আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো... আমি খুঁজেছি তোমায়...

যে নদীর গভীরতা বেশি, তার বয়ে চলা স্রোতের শব্দ কম। কী অদ্ভুদ ! আমার মা নেই। এক সময় বাংলা সিনেমায় নায়ক নায়িকাদের উপর সৎ মায়ের অত্যাচার অনাচার দেখতাম। নিজেকে সেই হতভাগা নায়ক নায়িকাদের স্থানে নিয়ে চিন্তা করতাম। কেমন হয় সৎ মা ? এমনই ? আপন মা না থাকলে ক্যামন লাগে ? বুঝতাম না তখন।

রাতে আমার মা আমাকে কখনো গল্প বলে ঘুম পাড়াতেন না। একদিন মাকে বায়না ধরেছিলাম, একটা গল্প শুনাতেই হবে। মা সেদিন শুয়ো রানী আর দুয়ো রানীর গল্প শুনিয়েছিল। ছোট রানী কীভাবে চক্রান্ত করে বড় রানীকে মেরে ফেললো ! তার পর বড় রানীর দুই ছেলেকে রাজ্য থেকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্ত। গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল সেই গল্প শুনে।

হায়রে সৎ মা ! কে জানতো সৎ কেমন করে এমন হয় ? দুই. চার বছর আগের কথা। মা'র একটা অপারেশন করাতে হয়েছে। এই অপারেশনটাই কাল হলো মায়ের জন্য। অনেক দিন ধরে মায়ের সমস্যাটা ছিল। কিন্তু মা অপারেশন ভয় পান।

তিনি চেয়েছিলেন অষুধের মাধ্যমে সারিয়ে নিতে। আসলে বিষয় তা না বোধ হয়। মা চেয়েছিলেন টাকা বাঁচাতে। আমাদের তিন ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ সচল রাখতে মা নিজের মধ্যে অসুখ পুষেছিলেন। যখন অবস্থা বেশি খারাপের দিকে, তখন অপারেশনে রাজি হলেন।

কিন্তু বড় দেরি হয়ে গ্যাছে। নারায়ণগঞ্জের একটা বড় ক্লিনিকে অপারেশন করিয়েও সারিয়ে তোলা গেল না মাকে। বরং অবস্থা আরো খারাপ পর্যায়ে চলে গেল। ওটা নাকি ক্যান্সারে রুপ নিয়েছিল। ডাক্তাররা মাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসতে বললেন।

মাকে নিয়ে এলাম ডিএমসিতে। সেখান থেকে শুরু আমাদের দু:স্বপ্নের রাত। এক সপ্তাহ হাসপাতালে জীবন কাটালেন মা। তারপর এক রাতের গল্প। মাকে হাসপাতাল থেকে দেখে আমি আর আমার বড় বোন বাসায় ফিরলাম বারোটার দিকে।

হাসপাতালে ছিল বাবা আর ছোট চাচা। বড় বোন ফেরার সময় রিকশায় বসে কাঁদছিল আর বলছিল, মাকে আর বুঝি দেখবোনারে ভাই ! আমি চরম অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে ধমক দিয়েছিলাম বড় বোনকে। ধুর ! এটা হয় নাকি ? মা সুস্থ্য হবে না - এটা আমি তখন ভুলেও কল্পনা করতে পারতাম না। রাতে ঘুমালাম। ঘুম ভাঙ্গলো সুবহে সাদিকের সময়।

বাড়ি জুড়ে চাচিদের কান্নাকাটি। কী হয়েছে? ঘুম জড়ানো চোখে চাচিদের ঘরে ঢুকতেই সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না। মা নাকি আর নেই ! অবিশ্বাস্য। মা নেই !! এটা ক্যামন করে হয় ? আমার মা থাকবে না- এটা কিভাবে সম্ভব ? আমার মা মারা যাবে কেন ? আমার মা... ! আমি একটা মস্ত ধাধায় পড়ে গ্যাছি। আমার কান্না আসছে না।

আমি পাথর হয়ে গ্যাছি। তিন চার বছর পরের গল্প। এরই মাঝে দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছি। আমিও স্টাবলিস্ট বলা চলে। বিয়ে করেছি কিছু দিন আগে।

তারও আগে বাবাকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। নাটক সিনেমায় নায়ক-নায়িকার বাবারা সন্তানের সুখের জন্য আর বিয়ে করেন না। বাস্তবে তা হয় না। বাবার সেবা যত্নের জন্য তাকে আমরাই বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। এখন আমাদের ঘরে সৎ মা ! আমার মা তার জীবনে আমাকে একটাই সুয়ো রানী-দুয়ো রানীর গল্প শুনিয়েছিলেন।

সেই গল্প এখন আমার জীবনে সত্যি হয়ে আসবে কেন ? ছোটকালে সিনেমায় সৎমায়ের ঘরে নিজেকে চিন্তা করেছি-এটাতো শিশু মনের এক পাগলামো ছাড়া কিছুই ছিল না। এটা কেন আমার জীবনে সত্যি হয়ে আসবে ? চার মাগো ! মা ! একদিন গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে তুমি ওঠানে ধান শুকাচ্ছিলে। স্কুল খেকে ফিরে তোমাকে বল্লাম, মা আইসক্রীম খাবে ? তুমি বললে- তুমিই খাও বাবা। আমি আইসক্রীম খাই না। ( আামদেরকে খাওয়ানোর জন্য তুমি অনেক কিছুই খাওনা)।

আরেকদিন প্রচন্ড গরমে তোমাকে বল্লাম, মা, তরমুজ খাবে ? কিনে আনি ? তুমি বললে, লাগবে না বাবা। মনে মনে খেয়ে নিলাম। মা, স্কুল জীবনে তোমাকে কখনোই কিছু খাওয়াতে পারিনি ! এখন আমি অনেক টাকা রোজগার করি। কিন্তু তোমাকে তো পাই না মা ! তুমি নেই ! আমার জীবনটা, আমাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে আছে মা। তুমি যেভাবে সংসারটাকে আগলে রাখতে নিজের মমতার আচলে, সেভাবে আর কে পারবে মা ? মাগো, তোমার কাছে তোমার এই অধম ছেলে ক্ষমা চাইছে।

তোমার অসীম মমতা আর ত্যাগের কোন মূল্যই দিতে পারিনি আমি। আমাকে ক্ষমা করো মা। ক্ষমা করো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।