জালে আটকা পড়ছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শাহজাহানের বিভিন্ন অপকর্মের সত্যতা মেলায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্রে এমন খবর পাওয়া গেছে।
মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি পরিচালনার জন্য গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে।
ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন মো. শাহজাহান।
এনএসইউর অচলাবস্থা নিরসন করার লক্ষ্যে ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দিয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অনিয়ম তদন্তে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন, সাধারণ তহবিল থেকে যে পরিমাণ টাকা অন্যত্র সরানো হয়েছে বা নর্থ সাউথ ফাউন্ডেশনের নামে এফডিআর করা হয়েছে তা এনএসইউর সাধারণ তহবিলে স্থানান্তর, ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের ভর্তি না করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে। এ ছাড়া ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের মেয়াদকালে ভর্তি-বাণিজ্য, নারী শিক্ষিকা বা কর্মকর্তা লাঞ্ছনা, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে কোন্দল, দুর্নীতি বহুলাংশে বেড়েছে বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ইউজিসির তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠনের কাজ আগামী সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইউজিসি প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন কমিটিতে একজন বিতর্কিত সদস্যের নাম রয়েছে, যিনি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের নানা অপকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সদস্য হিসেবে অপর যে চারজনের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের কেউ যদি অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁদেরও কমিটিতে না রাখার দাবি জানিয়েছেন এনএসইউর শিক্ষকরা।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম দিকের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত কিন্তু কেবলমাত্র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কোন্দল ও রেষারেষির কারণেই এর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এনএসইউতে এ ধরনের অচলাবস্থা, অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক অনিয়ম কোনো অবস্থাতেই চলতে দেওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত, এনএসইউতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা তদন্তে গত ২৭ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। কমিটির আহ্বায়ক হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী। সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, পরিচালক সামছুল আলম, অতিরিক্ত পরিচালক মিজানুর রহমান ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক ড. দুর্গারানী সরকার। এই কমিটি ২৭১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে এনএসইউতে আর্থিক বিষয়ে গরমিল ও অনিয়ম রয়েছে।
তদন্ত কমিটির পক্ষে স্বল্প সময়ে আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে আরো বেশি তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে কমিটি মনে করে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির একজন সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালে এনএসইউর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন এম এ কাসেম। ওই বছরের জুন মাসে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের প্রায় ১০০ কোটি টাকা এনএসইউ ফাউন্ডেশনে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজন ট্রাস্টি সদস্য নিজেদের আর্থিক সুবিধানুযায়ী এনএসইউর তহবিলের প্রায় সাত কোটি টাকা অপেক্ষাকৃত কম মুনাফায় সাউথইস্ট ব্যাংকে রেখেছেন বলে তদন্ত কমিটিতে অভিযোগ পড়েছে।
এ ছাড়া এনএসইউ ফাউন্ডেশনের সদস্যরা নিজেদের সভা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের হাজিরা ফি ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বহন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে আয় হওয়া এ অর্থ অন্য কোনো সংস্থার কর্মকর্তারা ব্যয় করতে পারেন না বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য প্রার্থীদের ভর্তি করা যাবে না বলে তদন্ত কমিটি মন্তব্য করেছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের সুপারিশ এবং উপাচার্যের অনুমোদন সাপেক্ষে ভর্তি পরীক্ষায় পাসের জন্য নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে ৫ শতাংশ কম পাওয়া নম্বরধারী শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ২০ জনকে প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি করা যেতে পারে বলেও কমিটি অভিমত দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিন বলেন, একজন ট্রাস্টি সদস্য প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করতে পারেন।
কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ এ নিয়ম লঙ্ঘন করে ইচ্ছেমতো অকৃতকার্য শিক্ষার্থী ভর্তি করছে।
ভর্তি-বাণিজ্য বন্ধের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিনের নেতৃত্বে বর্তমানে প্রচলিত আর্বতন পদ্ধতিতে পরিচালিত ভর্তি কমিটির পরিবর্তে এনএসইউর প্রতিটি ফ্যাকাল্টি থেকে প্রতিনিধি সমন্বয়ে উপাচার্যের নেতৃত্বে একটি ভর্তি কমিটি গঠন করতে হবে। ভর্তি কমিটি প্রতিবছর পুনর্গঠন করতে হবে।
ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনা এক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত কমিটি কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। তবে এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
কারণ এর আগেও কয়েকজন শিক্ষিকা ও মহিলা স্টাফ চেয়ারম্যানের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং কেউ কেউ চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া উপাচার্য ড. হাফিজ জি এ সিদ্দিকীকে চার দিনের ছুটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে দুই মাসের ছুটি দেওয়াকে চ্যান্সেলর তথা রাষ্ট্রপতির আদেশ অমান্যের শামিল বলে তদন্ত কমিটি অভিমত দিয়েছে। নর্থ সাউথ ফাউন্ডেশনের কাজে ব্যবহৃত হওয়া এনএসইউর নিজস্ব ভবনের সপ্তম তলা পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিতে ডিন অথবা চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত পুরোপুরি উপাচার্যের এবং সিন্ডিকেটের এখতিয়ারভুক্ত। এ ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বোর্ডকে কোনো ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।