লেখ রয়েছে, তা সহীহ ও হাসান হাদীছের মধ্যে পার্থক্যকারী দুর্বলতা, দুর্বল হাদীস হওয়ার জন্য যে দুর্বলতা, তা নয়। তা আমি আগেই প্রমাণ করে এসেছি। )
যেহেতু হাদীছটি আরো অন্যান্য হাদীছের সহযোগিতা ও সমর্থন পাচ্ছে, সুতরাং হাদীছটি প্রমাণিত বলা যায়। উপরন্ত শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্ব যিনি সময়কালের বিশিষ্ট হাদীছ পর্যালোচক, তিনি মুসনাদে আহমদের টীকায় শবেবরাত সম্পর্কিত হাদীছ এর সমর্থনকারী হাদীছ আখ্যা দিয়ে মোট সাতটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। উক্ত হাদীছটি সপ্তম নম্বরে এনেছেন।
অতঃপর তিনি হাদীছগুলোর উপর যে মন্তব্য করেছেন তা পূর্বে উল্লেখ করেছি। এতে প্রমাণিত হয় যে, এসব হাদীছের সনদের ব্যাপারে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য থাকলেও সবগুলো হাদীছ পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতার মা্ধ্যমে সহীহ ও শক্তিশালী বলে সাব্যস্ত।
আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
উপরে বর্ণিত দুটি হাদীসেরই সনদের দিক থেকে কিছুটা দুর্বলতা দেখা যায়।
কিন্তু হাদীস গুলোর সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীস গুলো হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে।
তৃতীয়ত, হাদীসগুলো কিছুটা দুর্বল হলেও ফাজায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য।
এটি উসূলে হাদীসের অন্যতম একটি নীতিমালা।
অন্যদিকে হাদীসের তাহকিক তথা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সালাফী/আহলে হাদীছ ভাইরা যার সবচেয়ে বেশি ভক্ত, যার কিতবাদি অনুবাদ করে আপনারা প্রচার করে থাকেন, সময়কালের বিশিষ্ট মুহাদ্দিছ নাসিরউদ্দীন আলবানীও (রহঃ) হযরত মুয়ায বিন জাবাল (রঃ) এর হাদীছের পৃষ্টপোষকতায় হযরত আবু হুরায়রা (রঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং একে অপরের সমর্থনে হাদীসকে সহীহ বলেছেন।
পাশাপাশি তাঁর অন্যতম শিষ্য শায়খ শুয়াইব আল আরনাউত্বও উপরে বর্ণিত শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক হাদীসগুলোকে একটিকে সহীহ বা হাসান বলেছেন।
তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন আপনারা বার বার বলেন যে, শবে বরাতের ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বা হাসান হাদীসও বর্ণিত নেই ??
এখন সালাফী বা আহলের হাদীসের ঐসব বন্ধুদের প্রতি দাওয়াত রইল, আপনারা আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। আমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের (রহঃ) অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন না।
একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?
আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
শেষ কথাঃ
যদি অন্যান্য রাতের উপর এ রাতের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই থাকবে, তবে বিশেষভাবে এই রাতের কথা উল্লেখ করারই বা কি প্রয়োজন ? শুধু এই রাতকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই অন্যান্য রাতের উপর এর বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়।
উপরের হাদীসগুলো থেকে স্পষ্টতই এটা প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রে আল্লাহ পাক তাঁর বিপুল সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন। যে রাত্রে আল্লাহ বিশেষভাবে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন, সেই রাতে কাকুতি মিনতি করে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে এটাই স্বাভাবিক।
আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা বা যে কোন দোয়া করার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কোন ভাল আমলের মাধ্যমে দোয়াটিকে শক্ত করা যাতে দ্রুত কবুল হয়। বুখারী শরীফের তিন জন যুবকের কাহিনী হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যারা পাহাড়ের গুহাতে আটকা পড়ে গিয়েছিল। পরে একজনের পরামর্শে প্রত্যেকের ভাল আমল উল্লেখ করে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মুক্ত করেন। তাছাড়া অনেক হাদীসেই নফল নামায পড়ে দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করে দোয়া করা, জিকির আযকার করে দোয়া করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং মধ্য শাবানের এই রাতে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সালাত, যিকির, কোরআন তিলাওয়াত করাও প্রমাণিত হয়।
এরপরও যদি কেউ বলে থাকেন যে, এই রাতে কোন ইবাদত করা যাবে না, তাহলে তা তার নিজের মনগড়া কথা বা প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়।
এজন্যই বহু ইমামগণই এ রাতের নফল ইবাদত করাকে মুস্তাহাব বলেছেন এবং নিজেরাও বেশি বেশি ইবাদতে লিপ্ত ছিলেন। যেমনঃ ইমাম শাফিঈ, ইমাম নববী, ইমাম বাযযার, ইমাম উকায়লী, ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সহ আরও অনেকে যার বিবরণ সামনে আরও আসবে ইনশাল্লাহ।
অতএব, যারা এ কথা বলে থাকেন যে, শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই, এর ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই, তারা রসূলের (সঃ) হাদীসের নামে মিথ্যাচার করেন এবং উম্মতকে রসূল (সঃ) এর সুন্নত ও নেক আমল থেকে দূরে সরে রাখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই।
এরকম একটি ফযীলতপূর্ণ রাত পেয়েও যে ইবাদতে কাটাতে পারল না, সে চরম দুর্ভাগা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
এই আয়াত থেকেই বুঝা যায়, আমাদের বেশি বেশি ইবাদত করা প্রয়োজন। উপরন্তু যদি ফযীলতপূর্ণ রাত পাওয়া যায়, তাহলে বেশি বেশি ফযীলত পাওয়ার জন্য ঐ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পর্ব ১৫
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৭
গত কয়েক পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট আটটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলাম।
যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসগুলোই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত।
এই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব।
নবম হাদীছ( حديث صحيح بشواهده واسناده مر سل جيد )
কাসীর ইবনু মুররাহ আল হাযরামী থেকে বর্ণিত, হুযুর (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা শাবানের পনের তারিখ রাত্রি অবতরণ করতঃ মুশরিক এবং হিংসাপরায়ণ লোক ছাড়া অন্যান্য সকলের গুনাহ মাফ করে দেন।
উক্ত হাদীছটি
১। ইবনে আবী শাইবা তাঁর মুসান্নাফে
২।
হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসান্নাফে
৩। ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে
৪। হাফেয মুনযিরী তাঁর তারগীব ওয়াত তারহীবে
সংকলন করেছেন।
হাদীছটির সূত্রের অবস্থানঃ
শুয়াবুল ঈমানে বর্ণিত সূত্রে রাবীগণের ব্যাপারে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য নিম্নরূপঃ
১। রাবী আবুল হাসান বিন ফযল আলকাত্তান।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলঃ
খতীব বাগদাদী ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলী এবং হাফিয যাহাবীসহ অনেকেই তাকে নির্ভরযোগ্য ও বহু হাদীছের বর্ণনাকারী হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
( তারীখে বাগদাদ )
২। আবু সাহাল বিন যায়াদ আল কাত্তান।
তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য হলোঃ
হাফেয যাহাবী এবং খতীব বাগদাদী তাঁর ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী বলে মন্তব্য করেছেন।
( তারীখে বাগদাদ; সিয়ারু আলামিন নুবালা )
৩।
ইসহাক ইবনে হাসান আল হারবী।
তাঁর সম্পর্কে হাফেয যাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ বিন হাম্বল এবং ইবনু হাজার আসকালানী সকলেই বলেছেনঃ
ثقة حجة
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ও দলীলরূপে সাব্যস্ত।
( দেখুনঃ মীযানুল ইতেদালঃ ১/১৯০ )
৪। আফফান বিন মুসলিম আল বাসারী।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে মুঈন আবু হাতিম এবং ইবনু হাজার মন্তব্য করেনঃ
اصحاب الحديث ثقة ثبت متقن
অর্থাৎ বড় মাপের মুহাদ্দিছ, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, অতি মজবুত।
৫। আব্দুল ওয়াহিদ বিন যিয়াদ।
তাঁর সম্পর্কে ইবনে সাআদ আবু হাতিম, আবু যুরআ এবং ইবনে হাজার বলেনঃ
ثقة
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য।
৬। হাজ্জাজ বিন আরত্বাত্ব।
তাঁর সম্পর্কে আবু যুরআ বলেনঃ
صدوق يدلس
অর্থাৎ সত্যবাদী তবে তাদলীস করেন।
আবু হাতিম বলেনঃ
صدوق يدلس عن الضعفاء يكتب حديثه
অর্থাৎ সত্যবাদী, তাদলীস করেন তবে তাঁর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য।
( তাহযীবুল কামাল )
ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, হাজ্জাজ ইবনে আরত্বাত্ব ইমাম মাকহূল থেকে হাদীছ শুনেছেন। বহুক্ষেত্রে তা স্পষ্টভাবে
سمعت مكحولا
বলে উল্লেখ করেছেন।
( দেখুনঃ তারীখে বাগদাদ )
ইমাম নাসাঈ মন্তব্য করেছেনঃ তিনি তেমন মজবুত নন।
ইবনে হাজার বলেনঃ সত্যবাদী তবে অনেক বেশি ভুল করেছেন।
সময়কালের হাদীছ পর্যালোচক শায়খ আল আরনাউত্ব তাঁর ব্যাপারে মন্তব্য করেনঃ
তিনি সত্যবাদী, হাদীছ বর্ণনায় উত্তম ব্যক্তি, তাদলীস করেন, سمعت বা حدثنا না বললে সে বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হয় না, তাঁর ব্যাপারে বেশি ভুল করার মন্তব্য অতিরঞ্জিত।
( তাহরীর তাকরীবুত তাহযীবঃ ১১১৯ )
৭। মাকহূল (রহঃ)। প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিছ।
তিনি সর্বসম্মতিক্রমে
ثقة فقيه تابعى كثير الارسال
নির্ভরযোগ্য, ফিক্বহের ইমাম, তাবেয়ী ও তার ইরসাল করা প্রসিদ্ধ।
হাদীছটির অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনাঃ
হাফিয মুনযিরী হাদীছটিকে আততারগীব ওয়াত-তারহীব এ এনেছেন, তিনি বলেনঃ
“ বাইহাকী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এটি একটি চমৎকার মুরসাল হাদীছ। হাদীছটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত আছে। মাকহূল তা বর্ণনা করেছেন। আবু ছা’লাবাহ (রঃ) থেকে সেটিও চমৎকার মুরসাল হাদীছ।
”
সারকথাঃ
হাদীছটি মুরসাল, তবে গ্রহণযোগ্য, উত্তম মুরসাল। মুরসাল হানাফী ও মালেকীদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য। جيد (উত্তম) হলে তো আরো ভাল কথা। তাছাড়া এ হাদীছটি বহু হাদীছের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য ও আমলের ক্ষেত্রে সঠিক বলে সাব্যস্ত।
আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
উপরে বর্ণিত হাদীসটিই মুরসাল হাদীস এবং উত্তম মুরসাল ।
যা হানাফী ও মালেকী ইমামদের নিকট এমনিতেই গ্রহণযোগ্য, উপরন্তু শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাবের মুরসাল হাদীস মানার পিছনে যে শর্ত আছে, তাও পূরণ করে।
তাছাড়া হাদীসটার সমর্থনে আরও অনেক হাদীস থাকায় উসূলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী এই হাদীস গুলো হাসান বা সহীহের পর্যায়ে চলে আসে।
তাই আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন আপনারা বার বার বলেন যে, শবে বরাতের ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বা হাসান হাদীসও বর্ণিত নেই ??
এখন সালাফী বা আহলের হাদীসের ঐসব বন্ধুদের প্রতি দাওয়াত রইল, আপনারা আল্লামা ইবনে তাইমিয়্যা (রহঃ), শায়খ আলবানী (রহঃ) এর গবেষণা ও সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। আমি ওই সব ভাইদের কাছে বিনীতভাবে আরজ করতে চাই যে, আপনারা যদি শায়খ ইবনে বাযের (রহঃ) অনুসরণে বা নিজেদের তাহ্কীক মতো এই রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করতে পারেন তাহলে যারা উপরোক্ত মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অনুসরণে উল্লেখিত হাদীসটির ভিত্তিতে এই রাতের ফযীলতের বিশ্বাস পোষণ করেন এবং সব ধরণের বেদআত রসম-রেওয়াজ পরিহার করে নেক আমলে মগ্ন থাকার চেষ্টা করেন তারাই এমন কি অপরাধ করে বসলেন যে, আপনাদেরকে তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে? এবং এখানকার উলামায়ে কেরামের দলীলভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য একটি মত যা ভুলের সম্ভাবনার উর্ধ্বে নয়, তা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করে তাদেরকে আলেম-উলামার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আস্থাহীন করা এবং বাতিলপন্থিদের মিশন সফল করতে সহায়তা দেওয়া কি সত্যিকার অর্থেই খুব বেশি প্রয়োজন? এতে তো কোন সন্দেহ নেই যে, আপনারা আপনাদের মতটিকে খুব বেশি হলে একটি ইজতেহাদী ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাযুক্তই মনে করেন এবং নিশ্চয়ই আপনারা আপনাদের মতটিকে একেবারে ওহীর মতো মনে করেন না। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন, এরপর আপনাদের এই অবস্থানের যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা আর থাকে কি না?
আপনাদের প্রতি আমার সর্বশেষ অনুরোধ এই যে, দয়া করে এ রাতের ফযীলত ও আমল সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) [মৃ. ৭২৮ হিঃ] এর ইক্তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম/৬৩১-৬৪১ এবং ইমাম যায়নুদ্দীন ইবনে রজব (রহঃ) [মৃ. ৭৯৫] এর লাতায়েফুল মাআরেফ ১৫১-১৫৭ পড়ুন এবং ভেবে দেখুন যে, তাদের এই দলীলনির্ভর তাহকীক অনুসরণযোগ্য, না শায়খ ইবনে বায (রহঃ) এর একটি আবেগপ্রসূত মতামত? যা হয়ত তিনি শবে বরাত নিয়ে জাহেল লোকদের বাড়াবাড়ির প্রতিকার হিসেবেই ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু এ কথা স্পষ্ট যে, বাড়াবাড়ির প্রতিকার কোন বাস্তব সত্য অস্বীকার করে নয়; বরং সত্য বিষয়টির যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
যদি অন্যান্য রাতের উপর এ রাতের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই থাকবে, তবে বিশেষভাবে এই রাতের কথা উল্লেখ করারই বা কি প্রয়োজন ? শুধু এই রাতকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মাধ্যমেই অন্যান্য রাতের উপর এর বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়।
উপরের হাদীস থেকে স্পষ্টতই এটা প্রমাণিত হয় যে, এ রাত্রে আল্লাহ পাক তাঁর বিপুল সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন। যে রাত্রে আল্লাহ বিশেষভাবে ক্ষমার ওয়াদা করেছেন, সেই রাতে কাকুতি মিনতি করে তাঁর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়া, তওবা করা বা যে কোন দোয়া করার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল কোন ভাল আমলের মাধ্যমে দোয়াটিকে শক্ত করা যাতে দ্রুত কবুল হয়।
বুখারী শরীফের তিন জন যুবকের কাহিনী হতে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যারা পাহাড়ের গুহাতে আটকা পড়ে গিয়েছিল। পরে একজনের পরামর্শে প্রত্যেকের ভাল আমল উল্লেখ করে দোয়া করলে আল্লাহ তাদের মুক্ত করেন। তাছাড়া অনেক হাদীসেই নফল নামায পড়ে দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করে দোয়া করা, জিকির আযকার করে দোয়া করা ইত্যাদির প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং মধ্য শাবানের এই রাতে আল্লাহর পক্ষ হতে বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে সালাত, যিকির, কোরআন তিলাওয়াত করাও প্রমাণিত হয়। এরপরও যদি কেউ বলে থাকেন যে, এই রাতে কোন ইবাদত করা যাবে না, তাহলে তা তার নিজের মনগড়া কথা বা প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়।
এজন্যই বহু ইমামগণই এ রাতের নফল ইবাদত করাকে মুস্তাহাব বলেছেন এবং নিজেরাও বেশি বেশি ইবাদতে লিপ্ত ছিলেন। যেমনঃ ইমাম শাফিঈ, ইমাম নববী, ইমাম বাযযার, ইমাম উকায়লী, ইমাম তিরমিযী (রহঃ) সহ আরও অনেকে যার বিবরণ সামনে আরও আসবে ইনশাল্লাহ।
অতএব, যারা এ কথা বলে থাকেন যে, শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই, এর ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই, তারা রসূলের (সঃ) হাদীসের নামে মিথ্যাচার করেন এবং উম্মতকে রসূল (সঃ) এর সুন্নত ও নেক আমল থেকে দূরে সরে রাখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই।
এরকম একটি ফযীলতপূর্ণ রাত পেয়েও যে ইবাদতে কাটাতে পারল না, সে চরম দুর্ভাগা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কারণ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ
আমি জ্বীন ও ইনসানকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।
এই আয়াত থেকেই বুঝা যায়, আমাদের বেশি বেশি ইবাদত করা প্রয়োজন। উপরন্তু যদি ফযীলতপূর্ণ রাত পাওয়া যায়, তাহলে বেশি বেশি ফযীলত পাওয়ার জন্য ঐ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পর্ব ১৬
হাদীছের আলোকে শবে বরাত - ৮
গত কয়েক পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট নয়টি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোকে সহীহ বা হাসান প্রমাণ করেছিলাম। যদি শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে আর কোন হাদীস না থাকত, তবে এই হাদীসগুলোই এ রাতের ফযীলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত।
এই পর্বে আমরা আরও একটি হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করব এবং সাথে সাথে এই হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনদের মতামত পর্যালোচনা করব।
দশম হাদীছ( اسناده ضعيف )
উছমান ইবনু আবিল আস নবী করীম (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেনঃ যখন শা’বান মাসের পনের তারিখ রাত আগমণ করে তখন জনৈক আহবানকারী আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করতে থাকেন যে, আছো কি কোন ক্ষমার ভিখারী তাকে আমি ক্ষমা করে দিবো? আছো কি কোন যাচনাকারী যাকে আমি দান করবো? অতঃপর যে কেউ চায় আল্লাহ তাআলা তাকে তাই দান করেন। কিন্তু ব্যভিচারিনী এবং মুশরিক ছাড়া।
উক্ত হাদীছটি ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে সংকলন করেছেন।
উক্ত হাদীছের সনদ সম্পর্কে পর্যালোচনাঃ
১।
উক্ত হাদীছটি ইমাম বাইহাকী আলী ইবনু মুহাম্মদ ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু বিশর থেকে বর্ণনা করেন।
যার সম্পর্কে খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ
“ তিনি সত্যবাদী, নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ”
( তারীখে বাগদাদঃ খ-১২, পৃ-৯৯ )
২। আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনু আমর আর রাযযায (মৃঃ ৩৩৯ হিঃ)
যার সম্পর্কে হাকেম বলেনঃ
“ তিনি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। ”
( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-১৫, পৃ-৩৮৬ )
খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ
“ তিনি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য ছিলেন।
”
( তারীখে বাগদাদঃ খ-৩, পৃ-১৩২ )
৩। মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আর রিয়াহী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)
যাঁর সম্পর্কে ইমাম দারা কুতনী বলেনঃ
“ তিনি সত্যবাদী। ”
খতীব আল বাগদাদী বলেনঃ
“ আমি তাঁর সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনু আহমদকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি বলেছেনঃ মুহাম্মদ সত্যবাদী। ”
( তারীখে বাগদাদঃ খ-১, পৃ-৩৭২ )
৪। জামি ইবনুস সবীহ আর রমলী
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ
“ তাঁর সম্পর্কে আব্দুল গণী ইবনু সাঈদ মুশতাবিহ এর মধ্যে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন তিনি একজন দুর্বল রাবী।
এবং ইবনে আবী হাতিম স্বীয় গ্রন্থ আল জরহি ওয়াততাদীলে যাকে উল্লেখ করে কোন আলোচনা ও সমালোচনা করেন নি এবং বলেছেন যে তাঁর থেকে ইমাম আবু যুরআ ও ইবনে মাঈন হাদীছ গ্রহণ করেছেন। ”
( খ-১, পৃ-৫৩০ )
( উল্লেখ্য যে, ইবনু আবী হাতীম কারো ব্যাপারে চুপ থাকলে ঐ রাবী নির্ভরযোগ্য বলে সাব্যস্ত হয়। )
৫। মারহূম ইবনু আবদিল আজীজ
হাফিয ইবনু হাজার তার সম্পর্কে বলেছেনঃ
“ তিনি অষ্টম স্তরের একজন নির্ভরযোগ্য রাবী। ”
( তাক্বরীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-১৬৯ )
ইমাম আহমদ, নাসাঈ, ইবনু মাঈন প্রমুখও তাঁকে ছিক্বাহ বলেছেন।
হাফিয যাহাবী, ইবনু হিব্বানও তাঁকে ছিকাহ এর মধ্য থেকে বিবেচনা করেছেন।
৬। দাউদ ইবনু আবদির রহমান আল আততার
তাঁর সম্পর্কে আবু হাতিম বলেছেনঃ
“ তিনি গ্রহণযোগ্য। একজন নেককার ছিলেন। ”
( তাহযীবুল কামালঃ খ-৮, পৃ-৪১৫ )
যাহাবী (রহঃ) বলেনঃ
ثقة তিনি নির্ভরযোগ্য।
ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন বর্ণনা করেন যে,
তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন।
হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেনঃ
তিনি ছিকাহ রাবী।
৭। হিশাম ইবনু হাসসান আল আযদী
তাঁর সম্পর্কে হাদীছ পর্যালোচকদের মন্তব্য সমষ্টিগতভাবে নিম্নে পেশ করা হলঃ
হাফিজ ইবনু হাজার, উছমান বিন আবী শায়বা, ইবনে হিব্বান, ইমাম আবু হাতিম, ইবনু মঈন, আল আজালী, ইবনু সাআদ, ইবনু আদী প্রমূখ ইমামদের দৃষ্টিতে তিনি নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী বহু হাদীছের বর্ণনাকারী ছিলেন।
( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-৩৩; জরাহ ওয়াত তাদীলঃ খ-৯, পৃ-৫৪ )
তবে ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) তার সম্পর্কে বলেনঃ
“ হিশাম হাসান বসরী এবং আতা থেকে যেসব হাদীছ বর্ণনা করেছেন, সেগুলোর ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণ প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ হিশাম হাদীছের মধ্যে ইরসাল (রাবী এর নাম উল্লেখ না করা) করতেন।
তাই মুহাদ্দিছগণ মনে করেন, হিশাম এসব হাদীছ হাওশাব এর কিতাব থেকে নিয়েছেন। (সরাসরি আতা ও হাসান থেকে নেননি। ) ”
( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১১, পৃ-৩৫ )
ইবনু আদী বলেনঃ
“ আরআরা বলেনঃ আমাকে জারীর বলেছেনঃ আমি সাত বছর যাবৎ হাসান বসরী (রহঃ) এর দরসে বসেছি। কিন্তু হিশামকে কখনো তাঁর সাথে দেখিনি। আমি (আরআরা) বললামঃ হে আবু নাসর (জারীর)! হিশাম তো আমাদেরকে হাসান বসরী (রহঃ) এর সূত্রে বহু হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
আর আমরা হিশাম থেকে বর্ণনা করেছি। সুতরাং আপনার ধারণা মতে হিশাম এসব হাদীছ কার নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন? জারীর প্রতি উত্তরে বললেনঃ আমার ধারণা মতে তিনি হাওশাব থেকে গ্রহণ করেছেন। ”
( সিয়ারু আলামিন নুবালাঃ খ-৬, পৃ-৩৫৫; মীযানুল ইতিদালঃ খ-৪, পৃ-২৯৫ )
পর্যালোচনাঃ
অতএব, ইমাম আবু দাউদ (রহঃ) এবং আরআরা (রহঃ) কর্তৃক উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা বুঝা যায় যে, হিশাম ইবনু হাসসান সরাসরি হাসান বসরী (রহঃ) থেকে হাদীছ বর্ণনা করেননি। বরং মাঝখানে আরো একজন রাবী আছেন, হিশাম যাঁর নাম তাঁর সনদে উল্লেখ করেন নি। হাদীছ শাস্ত্রের পরিভাষায় এটাকে তাদলীস বলা হয়।
আর মুহাদ্দিছীনে কেরামের কাছে সিকাহ (ثقة) রাবী এর তাদলীছ গ্রহণযোগ্য।
যথা তাদরীবুর রাবী ও কাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছ গ্রন্থে এ নীতিমালা উদ্ধৃত হয়েছে যে,
“ বাযযার এর ভাষ্যমতে ছিকাহ রাবীগণের মধ্য থেকে কেউ তাদলীস করলে তাঁর তাদলীস উলামাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। ”
( তাদরীবুর রাবীঃ খ-১, পৃ-২২৯; ক্বাওয়ায়িদ ফী উলূমিল হাদীছঃ পৃ-১৫৯ )
৮। হাসান ইবনু আবিল হাসান আল বাসরী
তিনি একজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ
তিনি হযরত আলী (রঃ), হযরত তালহা (রঃ) এবং হযরত আয়শা (রঃ) এর সাক্ষাত লাভ করেছেন।
সওবান (রঃ), আম্মার ইবনে ইয়াসির (রঃ), উসমান ইবনু আবিল আস (রঃ) এবং মা’কাল ইবনু সিনান (রঃ) প্রমূখ থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের থেকে শ্রবণের মর্যাদা লাভ করেন নি।
আজলী তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ হাদীছ বিশারদগণের মন্তব্য এরকমঃ
“ আল আদাভী বলেন, সকলেই এই শায়খ অর্থাৎ হাসানের নিকট যাও, হাদীছ গ্রহণ কর, তিনি সবচেয়ে বড় আলেম। তিনি বসরাবাসীদের শায়খ (ইমাম), তিনি তাবেঈ, নির্ভরযোগ্য বুজুর্গ, হাদীছের বাহক। ”
( জরাহ ওয়াত তাদীলঃ খ- ৩, পৃ-৪০; তাবকাত; তাহযীবুত তাহযীব )
এসব দ্বারা প্রমাণ হয় তিনি কত বড় আলেম ও ছিক্বাহ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছ।
তবে তাঁর ব্যাপারে দুটি মন্তব্য ব্যতিক্রম যা নিম্নে পেশ করা হলোঃ
১। বাযযার তাঁর মুসনাদে এ বলেনঃ
“ হাসান বসরী তিনি ইবনু আব্বাস, আসওয়াদ, উবাদা এবং উছমান থেকে শ্রবণমর্যাদা লাভ করেন নি। ”
( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-২, পৃ-২৩৫ )
২। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ
“ হাসান বসরী একজন ছিক্বাহ রাবী, প্রসিদ্ধ ফক্বীহ। তিনি ইরসাল ও তাদলীস করতেন।
”
( তাহযীবুত তাহযীবঃ খ-১, পৃ-২০২ )
পর্যালোচনাঃ
বাযযার এবং হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) এর উক্ত মন্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ইমাম হাসান বসরী (রহঃ) উছমান উবনু আবিল আস থেকে হাদীছটি সরাসরি বর্ণনা করেন নি। বরং তিনি তাদলীস করেছেন। তবে হাসান বসরী (রহঃ) যেহেতু একজন নির্ভরযোগ্য হাদীছ বর্ণনাকারী, ফিক্বহ-হাদীছের ইমাম এবং একজন সুপ্রসিদ্ধ তাবিঈ, তাই তাঁর কৃত তাদলীস গ্রহণযোগ্য হবে। হাদীছটির প্রমাণে কোন অন্তরায় হবে না তা তাদরীব ও কাওয়ায়েদ ফী উলূমিল হাদীছ-এ সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
৯।
উছমান আবিল আস আস সাক্বাফী
তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। হযরত মুআবিয়া (রঃ) এর খেলাফতকালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
হাদীছটির অবস্থানঃ
উল্লেখিত বিবরণ দ্বারা একথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত হাদীছটির সনদে জামী ইবনুস সাবীহ আর রামালী ব্যতীত সকল রাবীই নির্ভরযোগ্য ও আস্থাযোগ্য। হাদীছটির সনদের মাত্র একজন রাবী আছেন, যিনি বিতর্কিত হেতু কেউ কেউ যঈফ বলেছেন। ইবনু আবি হাতিম চুপ থেকে তার নির্ভরযোগ্যতা প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু এই হাদীছের সমর্থনেও যেহেতু আরো হাদীছ বিদ্যমান, বিধায় হাদীছটি উন্নীত হয়ে হাসান স্তরে পৌছে যায়। একারণেই শুয়াবুল ঈমানের মুহাক্কিক আদনান আব্দুর রহমান اسناده حسن বলে সূত্রের দিক থেকে হাদীছটিকে হাসান বলে রায় প্রদান করেছেন।
( দেখুন শুয়াবুল ঈমানঃ খঃ ৩, পৃ – ৩৮৩ )
তবে শুআবুল ঈমানে মুহাক্কিক শাইখ যাগলুল এর মন্তব্য হলোঃ
“ হাদীছটির সনদ দুর্বল। হাসান বসরী তাবেঈ এর সাক্ষাত উসমান বিন আবিল আস (রঃ) সাহাবীর সাথে হয়নি, (মাঝখানে রাবীর উল্লেখ নেই। ) ”
( হাশিয়াহ শুয়াবুল ঈমান )
এ ব্যাপারে تدريب الراوى এবং قواعد فى علوم الحديث এর উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রমাণ হয় যে, হাসান বসরীর মত বিখ্যাত তাবেঈ ও মুহাদ্দিছ এর এধরণের তাদলীস সূত্র বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অন্তরায় নয় বরং তা সকল উলামার নিকট গ্রহণযোগ্য বিধায় এ হাদীছকে হাসান বা সহীহ বলে যে মন্তব্য আদনান আব্দুর রহমান করেছেন তা যথাযথ এবং সঠিক বলে সাব্যস্ত।
আহলে হাদীস/সালাফী ভাইদের কাছে প্রশ্ন ও দাওয়াতঃ
অতএব, যারা এ কথা বলে থাকেন যে, শবে বরাতের কোন ভিত্তি নেই, এর ফযীলত নিয়ে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত নেই, তারা রসূলের (সঃ) হাদীসের নামে মিথ্যাচার করেন এবং উম্মতকে রসূল (সঃ) এর সুন্নত ও নেক আমল থেকে দূরে সরে রাখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন চক্রান্তকে আমরা ধিক্কার জানাই।
পর্ব ১৭
গত কয়েক পর্বে আমরা শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত মোট দশটি হাদীস উল্লেখ করে সেগুলোর কয়েকটিকে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।