আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোছনা সে দণ্ডিত আলো

যতোক্ষণ শ্বাস আছে ততোক্ষণ কাজ যে কখনো পিছু ছাড়বে না, এতো জানা কথা। কিন্তু মনতো মানতে চায় না—তাড়াহুড়া লাগে, দিলের মধ্যে হাপর ওঠে এবং এই করতে করতে এক সময় ফাপর লেগে এলে বুকের ছাতিটা ফুলে ওঠে। ভরা গাঙ্গে জোয়ারের জলের মতো কাজের পরিসীমা তখনও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তবুও কাজের সাথে পাল্লা দিয়ে বিকেল থেকে নেউটের মতো লেগে থাকা বৃষ্টিটা সন্ধ্যার পর আরও ঘনিয়ে এলে সেদিনের মতো সানেকা নিস্তার পায়। ‘নিস্তার পায়’ শব্দটা এক্ষেত্রে যুতসই হলো কি না তাও ভাববার বিষয়।

কেননা, মুরগির কুঠিতে খিল এঁটে, গরুর বাছুরটা জল বাঁচিয়ে পিড়ের এক কোনে বেঁধে আরেক কোনে বৃষ্টির দিকে চোখ করে বসতেই ফেলে রাখা তালপাতাটার নিচে চুপসানো জড়োসরো মুরগির বাচ্চাগুলো ওর নজরে আসে। ছোটো বাচ্চা পথ চিনে কুঠিতে যেতে পারেনি, তাড়াতাড়ি উদ্ধার না করলে বাঁচবার আশা নেই। কিন্তু এরকম ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে আর কিই বা করার আছে? এতো সাধারণ কথা। কিন্তু যে জীবন সানেকার, যে জীবন অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে থাকার, তাতে সাধারণ বলে কোনো ব্যপার সাধারণত থাকে না। ওদের সব ব্যাপারই হয় অসাধারণ।

আর হয় বলেই সানেকা ভিজতে ভিজতে বাচ্চাগুলো তুলে আনে। সবটা পারে না, একটা চেঁচাতে চেঁচাতে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আর পাবার আশা নেই, হোলাব্যাঙ-এর পেটে যাবে। ফলে একদিকে সবে ডাগর হয়ে ওঠা আস্ত একটা মুরগির বাচ্চা হারাবার শোক অন্যদিকে অসময়ে আধাভেজা হয়ে ওর মেজাজটা যায় খারাপ হয়ে। এখন সারারাত এই ভেজা কাপড়ে থাকতে হবে, ঘরে আর কাপড় নেই।

গুড়িকে কতোদিন ধরে বলছে, তার যেন গায়েই লাগে না। ‘ইদিকে মরদগুলান সব ছিড়া কাপুড়ের ফুট্যায় চোক লাগায়্যই থাকে’। ওইসব লোকের সেই বেহায়া দৃষ্টির কথা মনে পড়তেই মেজাজটা যেন আরও চিড়বিড়িয়ে ওঠে। ‘জাউরা মরদডা আইজক্যা আর আসপে ন্যা বোদয়, ঠিক কুন ঢেমনির তালে পড়িচে। হামাক একখান কাপুড় দিব্যার পারে না, আর ঢেমনির জাগাত ঠিকই ঢইলব্যার পারে’।

সানেকা মনে মনে স্বামীকে গাল দেয়। আবার গরিবের মাঝেও যে নিদারুণ গরিব সেই অসহায় স্বামীর সামর্থের কথা মনে হলে খারাপও লাগে। ক্ষোভটা তখনও যায় না, কেননা অন্যদিনের চেয়ে এদিন একটু আলাদা। আজ সে ভালো-মন্দ রান্না করেছে। কলমি শাকের ভাজির সাথে চ্যাঙ মাছের থুকথুকি।

মানুষটা এলে সে সামনে বসে খাওয়াবে, সে আশায় পথ চেয়ে আছে সারাদিন। অথচ সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও এখনো সে ফেরেনি। তাই ওর এতো অভিমান। না! মাছ কিনবার পয়সা ওদের নেই। দুএকদিন হয়তো কিনতে পারে, কিন্তু টাকা নষ্ট করবার সে বাতিক হয়নি কোনোকালেই।

হাজির পুকুরে ভেসে উঠেছিল, আর জঙ্গলে প্রাতকালিন কাজ সেরে পানি খরচ করতে গিয়ে ‘আন্দার আন্দার’ থাকতেই চোখে পড়েছিল বলেই কি-না, ‘ভোদার তালেত পড়লে দুন্যার কতা খিয়্যাল থাকে’? রাগে গজগজ করতে থাকে সানেকা। তারপর চোখ কচলে বড়ো বড়ো করে শরীরটাকে প্রশ্নবোধক চিহ্নর মতো বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঠোপথে বৃষ্টির ঝাঁক খলবলিয়ে নাচে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসে, পৃথিবীর মুখ বিবর্ণ দেখায়। তখনও গুড়ির আসার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। ফলে আরও ঘনিভুত অভিমানের আঁচে মনের তাওয়া বেশ খানিকটা তপ্ত হলে সে খটমট করে হাঁড়ি-পাতিল বের করে।

ঘুমিয়ে পড়া ছেলে কালুকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে তুলে এনে খেতে বসায়। আরো কিছুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না দেখতে পেলে শেষ পর্যন্ত সে ভাত তুলে দেয় কালুর মুখে। চোখ থেকে ঘুম ভালো করে কাটেনি বলে কালু কিছু খেতে চায় না, ভাত চিবুতে চিবুতে এলিয়ে পড়ে। সানেকা ওর মুখে আবার ভাত গুজে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বাপের রাগ গিয়ে পড়ে ছেলের উপর।

ভাদ্রের তাল পড়ার মতো ধপাধপ চাপড় মারে পিঠে। আবার মুখে ভাত গুজে দেয়। এবার ঘুমে নয় কান্নার দমকে কালু হা করতে পারে না, এক লোকমার পুরো ভাত মুখ গলে বাইরে পড়ে। সানেকা আর নিজেকে সংযত করতে পারে না, হাড়িসুদ্ধ ভাত উঠোন ভর্তি বৃষ্টির ছড়িয়ে পড়ে। এতোসব কা- করে সানেকার ভাত খাওয়ানোর প্রচেষ্টা থামে কিন্তু কালুর আকাশ ফাটাবার বিরতি নেই।

আধাঘণ্টা মতো সে সমান তালে চিৎকার করে চলে। সানেকা একবারও থামাবার চেষ্টা করে না। লাভ নেই, ‘ছেলে হয়েছে বাপের লাকানই গোঁয়ার, শরীলের তাকত ফুরালে এমনিই থামবে’। অন্যদিন হলে তাও দুএকবার চেষ্টা করতো কিন্তু আজ মেজাজের নাই ঠিক। ঠিক থাকেই বা কি করে! সকালের পচা মাছ, বিকেল হতে হতে প্রায় গলেই গিয়েছিল।

দুপুরেই রান্না করা যেত; করেনি মানুষটা খেতে পাবে না বলে। অবশ্য তাতে ক্ষতি কিছু ছিল না, মাছ যতো পঁচে, থুকথুকি ততো সুস্বাদু হয়। খালি আধখান পিয়াজ আর খানদুই অতিরিক্ত মরীচ দিয়ে ‘চুকুমুকু’ করলেই হলো। পিয়াজ অবশ্য সোনাকি বেশি দিতে পারেনি, ছিল না। ওর বড়ো মেয়েটা ‘বিয়্যান বেলা’ কোত্থেকে যেন এক কোঁচা কাঁচা ‘গামচি’ চুরি করে এনেছিল।

ফলে মরীচ দুইখানের জায়গায় চারখান দিতে বাঁধেনি। এতে ঝাল যে একটু বেশি হবে সেকথা ঠিক, কিন্তু ঝাল বেশি হলে চোখ মুছতে মুছতে আঁশটে-পঁচা-গন্ধটা আর টের পাওয়া যায় না, মুখে ধরেও ভালো। এই মরীচের প্রসঙ্গ এসে পড়াতে বড়ো মেয়েটার কথা মনে পড়ে সানেকার। মেয়েটা বেরিয়েছে সন্ধ্যার আগে এখনো ফিরবার নাম নেই। ‘মাগি আবার না প্যাট বাদায়্যা বসে’।

সানেকার ভয় হয়, ‘কয়দিন আগে পঁচুর ব্যাটা গায়ে হাত দিচিল’। শুনে নিজের মেয়ের গালেই কষে একটা চড় বসিয়েছে সে। ‘অমন হারামীর কাচে গেচু ক্যান?’ এই তার ক্ষোভ। ‘সেই মাগির নাকি শরম আচে। কুন নাঙ্গের বাড়িত বস্যা আচে কে জানে?’ সানেকা রাগে গোখরা সাপের মতো ফোঁপায়।

সন্দেহ নেই এগুলো মায়ের ক্ষোভের কথা, তবুও আজকাল সে তার মেয়েকে সন্দেহও করতে শুরু করেছে। না করে উপায় কী! যে কেউই ভালো করে নজর দিলে বুঝবে—ছোট্ট একটা মেয়ে ষোল-সতেরোর বেশি বয়স হবে না, এর মধ্যেই শরীর ভাঙতে শুরু করেছে, ‘দুদ যেন্ আর দুহাতেও বেড় ল্যায় না। ‘ই-তো ভালো লক্ষণ লয়, আসুক আইজ’ বিড়বিড় করে এসব বলতে বলতে আর রাগে তড়পাতে তড়পাতে সানেকা ছড়ানো থালাবাটি হাঁড়িপাতিল সব গোছগাছ করে। ওদিকে একটানা চেঁচাতে থাকা কালু নিস্তেজ হয়ে কাতরায়। এতোক্ষণে কোত্থেকে একটা ডাগর কলাপাতা মাথায় দিয়ে আধাভেজা হয়ে বাড়ি ফেরে গুলবদন।

আঙিনায় পড়ে থাকা ভাঙা হাড়ির কানাটা হাতে করে সে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। গুলবদনকে দেখেও না দেখার ভান করে সানেকা আস্তে আস্তে চুলার ছাইকাঠিটা হাতে নেয়। শপাং করে একটা বাড়ি মারে পিঠে। মায়ের আকস্মিক এই আক্রমনে গুলবদন প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও সানেকা দ্বিতীয় বাড়ি মারার আগেই সে হাতের পাতা ফেলে দিয়ে একদৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। পেছন থেকে সানেকা চিৎকার করে, ‘ক্যা পলালু ক্যা, আয় কেমন ছেচা করি’।

গুলবদন আসে না, ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ গোখরা সাপের মতো ফোপাতে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের জল বৃষ্টির সাথে মিশে গড়িয়ে পড়ে। তারপর কাঁদতে কাঁদতেই সে পেছনের পথ ধরে। সে যে চলে যাবে সানেকা তা ভাবতেই পারেনি, তাই অপেক্ষাকৃত কোমল স্বরে সে ডাকে, ‘খবরদার জাইস ন্যা। ঘুরত আয় কনু।

’ কালুও মায়ের সাথে কণ্ঠ মেলায়, ‘ভনি যাইয়ো না। বটতলা জিন আচে, অক্ত খাবে, তখন হামি কানমু কনু, আইসো। ’ মায়ের স্নেহমাখা আহ্বান কিংবা কালুর ক্ষীণকণ্ঠ গুলবদনের কানে পৌঁছে কি-না বোঝা যায় না। জলে থপথপ শব্দ তুলে সে চলে যায়। অনেক্ষণ গুলবদনের গমন পথের দিকে তাকিয়ে থেকে তার আজকের মতো ফেরার সম্ভাবনা ব্যর্থ হলে সানেকার মুখে খিস্তির খই ফোটে।

বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজকেও ছাপিয়ে ওর খিস্তির শব্দগুলো পাড়াময় ঝড় তোলে। আশপাশের ঘরে ঘরে নারী-পুরুষেরা নাক সিটকায়। তবে খুব একটা গা করে না। এটা সানেকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, ওদেরও বেশ সয়ে গেছে। এভাবে চিৎকার করে খিস্তি করতে করতে গলা ধরে এলে সানেকা কিছুক্ষণ থামে, তারপর হাত নেড়ে, তারও উচ্চারণে বাঁধে এমন কিছু অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে।

আর কালু, এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে। সানেকা আবার চিৎকার করতে চায়, পারে না। চালের নড়বড়ে খুঁটিটা ধরে কোঁকায়। তারপর ওয়াক করে একগাল বমি করে ফেলে। তারপর অনেক্ষণ পেট মোচড়ায়, ‘মরার বমি হয়ও না’।

তারপর কিছু বিরতি দিয়ে আবার, এভাবে বারবার পেট মোচড় দিয়ে উঠলেও সামান্য তিতা রস ছাড়া আর কিছুই যখন বেরোয় না, ঠিক তখনই যেন তেপান্তরের মাঠ চিরে তপ্ত বালুর উত্তাপ বয়ে নিয়ে আসা একটা গরম দমকা বায়ু ওকে ছুঁয়ে যায়। রাজ্যের গরম শরীরে ভর করে, কি যেন একটা সাপের মতো সিরসিরিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পা হয়ে ওর বুক পর্যন্ত উঠে যায়। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে যায় সানেকার, একটা চিৎকার করার জন্য সে প্রাণপণ চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না। পাতিহাসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় তখন সে মিণতি করে, ‘যা, সর, হামাক ছাড়, হামি তুর কী করিচি। পেল্লায় পেল্লায় দুদ-কলা দিচি, যেটি বসপু সেটি লেপাপুঁচা করিচি, হামার কালু এতিম হবি, হামাক মাফি দে।

সাত মোরগের অক্ত খাওয়ামু, দুদ-কলা-সন্দেশ, পিন্দনের লাল শাড়ি দিমু, দয়া কর। ’ সানেকা নিস্তার চায় সাতবেড়ে বটগাছের বুড়ো জিনের কাছে। এই জিন এ জনপদের সমান বয়সী, বটগাছটাও বুঝি তাই। কিন্তু কতো যে তার বয়স, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে যেন তেন প্রসঙ্গেই এই গাছ ওদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।

শুধু তাই নয়, আশ-পাশের দশগ্রামে এই গাছকে কেন্দ্র করে এক ধরনের মিথও গড়ে উঠেছে! আল্লা-রাসুল-ঠাকুর-দেবতা ডাকে সবাই, কিন্তু যে কাজ আল্লা কিংবা ভগবানেরও অসাধ্য তার ভার ওরা দিয়ে যায় সাতবেড়ের বুড়ো জিনের কাছে। নিজেরা যদিও তিনবেলা খেতে পায় না, তবুও অমাবস্যা-পূর্ণিমার পেল্লায় নিয়মিত দুধ-কলা-সন্দেশ পায় বুড়ো জিন। এর কখনো বত্যয় ঘটে না। কখনো কখনো আবার দূর গ্রামের কোনো খুব কৌতুহলী মানুষও আসে এই গাছ একবার দেখবে বলে। কী তার আকার! নিচে দাঁড়ালেই গা ছমছম করে।

আগন্তুকের আগ্রহের মাত্রা তখন বেড়ে যায়, বিস্মিত হয়ে সে হয়তো জিজ্ঞেস করে, কতো বয়স এই গাছের? তা ধরেন পাঁচ-সাত হাজারের কম না। বেশিও হইতে পারে। বলেই লোকটা সমর্থনের আশায় আগন্তুকের চোখের দিকে তাকায়। আগন্তুকও মাথা নাড়ে। যে দূর-দূরান্ত থেকে একটা গাছ দেখতে আসে, সে এরকম কথা বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত হয়েই আসে।

কম বললেই যেন তার আশাভঙ্গ হতো। এমনটি হয়, মিথিক্যাল ব্যাপারগুলোতে গ্রামের লোকজন কথার তাল ঠিক রাখতে পারে না। ওরা বিশ্বাস করে, এক জিন নাকি এই গাছে সওয়ার হয়ে আকাশ পথে যাচ্ছিল। হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে এই জায়গা তার ভালো লেগে যায়। তাই তখন থেকে এখানেই সে থাকে।

এবং তখন থেকেই এখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের সে সঙ্গী হয়ে যায়। লোকে তাকে ভয় ও ভক্তি দুই-ই করতে থাকে। ধীরে ধীরে ভক্তির ভার উবে গিয়ে থাকে শুধু ভয়। কেননা, এই জিন রুষ্ট হলে যার উপর রুষ্ট হয় তার রক্ত খায়, শুকিয়ে মেরে ফেলে। আর মরতে চায় কে? তাই মাসের এই সময়টা অশুচি থাকায় এবং ঠিক এ সময়ই ভরা বর্ষায় গায়ে গরম বাতাস লাগায় সানেকার মনে হয়, জিন বুঝি এবার ওর গায়েই ভর করলো।

তাই সে অমন কাকুতি মিনতি করে। কিন্তু তাতে গায়ের জ্বালা একটুও কমে না। কহরের জ্বালার মতো বুকের ভেতর জ্বলে যায়। গা ঘেমে ওঠে। মাথা ঝিমঝিম করে।

সে পিড়ার আধা ভেজা মাটিতেই চিৎ হয়ে শুয়ে আঁচল দিয়ে মুখে-চোখে বাতাস করতে থাকে। পা ভাঁজ করে দুহাতে কাপড় ধরে বারবার ঝাড়ে, গায়ে বিছা উঠলে যেমন হয় তেমনিভাবে। তারপর এদিক ওদিক গড়াগড়ি যায়। এভাবে অনেকক্ষণ গড়াগড়ি করার পর একটু বুঝি আরাম পায়। নড়াচড়াও যায় থেমে।

মায়ের এসব কা- দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে থাকে কালু। কিছুক্ষণ পর বার কয়েক ঝাকিনি দেয়। ‘মা, মা’ বলে ডাকে। সানেকা নড়ে না, জবাবও দেয় না, সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান হারিয়ে সানেকা যে জগতে যায় সেও একটা জগৎ বটে।

সেখানে ভাব থাকে, অনুভূতি থাকে, প্রকাশের ভাষা থাকে না। চেনা জগতের সাথে সমস্ত সম্বন্ধ ছিন্ন হলে তবেই সে জগত স্পষ্ট হয়, তাতে পূর্ণপ্রবেশের নিশ্চয়তা আসে। সে জগতে প্রবেশ করে সানেকা কী যেন এক ভয়ঙ্কর মহাশক্তির হাত থেকে রেহাই পায়, অনন্ত নৈঃশব্দের গভীরে ঢুকে যায় ধীরে ধীরে। ক্লান্তিটা তখনও থাকে, যেন সদ্য সাত মাইল হেঁটে এসে সবে শুয়েছে। পা নড়ে না, হৃদপি- অবস, নিজেকে হওয়া হাওয়া লাগে, মনে হয় সে বুঝি প্রাচীন কোনো পোড়োবাড়ির মেঝেতে অনন্তকাল ধরে শুয়ে আছে, একা।

কতো বছর জেগে থাকার ক্লান্তি শরীরে নিয়েই সে জেগে ওঠে দুশ বছর আগের পৃথিবীতে। কোহেকাফি কিংখাবের অভিজ্ঞতার প্রান্ত ছুঁয়ে চারপাশে সে একবার তাকায়, একটিও মানুষ নেই। যেখান থেকে সে এসেছিল সেখানেও না, এখানেও না। একবার জাগার কথা মনে আসে, কিন্তু ভরসা পায় না। জাগবে যে, তা কোন আগামীর জন্য।

সেখানে কি আর হুরমুত নেই? এসব ভাবতে ভাবতে সানেকা আরও গভীর থেকে গভীর নৈঃশব্দের অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। গুলবদন তখনও এসে পৌঁছায় না। তাই কালুকেই মায়ের মাথার কাছে বসে থাকতে হয়। অন্যসময় হলে সে চিৎকার করে কাঁদতো, কিন্তু একটু আগে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে চিৎকার করার শক্তি ওর হারিয়ে গেছে। হয়তো সে ভাবে, ‘মা হ্যার সাতে মরা-মরা লাটক করিচ্চে’।

সে বেশ মজা পায়। ওদিকে সানেকার জ্বর আসে, জ্বর বাড়তে থাকে, ফঁসফঁস করে নিঃশ্বাস নেয়। কিন্তু এসব কোনোকিছুই কালুর কাছে গুরুত্ব পায় না। এসব সে বোঝে না। মাত্র চার বছর বয়স।

বুঝবার সময় হয়নি। ফলে ওর করারও কিছু থাকে না। অবশ্য গুলবদন থাকলেও লাভের লাভ কিছু হতো বলে মনে হয় না। পাড়ার সবাই তাকে ‘হুসে কম’ বলে জানে। সে এসব বুঝতো না।

গুড়ি থাকলেও যে কতোটা লাভ হতো তাও বলা মুশকিল। সেও হুসে খানিকটা খাটো। সবাই বলে, ‘বড়ো মেয়েটা পেয়েছে বাপের গুণ’। কিন্তু গুড়ির বাপ তো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ছিলো! আর গুড়িও আর দশজনের মতো স্বাভাবিক ভাবেই জন্মেছিল, বেড়েও উঠছিল সেভাবেই। তাহলে? এখানে একটা ঘটনা আছে...।

গুড়ির যখন সাত-আট বছর বয়স তখন একদিন সে লক্ষ করে যে, ওর মা ওকে লুকিয়ে প্রতিদিন কি একটা খায়। সে খেতে চাইলে দেয় না। ‘কিছু না’ বলে পাশ কাটিয়ে যায়। সবসময় কেমন একটা গোপন গোপন ভাব বজায় রাখতে চেষ্টা করে। খুঁজতে খুঁজতে গুড়ি একদিন মায়ের সেই লুকানো জিনিসটা পেয়ে গেলে একপাতা জন্মবিরতিকরণ পিল পুরোটাই একসাথে খেয়ে মাথা ঘুরে বটতলায় পড়ে থাকে সারারাত।

তখন থেকে সেই মাথা ঘোরাটা অদ্যাবধি আর ভালো হয়নি ওর। নামটাও বদলে গেছে তখনই। বাপ বড়ো সখ করে নাম রেখেছিলো আব্দুর রাজ্জাক। মায়ের মাকড়ি বেঁচা টাকায় জোড়া খাসি কেটে রাখা নাম, গুড়ো বড়ি খেয়েছিল বলে লোকমুখে হয়ে গেলো গুড়ি। মাথামোটা খেতাবটাও তখনই পাওয়া।

এই ‘মাথামোটা’ শব্দটা সকলের মুখে শুনতে শুনতে সে নিজেকে মাথামোটা বলেই জানে এবং এখন পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে কথার সত্যতা বহন করে চলে। এমনি করে সত্য মিথ্যায় মিলিয়ে জীবনটা ওর চলছে তো—থেমে তো নেই। তার খানিকটা দৈব, খানিকটা নিজের কীর্তি, আর বাঁকিটা পাঁচ জনে গড়ে দেওয়া। সব মিলিয়ে জীবনটা ওর বহুবিধ জোড়াতালিতে ভরা—সত্যের এবং অসত্যের, সংগ্রামের এবং কোনোমতে টিকে থাকার। গতর খাটাতে বুদ্ধি লাগে না বলে, সে মহিষের মতো খাটতে পারে।

আর ভালো-মন্দের বিচার-বুদ্ধি কম বলে অপেক্ষাকৃত ঝুকিপূর্ণ কাজও সে করে যায় অনায়াসে। ফলে মনিবরা ওকে পছন্দ করে খুব। সারাবছর জাহাজঘাটে পড়ে থাকে সে। সেখানে মাল ওঠানো নামানোর কাজ করে। বাড়ি থেকে জাহাজঘাট মাইল দশেক দূরে হওয়ায় প্রতিদিন বাড়ি আসা সম্ভব হয় না।

সপ্তাহে একবার আসে। বৃহস্পতিবার বিকেলে এসে, শনিবার সকালে চলে যায়। শুক্রবার কাজ বন্ধ থাকে বলেই কি-না বউ-ছাওয়ালে মুখ দেখতে পায় গুড়ি। ওর সাথে আর যারা কাজ করে তাদের ব্যাপার স্যাপার অবশ্য আলাদা। তারা ওর মতো প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যায় না।

দরকার হয় না। জাহাজঘাট এমন এক জায়গা, এখানে ভাসমান আবর্জনার মতোই অনেক মেয়ে ভেসে বেড়ায়—নানা বর্ণের, নানা বয়সের। আর এদের সবার হাতেই কাচা টাকা, ফলে বৃহস্পতিবার রাতে তাদের যে কাউকে ডাকলেই আসে। সেদিন তাড়িগিলে লোড হয়ে ওরা অচেনা এক নারীর উপর চড়াও হয়। যদিও সপ্তাহে যা আয় তার একটা বড়ো অংশ ওদের এখানেই খরচ হয়ে যায়, তাতে কী? জীবনের যতো ক্লেদ তার কিছু অংশ ওরা যেন ঢেলে দিতে চায় অচেনা এক বহুগামিনীর জীর্ণ গর্ভে।

এতে বুকের ভার হয়তো হালকা হয় খানিকটা। কিন্তু গুড়ি ওদের সঙ্গে একই সাথে দিনের কাজ করলেও কখনো রাতের কাজে যোগ দেয় না। ইচ্ছে যে করে না তা নয়। সামর্থে কুলায় না। আবার সানেকাকে বড়ো ভয় করে সে।

ওর কাছে পাই-টু-পাই হিসেব দিতে হয়। কামাইপাতি যা করার গুড়িই করে এ কথা ঠিক, কিন্তু সংসারটা মূলত সানেকাই চালায়। তাই দুপুরে খাওয়ার সময় যখন ওরা রাতের বিষয়টা নিয়ে কথা বলে, সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। কখনো ওদের এসব কথা শুনে ওর মেজাজ খুব খারাপ হয়, আবার কখনো ভালোও লাগে। অচেনা এক নারীর নতুন জায়গার নতুন পরশ মনে মনে নিজের অঙ্গে অনুভব করে ওর পুরুষত্বের জায়গায় কাতুকুতু লাগে।

আবার ভীষণ লজ্জাও লাগে ওর। লজ্জা পেয়ে সে এদিক ওদিক তাকায়। ওর মনে হয়, সবাই ওর চিন্তাটা ধরে ফেলেছে বুঝি। তখন মাথা নিচু করে সে গোগ্রাসে ভাত গিলতে থাকে। খেতে খেতে ওর বাড়ির জন্য মনটা কেমন করে।

বউ-এর কালো কুচকুচে মুখটা মনে করে বারকয়েক চুমু খায়। বাড়িতে গেলে কোনো কোনো দিন রাতে শুয়ে সেই মেয়ের গল্পও করে সানেকার কাছে। খুব ছোট্ট করে হয়তো ক্ষোভের সুরেই বলে, ‘হ্যার মতুন গায়ের বাসনা তুর গায়ে নাই, যাই কস তাই কস সানেকা’। সানেকা এবার ফোঁস করে ওঠে, ‘তুমি ক্যামনে জানলা, তুমি ঐ মাগির সাতে থাকো না কি’? না, কি কস! তামানে কয়। মুকের কতাত বাসনা টের পাও! সরো হামার কাছেত থে।

আগ করচ্চু ক্যা? হামাক তু চিনিস ল্যা? মরদ মানষেক বিশ্বেস আছে। ল্যাড়া কুত্তার চেয়ে হ্যারা হারামি। কতাত থিনি বাসনা পাও, কানাক হাইকোট দেকাচ্চো লা? না রে বিশ্বাস কর। থও দিনি, কতা কবা না, কালক্যাই হামি বুকচা বাইন্দ্যা বাপের বাড়িত হাটা দিমু। একথা বলেই সানেকা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

এতোদিনের এতো পরিশ্রমের সংসার ওর কাছে বৃথা মনে হয়। তারপর আদর করতে উদ্দত গুড়ির হাত ছুড়ে ফেলে সে পাশ ফিরে শোয়। এই বউয়ের মুখ মনে পড়লে গুড়ি আর কাজে মন লাগাতে পারে না। বার বার মনে হয়, ‘বিশ্শোদ ব্যার আসে না ক্যান’? বৃহস্পতিবারে কাজ শেষ করে আর কিছু নয় সোজা বাড়ির পথ ধরে। এবং প্রতিবারই বাড়ি আসবার পথে অনুসন্ধানি শকুনের মতো বাজারে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকায়, বউ-বাচ্চার জন্য কিছু কিনতে মন চায়।

অবশ্য সে চাওয়ার বহর আহামরি কিছু নয়, কালুর জন্য খানদুই চমচম, আলতা বানুর তিলের খাজা। ‘আহা মাইয়াটা খাজা ভালোবাসে খুব’। গুলবদন পছন্দ করে চিট। আর সানেকার জন্য বেশি করে খয়ের দিয়ে একটা মিষ্টি পান কিনবে ভাবে। ‘খয়্যারের অঙ্গে ওট লাল হলি সানেকাকে বড়ো সোন্দর দেকায়’।

কিন্তু সাহস পায় না। এতে হাড়ভাঙা খাটুনির টাকা জলের মতো খরচ হয়। তার উপর আবার এইসব বাজে খরচ সানেকা একদম সহ্য করবে না, সারা পাড়া মাথায় তুলবে। কোনো ধানাইপানাই শোনার পাত্রী সে নয়। ঊনপঞ্চাশের ভয়ানক ঝড়ে মাজাভাঙা কচি কলার পাতাটা দেহ থেকে আলগা হয়ে ঝুলে থাকা ভাঙা হাতের মতো বাতাসে দুলতে দুলতে পিঠে একটা কষে চাপ্পড় বসালে বাপের থাপ্পড়ে তাঙ্কা হারানোর মতো গুড়ি ধড়মড়িয়ে নড়ে চড়ে বসে।

মনে পড়ে রাত অনেক হয়েছে, এখন বাড়ি যাওয়া দরকার। বৃষ্টিতে আটকা পড়ে বড়ো মসজিদের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিল সে। সেখানেই দুই কুড়ি পাঁচ বছরের জীবনের খসড়া হিসেবে করতে গিয়ে পুরোটাই খেই হারিয়ে ফেলে—কোথায় কিভাবে শুরু, যেতে চেয়েছিল কোথায়, আর কোন পথ দিয়ে যে এসে দাঁড়িয়েছেই বা কোথায়, ঠিক যেন ঠাহর করতে পারে না। গুড়ি যখন বাড়ি ফেরে সানেকার ততোক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু শরীর এতো দুর্বল যে এতো দেরি করে আসার পরও গুড়ির কোনো জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না।

বরং বউ-এর সাথে দেখা করেই গুলবদনকে সে খুঁজতে যায়। পায় না। কার বাড়িতে যে আছে মেয়েটা, গুড়ি হদিস করতে পারে না। ‘যার বাড়িতই থাউক সক্কালে ঠিকই আসপিনে, চিন্ত্যা করিস ন্যা’, বউকে সান্তনা দিতে গিয়ে ধমক খয় গুড়ি। গুড়িকে ধমকাবার জন্যই বুঝি সানেকা কিছুক্ষণের জন্য গলার জোর ফিরে পায়।

তারপর কিছুক্ষণ খিস্তি প্রতিখিস্তিপর্ব চলে। সবশেষে দুজন ঘুমাতে যায়। দুজন বলাটা সমীচিন হলো না, তিনজন। গুড়ি সানেকা আর কালু। আলতাবানু মামার বাড়ি গেছে।

ও বাড়ির থাকলে গুলবদনসহ মোট পাঁজজন লোক ঘুমায় এই এক ঘরে। ওদের আর ঘর নেই। আবার এ ঘরও ঠিক ওদের বলা যাবে না। হুরমুতউল্লার বাপ গুড়ির বাপকে থাকার জন্য এই একটা ঘর তোলার জায়গা দিয়েছিল কয়েক যুগ আগে। আজ আর হুরমুতের বাপও নেই গুড়ির বাপও না।

হুরমুত এখন প্রতিদিনই এদের তাড়াতে চায়। ওর বউ বাচ্চারা সবাই মিলে যাচ্ছেতাই বলে গালি দেয়, লাঞ্চনার একশেষ করে। কিন্তু চোখ কান বন্ধ করে তবুও এরা এখানেই পড়ে থাকে। উপায় কী, যাবে কোথায়? তবুও আর বেশিদিন থাকা যাবে বলে মনে হয় না। হুরমুতের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে একথা গুড়ি বুঝতে পারে সকালেই।

ওদের ঘুম ভাঙার আগেই হুরমুত গুড়ির বউকে বার কয়েক গোসল করায়। গুড়ি চোখ ডলতে ডলতে বাইরে আসে। পেছনে দাঁড়ায় ওর বউ। গুড়ি সহসাই মুখ খুলতে পারে না, ওর বউ শুরু করে, ‘তোর বিটিক করগে যা। বিটির প্যাট কর জাউরা মরদ’, ইত্যাদি।

‘তোর বউয়েক থাইমব্যার ক গুড়ি। ভালা হবি ন্যা কইতিচি’। এই কথা শুনে আপাতত সানেকার গলা থেমে যায়। হুরমুতের হুমকিতে নয়, ইজুর আলীর কথায়। ইজুর আলী এ পাড়ায় মোটামুটি পরহেজগার হিসেবে পরিচিত, একপ্রকার মাতব্বরও।

সে হুরমুতের পক্ষ নেয়। ‘মাগি মাইনসের ইতা কি কতা রে গুড়ি। অক থামাবার পারিস ন্যা’? ক্যা থামবি ক্যা? হামরা যামু কই? তা হামি জানি? পরের কথাটা হুরমুতের। সেকথায় গুড়ি খানিকটা হকচকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘হামরা যামু কই’? এতোক্ষণে পরিপূর্ণরূপে স্বমূর্তি ধারণ করে সানেকা।

সে ইজুর আলী তো ইজুর আলী, ওর চৌদ্দগুষ্টি ধুয়ে দেয়। সানেকার মুখ ঝামটা আর কথার বাণে হুরমুতের কথাও হারিয়ে যায়। সানেকা তখনও থামে না। এমনটি শুধু আজ নয়, ওর এই মুখের কারণে হুরমুতের পক্ষে যারা কথা বলতে আসে তারা চিরকালের জন্যই ওদের শত্রু হয়ে যায়। পরবর্তিকালে তারাই হুরমুতকে উষ্কানি দেয়।

ধীরে ধীরে ওদের দল ভারি হতে থাকে। এর জন্য দোষ অবশ্য পুরোটা সানেকাকেও দেওয়া যায় না। ওর এই মুখের ঝালে সবাই বেশ বিব্রত সে কথা ঠিক, তাই বলে সানেকা এমন না হলে হুরমুত একাই এতোদিনে ওদের এখান থেকে উচ্ছেদ করতো, সে কথাও কারো অজানা নয়। হুরমুত চেষ্টাও কম করেনি। বারবার সে আসে কিন্তু সানেকার মুখ ঝামটা খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

হুরমুতের পক্ষে যারা কথা বলতে আসে তাদের বেশিরভাগই সমাজের উচ্চস্থানীয়। তেলের মাথায় তেল দিতে কে না চায়? আর যারা মনে-প্রাণে চায় ওরা এখানেই থাকুক তারা সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের কথার দাম কেউ দেয় না। ওদের কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে বড়ো-ছোটো বাছ-বিচার নেই, হুরমুতের পক্ষে যেই কথা বলতে আসে তাকেই সানেকা এমন করে ঝুড়ে দেয় যে, সে আর সহসাই এমুখো হতে ভরসা পায় না। আজ কাতে পড়েছে ইজুর আলী।

আর সানেকাও তাকে ভালোভাবেই ধরেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সে মন হিত করে খিস্তি করতে পারে না, পেছনে এসে দাঁড়ায় গুলবদন। ওকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি। ইজুর আলীকে বাদ দিয়ে সানেকা এবার ওকেই কামড়ে ধরে। যত অক্ষমতার খেদ সব গিয়ে পড়ে অসহায় মেয়েটার উপর।

গুলবদন কোনো প্রতিবাদ করে না। কৈফিয়তও দেয় না। সারারাত কোথায় ছিল, কি সমাচার, কিছুই না। শুধু অস্ফুটে একবার বলে, ‘ভাত দে, খামু’। গুলবদনের ক্ষুধা সানেকার কাছে তেমন পাত্তা পায় না।

সে চিৎকার করে, ‘ক্যা খাবি ক্যা, খাবি ক্যা? যে নাঙ্গের বাড়িত ছিলু তার বাড়িত খাগা যা’। চিৎকার করতে করতে সানেকা হঠাৎই বেশ নেতিয়ে পড়ে, আরেকবার বমি করে। বমি নয় বমি করার মতো করে। অনেকগুলো নীল রঙের পানি বের করে দিয়ে ও বেশ ঝিমিয়ে যায়। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে।

খুব চেষ্টা করে তবেই একবার বাতাস নিতে হয় বা ছাড়তে হয়। এতো কষ্টের পরও সে খুব চেষ্টা করে একবার বুক ভরে বাতাস নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ক্যা রে মরদডা, খাড়ায়্যা আচু ক্যা, মাস্টারের বাড়িত থ্যা খুঁজটা তো লিব্যার পারিস, না-কি’? বউয়ের ধাতানি খেয়ে গুড়ির বাস্তববুদ্ধি ফিরে আসে, সে বেরিয়ে যায়। মাস্টারের বাড়িতে পৌঁছে কাজের কথা পাড়ার আগেই গুড়িকে গাছে উঠে ডাব পাড়তে হয়, মাস্টারের ছেলে এসেছে শহর থেকে, তার জন্য। ছেলে পিঠা খাবে, ফলে ভারে করে ধান নিয়ে যেতে হয় চারমাইল দূরের মিলে। সেখান থেকে চ্যালকুটে আনার পর জাল ফেলতে হয় পুকুরে।

জান দিয়ে চেষ্টা করে দৌড়ে একটা মোরগও ধরে গুড়ি। তারপর যখন কথা বলবার অবকাশ মেলে ততক্ষণে মাস্টার বেরিয়ে গেছে। অথচ কটা কথা বলার জন্য সারাদিন ধরে সে এতো এতো কাজ করেছে। শুধু তাই-ই নয় গত মাসে নগত পাঁচ হাজার টাকাও নিয়েছে মাস্টার। কথা দিয়েছে লোকজনকে রাজি করিয়ে যেকোনো মূল্যে হুরমুতের কাছ থেকে কাঠা চারেক জমি তাকে নিয়ে দেবে।

টাকা দিয়ে রেখে, এতো কাজ করেও কোনোই পাত্তা পেল না গুড়ি। শুধু এখানে নয়, কোথাও না। এপড়ার পাঁচজন মাতবর টাইপ লোক মিলে কাছাকাছি ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছে ওর। ইটপোড়ানো, আগুনের তাপে পোড়া টাকা, হাত গরম করা চামড়া কালো করা টাকা। তাতেও আজ কোনো কাজ হয় না।

মনে মনে ওদের অভিশাপ দিতে দিতে গুড়ি বাড়ি ফেরে। এর মধ্যেই সানেকা বিছানা নেয় শক্তপোক্তভাবে। গুলবদন চুলায় ভাত তুলে দিয়ে উদাস চোখে বসে থাকে। কালু পুরো ন্যাংটা হয়ে নুনুর মুরগিউকুন তোলে। পিড়ার এক কোটে কালকের বাঁধা অবস্থায় বাছুরটা দানাপানির অভাবে তার স্বরে চিৎকার করে, তাকে নামিয়ে গাছের সাথে বাঁধার কথা কারও মনেই আসে না।

মুরগিরা কুঠির মধ্যে হরতাল করে, কেউ খোপের মুখটাও খুলে দেয় না। গুড়ি মাথা ধরে পিড়ার ধারে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সে উঠে এসে বসে সানেকার কাছে। সানেকার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বেশ মায়া-মায়া লাগে। ‘নদী-নালা, অভাব-অভিযোগ, জলা-জংলার দ্যাশে মাইয়াটা এক্কেবারে সোনার টুকরা’, আহা, সানেকা ওকে বড্ডো ভালোবাসে।

‘খ্যাটম্যাট করে যে তা ঠিক, তয় হাসলি তাক চম্পার মতুন দেকায়’। বউ-এর সুস্থ অবস্থার মুখখানা মনে পড়াতে গুড়ি খানিকটা স্মৃতিকাতর হয়, অনেক দিনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সানেকার এখনকার তেল চিটচিটে কালিমাখা দেহখানাকে আরেকটু ঠেলতে ঠেলতে দশ-পনেরো বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতে চায়। শরীরের রগগুলো ফুলে ওঠে। সানেকা রসের ভেতর তলিয়ে গেলে ছেড়া কাঁথার উপর বাঁশের মাচায় শোওয়া সানেকা ধীরে ধীরে কুকড়ে যেতে থাকে।

সেদিকে পাত্তা না দিয়েই কোনো একদিন তার হারানো দিনের কাছে বিশ বছরের সংসারের আত্মসমর্পণ হয়। কুড়ির কোঠায় হারানো পটেও ভ্রুর মাঝখানে ছোট্ট একটা দাগ পড়ে। কছিমের সাথে এক সন্ধ্যায় মরাকুড়ি খালের ব্রীজের নিচে গ্রেনেড ফাটা আর্তনাদ আর অতপর সুখ দুলুনি সবচেয়ে কঠিন ভাঁজে চালান হয়ে যাওয়ার অবকাশটুকুতেই গুড়ির কোছা আঠালো রসে ভরে ওঠে। রাতে নেমে আসে। গরিবের জীবনের মতোই গাড় কালো রাত।

শেষ বসন্তের পুর্ণিমায় আকাশ জুড়ে চাঁদের বুড়ির সুতায় ভর করে চরে বেড়ায় মেঘশাবকের দল। হালকা বরণ কুয়াশার মাথায় হলুদ জলে মেশানো রঙের মস্ত চাঁদ আর তার থেকে কিশোরীর ফর্সা গালের মতো আলো বেড়া ভেদ করে ঘরে ঢুকলে গুড়ির মাটি বওয়া নিরেট করোটিতে সুড়সড়ি লাগে, একটা বোটা শক্ত করে খামচে ধরে সে। সানেকা বাঁধা দিতে চায়। পারে না। শক্তিতে কুলায় না।

থুতুর পরিমান বেশি লাগলেও গুড়ি মানিয়ে নেয়। নিচে মেঝেতে শওয়া অতোবড়ো মেয়েটার কথা ওর মনেই আসে না। মেয়ের কাছে শোওয়া ছেলের কথাও না। বাঁশের পুরনো মাচায় খটখট শব্দ ওঠে। নিচে জেগে থাকা যুবতি মেয়ের মনে সে শব্দ হাপরের হাওয়া দেয়।

ঘুম পাড়াতে গিয়ে বুকের উপরই ঘুমিয়ে পড়া ভাইটাকে একটু ঠেলে এবার সে নিচে নামায়, নিজের জায়গাই ওর নুনুটা বারবার ঘষতে থাকে। এসময় বাবার লোমশ বুকটার কথা মনে পড়লে বাবাকে খুব পুরুষ পুরুষ লাগে ওর। এভাবে সারারাত ভয়ানক যন্ত্রনায় কাটাবার পর সারাদিনমান মায়ের ভাগ্যকে খুব হিংসা হয় গুলবদনের। বাবার উপর হয় রাগ। যারা টাকা দিতে চায় তাদের সাথে রাজি হবে কি না মনে মনে ভাবে।

আয়েবের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়, ‘বড়োলুকের পোলা, বিয়্যা করার পাত্র সে লয়। তয় ক্যারমে ক্যারমে একদিন শিকল পড়লিই হয়। গুটা পাড়ার মাগি মরদরা যি এতু কানা কেন’? সারাদিন এসব ভাবতে ভাবতে আর টুকটাক দুএকটা কাজ করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন শুরু হয় খুব বাড়াবাড়ি। সানেকা শুয়ে থাকে বারান্দার স্যাতস্যাতে বিছানায়।

গুলবদন গরম পানি দিয়ে মায়ের সারা শরীর মুছে দেয়। কালু পাছা ভর্তি গু নিয়ে সারাবাড়ি হেঁটে বেড়ায়, সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপই করে না। কখনো কখনো সানেকা ভোৎ ভোৎ করে কাঁদে। গুলবদন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘মারে তোর ব্যাটা কত্তো করি ডাইকলো, তুই একবার তাকালু না! অ-মা কতা কস না ক্যা? নড়স না ক্যা রে, অ-মা’? এসব করতে করতে পেটে ভয়ানক এক কামড় দিলে গুলবদনের মনে পড়ে সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। কথাটা মনে পড়তেই মুহূর্তেই যেন ক্ষুধার মাত্রা যায় শতগুন বেড়ে।

এক সময় পেটের ক্ষুধা মাথায় ওঠে, মাথা হয়ে ঘাড় হয়ে সারা গা ঘুরে বেড়ায়। তখন শরীরটাকে ভীষণ দুর্বল আর মাথাটাকে ঘিঞ্জি আর ঝাপসা মনে হয় ওর। সে ড্যাগ ঝেড়ে আড়াই কৌটা চাল নিয়ে ভাত চড়ায়। সানেকা কখনো বটতলার জিনের সাথে বিড়বিড় করে কথা বলে, কখনো টেনে টেনে ভুল উচ্চারণে ফাতেহা পড়ে, কখনো বা যারা বাড়ির জমি নিয়ে দেবে বলে টাকা নিয়েছে তাদের গাল দেয়। আবার কখনো ভয়ানক শারীরিক খিচুনির মধ্যে জীবন ও জগতে তার যত যাতনা বঞ্চনা তার অদৃশ্য ছবি এবং কৈশোর থেকে অদ্যাবধি সমস্ত আকাক্সক্ষার ছাই বাতাসে ওড়ায়।

চুলার ধার থেকে চোখ বাড়িয়ে গুলবদন দেখে, পেটের ক্ষুধার জর্জরিত সানেকা কনকনে শীতের মধ্যে নাড়ুপাগলার দয়ে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে জংলি কচুর খোঁজে কাদা খোড়ে। সেদিন গুড়ি আবার দেরি করে বাড়ি ফেরে। সানেকা উঠে দাঁড়ায় না, ওর সাথে ঝগড়াও করে না। গুড়ি অনেকক্ষণ মাথার চুলে বিলি কাটার পর সানেকার চোখের ইশারায় কান নিয়ে যায় ওর মুখের কাছে, সানেকা বিড়বিড় করে বলে, ‘তুমার বাসনা আলা মাগিডা হামার কালুক দেকপে তো’? বলেই আবার সে মুখ টিপে হাসে। কান্নার চেয়ে নিদারুণ সে হাসিতে গুড়ি লজ্জা পায়, প্রতিবাদ জানায়।

‘কী কস বউ! লষ্ট হওয়া বারোভাতারি মাগি, কুত্তাচাটা থালারও অধম, তারে আমি...! ‘তুমার কাচে আলি ভালো হবি। এতো দিন কই নাই, আইজ ক্যা কই, হামার তুমি পরথম লও। কছিমের সাথে হামার...সেই আ-াবেলার কতা...তুমার সাতে বিয়্যা হওনের পর আর কুনোদিন লয়। আর তো বাঁচুম না, ক্ষেমা দিও’। গুড়ি কথা হারিয়ে ফেলে, সহসাই বলার মতো কথা খুঁজে পায় না সে।

সানেকাই আবার কথা বলে, ‘একদিন হ্যারে আইনো তো, একবার দেখুম, হাজার ইউক আমার সতীন তো’। নিজের এই রসিকতায় সে নিজেই বেশ মজা পায়। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। হাসির ফলেই ওর কাশি ওঠে। চলে অনেকক্ষণ।

কাশির দমকে সে আরো নিস্তেজ হয়ে যায়, তারপর অনেকক্ষণ আর নড়াচড়াও করে না। মাঝরাতে সেই তিন সপ্তাহ আগে খাওয়া পঁচা ভাত আর চুকুমুকু থুকথুকির কয়েকগাল খাবার বুমবোরের কাঁটার মতো পেটে খোঁচাখুঁচি শুরু করলে সানেকা ফের এপাশ ওপাশ নড়াচড়া করে, গোঙায়। টিপটিপ পানি মাথায় করে কে যেন বাইরে এসে দাঁড়ায়, বেড়ার দড়ি খুলে বেরিয়ে যায় গুলবদন। গলা শুনে মনে হয়, মেম্বার হবে। গুলবদনের সাথে তার কিছু কথাও হয়, সানেকা সবটা বুঝতে পারে না।

তবে গুলবদন একবার ককিয়ে উঠলে বোঝে, মেম্বারের মোটা পানখাওয়া বউডা বাপের বাড়ির গেছে, ঢালার জায়গার খোঁজে সে এসেছে এখানে। ধড়মড় কর ঘরে ঢুকে গুলবদন বেড়ার দড়ি বাঁধে, তারপর হাসুয়াটা বের কর চিৎকার করে, ‘বাড়িত থন বারা, নইলে চাকা চাকা করি কাইট্যা ফালামু কইলাম’। সানেকা নিশ্চিত হয়, ‘এবারের মতো কমের উপর দিয়াই ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।