বেকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে অবাধ দুর্নীতি ও ন্যক্কারজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহজাহান বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে একজন শিক্ষিকা এরই মধ্যে দেশত্যাগ করেছেন। সেই সঙ্গে চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁরই প্রশ্রয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তৃত হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসব অভিযোগ করেছেন লিখিতভাবে। মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগ তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি)। ইউজিসির চার সদস্যের কমিটি এসব অভিযোগ তদন্ত করছে। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, কমিটি আগামী ১ মার্চ শুনানি গ্রহণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম, ভর্তি-বাণিজ্য এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ও তদন্ত করবে কমিটি।
জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাড়াও অন্য অনেক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পরই গত সপ্তাহে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে। আগামী ১ মার্চ কমিটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। ওই দিন শুনানি হবে।
আমরা বিষয়টিতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছি। '
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আতফুল হাই শিবলী বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ দুটি। একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম, ভর্তি-বাণিজ্য, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের অসৌজন্যমূলক আচরণ; অন্যটি শিক্ষিকার আনা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ করেছেন পাবলিক সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষিকা। তিনি কি নিজেই অভিযোগ দিয়েছেন না অন্য কেউ- এ প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বলেন, 'হ্যাঁ, অভিযোগকারী নিজেই দিয়েছেন।
'
তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবুল হাসেম, পরিচালক শামসুল আলম ও কর্মকর্তা ড. দুর্গা রানী সরকার।
এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে ব্যবস্থা নেব। কারণ এসব অভিযোগের একটি আইনগত ভিত্তি দরকার।
তদন্ত প্রতিবেদন সেই ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। তাই তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। '
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেওয়া, বোর্ডের চেয়ারম্যান ও উপাচার্যের পদত্যাগ, ভর্তি বাণিজ্যের লাগাম টানা, হিজবুত তাহ্রীরের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা এবং একাডেমিক কার্যক্রমের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বসুন্ধরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্রছাত্রীরা। গতকাল সোমবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের সামনে কয়েক দফা বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে অবৈধ আখ্যায়িত করে অবিলম্বে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানকে পদত্যাগ করতে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছেন এই বোর্ডের সদস্য এম এ আউয়াল।
তিনি লিখিত অনুরোধপত্রের অনুলিপি গতকাল বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ট্রাস্টি বোর্ডের জরুরি সভা আহ্বান করে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বা কার্যলিপি ছাড়া এ সভা আহ্বান করায় এটিকে অবৈধ আখ্যায়িত করে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারিকে চিঠি দিয়েছেন সদস্য এম এ আউয়াল ও ইফতেখারুল আলম। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক হাফিজ জি এ সিদ্দিকী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ ঠেকাতে গত রবিবার থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দফায় দফায় বৈঠক করছে।
জানা গেছে, রবিবারের বৈঠকে উপস্থিত অভিযুক্ত চেয়ারম্যান শাহজাহান ও অন্যরা চাপে পড়ে পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক বেলাল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রমে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারীদের চিহ্নিত করা, যারা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে করণীয় নির্ধারণেই এ জরুরি সভা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ইউজিসি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তাদের তদন্তের পরই সব বোঝা যাবে।
যত অভিযোগ : গত ১ ফেব্রুয়ারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের স্বাক্ষর সংবলিত একটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এই অভিযোগগুলো সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি।
ওই অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, কয়েকজন বোর্ড সদস্য ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান তাঁদের নিজ নিজ স্বার্থ ও অনৈতিক কাজ হাসিল করার জন্য দুর্নীতিবাজ, অসাধু, চরিত্রহীন ও নীতিভ্রষ্ট একজন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ নিয়োগ দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। বর্তমান বোর্ড চেয়ারম্যান কিছু গুরুত্বপূর্ণ বোর্ড সদস্যের মতামত উপেক্ষা করে এ নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
এ ধরনের একটি প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
অভিযোগ পত্রে আরো বলা হয়েছে, ওই প্রার্থী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক থাকাকালে নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ভর্তি বাণিজ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, অর্থের বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের গ্রেড পরিবর্তন, একাধিক নারী শিক্ষক ও ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের কারণে বিতর্কিত ছিলেন। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে একাধিক তদন্ত হয়।
তদন্ত কমিটি তাঁর চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করে। একপর্যায়ে ওই শিক্ষক চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এসব ঘটনা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ওই শিক্ষককে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ না দেওয়ার অনুরোধ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অভিযোগ পত্রে।
অভিযোগ পত্রে আরো বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় বোর্ডের একজন সদস্য জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক পরিচয় দিলেও তিনি মূলত নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীরের দর্শনে বিশ্বাসী। তাঁর সাহচর্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দলটির কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হচ্ছে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নকালীন ওই প্রতিষ্ঠানের অন্য এক শিক্ষকের সঙ্গে একত্রে নিষিদ্ধ দলটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নিষিদ্ধ দলটির পৃষ্ঠপোষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান যেসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড করেন, তা ধামাচাপা দেন তাঁরা।
এ ছাড়া মো. শাহজাহান ও তাঁর সহযোগীদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে একজন শিক্ষিকা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ছাত্রছাত্রীরা আরো অভিযোগ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে ১১তম সমাবর্তন পর্যন্ত কী পরিমাণ মূল সনদ ছাপানো হয়েছে, কী পরিমাণ সনদ ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয়েছে এবং কী পরিমাণ কাগজ এ জন্য কেনা হয়েছে- তার কোনো স্টক রেজিস্টার নেই।
বর্তমান চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, তাঁর ছেলে ও ছেলের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে সার্টিফিকেট বিক্রি করেন। শাহজাহান তাঁর পুত্রবধূকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা চেয়ারম্যান শাহজাহানসহ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন ।
গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
কমে গেছে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের উপস্থিতি। যেকোনো মুহূর্তে কর্তৃপক্ষের অনাচারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিক্ষোভের আশঙ্কা করছেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড হাফিজ জি এ সিদ্দিকী গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি অসুস্থ। ছুটিতে আছি। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমি শুনেছি।
তদন্ত কমিটির কাছ থেকে একটি চিঠি আজ (গতকাল) পেয়েছি। আমি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পেয়েছি। তদন্তের আগে আর কিছু বলা যাবে না। ' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।