আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা খুঁজেছি যারা স্বর্গের পথ...

উঁকি দাও ফুল!

মহসীন ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে নাই, পাড়ায় এমন কোন পোলা-পাইন ছিল না। প্রকৃতির যথানিয়মে আমিও দেয়াল বাওয়া বন্ধ কইরা ফুলপ‌্যান্ট পড়া শুরু করার অল্পকিছুদিন পরই আমাদের ত্রিরত্মকে মহসিন ভাই গ্রেফতার করলেন। নামধাম, বাসা শুনে বললেন, "দাদু ভাই, একদিন মইরা যাইতে হইবে রে দাদু ভাই!" হঠাৎ মরার কথা আসে কেন? হাসি পেয়ে গেল, কিন্তু ভদ্রতা বলে কথা। "কবরে আল্লার কাছে কি জবাব দিবা? কাল দুপুরে কি দিয়া ভাত খাইছো, তা কি মনে আছে? আল্লার কাছে কিন্তু সারা জীবনের সব কাজের হিসাব দেয়া লাগবে..." মহসিন ভাইয়ের টার্গেট মিস নাই, আমার ফটকা বন্ধুটারেই তিনি খালি আগে চিনতেন অল্পস্বল্প। ফটকা কথা শুনার ভান করে আর বলে, মোহসিন ভাই, এট্টা কোক খাই।

মহসিন ভাই তিনজনরে তিনটা কোক খাওয়ালেন (৭টাকা কি দাম ছিল তখন!); তারপর আবার শুরু করলেন, "আমাদের যে দাদা-দাদী, নানা-নানী কবরে আছে, আমরা কি জানি তারা কেমন আছে?..." ফটকা আনমনে দোকানের বয়াম খুলে কেক বের করে খেতে খেতে খুব মাথা ঝাকাচ্ছে, মহসিন ভাই আমাদের দু'জনকেও দুটো সাধলেন। ফটকার কাজ দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছিল, আমরা নিলাম না। ফটকা ও দুটোও অম্লান বদনে পেটে চালান করে দিল। মহসিন ভাইয়ের কথা কিন্তু চলছে... "এই যে চারদিকে এত ব্যভিচার, অনাচার, ঘুষ, দুর্নীতি এইগুলার সমাধান কি? আমরা যদি আল কুরআনের রাস্তায় চলতাম..." ফটকা একাধরে খেয়ে চলল যা যা খাদ্যবস্তু আছে (খেতে পারত হারামীটা, আল্লা তাকে শাস্তিও দিল হাতেনাতে, গতবছর মন্ট্রিল থেকে যে ছবিটা পাঠাল... শ'খানেক কেজি হবে ওজন), আর আমরা বাকি দু'জনও শরম ঝেড়ে ওর সাথে যোগ দিতে দিতে মহসীন ভাইয়ের বয়ান শুনলাম। এতদিন পর বুঝি ওই মন দিয়ে কথ শোনা আর ফটকামি দুটোই কিশোরের এক বয়সেরই কাহিনী।

আজও সদ্যরোম ওঠা বালকদের দেখলে আমাদের নিজেদের বালক বয়েসের সেই পাপ-পুণ্যের দ্বৈরথে ভরা সময়ের কথাই মনে হয়। হঠাৎ ফটকা বলে, মোহসীন ভাই, আমাদের তো স্যার পরীক্ষা নিতে আসবেন কাল, এখন আমরা যাই। এতগুলো টাকা জলে গেল বলে মোহসীন ভাই এর মুখের হাসি বিন্দুমাত্র বিন্দুমাত্র মলিন হল না। এত খারাপ লাগল। দ্বৈরথ! কিছুদূর এগিয়ে পেছন ফিরে মহসিন ভাইকে বললাম: ঐটা আমাদের বাসা, দোতলায় থাকি।

আপনি আসবেন। মহসিন ভাই অচিরেই বাবাকে পটিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন এক মসজিদে দ্বীনের দাওয়াত দিতে, প্রতিদিন বাদমাগরিব বাসায় পৌছে দেবেন। *** পাড়া যে এত জটিল জায়গা, আগে বুঝি নাই। দ্বিতীয় রাতেই বাসায় হাজির হলেন স্কুলের আরেক হুজুর, ইনিও স্নেহ করতেন আমাকে, তবে তার বেত ছিল সাংঘাতিক। দেখি বাবা আর তিনি গল্প করছেন, আমি হুজুরকে সালাম দিতেই বাবা চলে যেতে যেতে বললেন, হুজুর নাকি কি বলবেন তোমাকে।

"তুই নাকি তাবলীগে গেছিস?" "জ্বী হুজুর!" আমি ধরেই নিলাম হুজুর মহা খুশি হবেন। সাথে হয়তো ছিল আমি একটা কিছু করছি, এই বালক-সুলভ ব্যক্তিত্ব বোধ। "কি করিস তাবলীগে?" "এই হুজুর মানুষরে বলি মদ খাইও না। ব্যাভিচার করিও না। সুদ খাওয়া আল্লাহ পাক হারাম করেছেন।

দ্বীনের রাস্তায় কাজ করো। " "লোকে শোনে?" "জ্বি, হুজুর শোনে। না শুনলেও চেষ্টা তো করতে হবে। " আমি তখনও নিশ্চিত যে হুজুর আমার উৎসাহ পরীক্ষা করছেন। "শোন মদ খাইতে না করিস কেন? আল্লা হারাম করছেন, এই তো? তোরা প্রতিদিন কয়জনরে বুঝাস? জানিন বাংলাদেশে প্রতি সেকেন্ড কয়টা শিশু জন্ম নেয়?" "না, হুজুর জানি না।

" জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে মদ খাইতে বারণ করার কি সম্পর্ক ভাবতে ভাবতে আমি উত্তর দিলাম। হুজুর একটা সংখ্যা বললেন। মনে নাই। দরকারও নাই। কিন্তু তারপর যা বললেন, পশম দাঁড়িয়ে গেল।

"শোন, তোর ঐ তাবলী্গ ওয়ালারা সব মানুষরে মদ খাইতে না করতে করতে এত মানুষ জন্মাবে যে তোরা একদিকে মানুষরে বুঝাইতে থাকবি, আরেক দিকে সব ভুলতে থাকবে। একদিকে ব্যভিচার করতে না করবি, আরেকদিকে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পইড়া মানুষেরা নাফরমান হইতে থাকবে!" "তাইলে কি দ্বীন প্রচার করবো না হুজুর!" আমি কিছুটা হতভম্ব। "করবি না কেন, করবি। কিন্তু তার সঠিক রাস্তা এইটা না। ধর, মদ থাকে মদের বোতলে।

সব মানুষরে মদ খাইতে বোঝানোর চাইতে মদের বোতলটা ভাইঙ্গা ফালাইলে কি আর কেউ মদ খাইতে পারবে? তখন আর কাউরে বোঝানো লাগবে না। এম্নিতেই সবাই আল্লার রাস্তায় চলবে। এই বোতলের নাম হইল ক্ষমতা। ক্ষমতা দখল কইরা নিতে হবে!" আমি মন্ত্রমুগ্ধ। হুজুর গলা নামিয়ে বললেন, কাল টিফিন পিরিয়ডে সুফী নামে একজন আসবে।

তার সাথে কথা বলবি, তার কথা শুনবি। বেশ ক'বছরই শুনলাম। সবচেয়ে বাধ্য আর অনুগত সদস্য হয়েই শুনলাম। অবিন্যস্ত, ছাগরা দাড়ির মোহসীন ভাইয়ের দুঃখী, মায়াভরা চেহারার বদলে এবার সুফী ভাই পর্ব, তার ছাটা দাড়ি, ইস্পাত দৃঢ় চোয়াল। সদা সতর্ক চলাফেরা।

কাহিনীর মূল থ্রিল ওই হুজুরের বক্তৃতাই, বাকি অংশটা বেশ নাজুক। আমার আগ্রহ যতই ইতিহাস, অর্থনীতি আর বিজ্ঞানের রাস্তা দিয়া আগায়, সুফি ভাই ততই ব্রেক কষেন। এর মাঝে বাবার সুত্রে হাতে আসল আরেকটা বই, আসমান ও জমীনের মালিক। লেখক আবদুল গফূর। সেইখানে একটা অসাধারণ জিনিস পাইলাম, আবু জর গিফারী নামের এক সাহাবীর গল্প।

যিনি বলতেন, "আসমান আর জমিনের সকল কিছুর মালিক যদি আল্লাহ হন, তো যে বলে এই জমি আমার, সে শিরকী করে আল্লাহর সাথে। " সুফী ভাইরে বলতেই চটলেন। বললেন, ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানা সমর্থন করে। বললাম, তাইলে আমরা ক্ষমতা দখল করলে আমাদের কর্মসূচি কি হবে? সুফী ভাই বললেন, সুদ থাকবে না। মদ হারাম হবে।

ব্যভিচার থাকবে না। ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে। "কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মসূচি কি হবে, সেইটা বলেন!" "কর্মসূচি তো ওই। আর দ্যাখো, আল্লা রাব্বুল আলামীন অসীম মেহেরবান, আমরা যদি একটা ইসলামী বিপ্লব করতে পারি, তাইলে তিনি কি মায়মানসিং (হুবহু এইভাষায়, এত জায়গা থাকতে কেন ময়মনসিংহের নাম ওনার মাথায় আসল, তা জানি না, আমার অবশ্য কোন জায়গার নাম বলতে গেলে সবার আগে দিনাজপুরের নাম কেন মাথায় আসে, তা জানি। ) শহরের নিচে একটা তেলের খনি দিয়া দিতে পারেন না? তখন কি মানুষের কোন অভাব থাকবে?" খুব জিদ লাগল।

বললাম, "সৌদি আরবে তো আল্লা তেল দিয়া ভাসায়া রাখছে, তারা তো সব আমেরিকার দালাল। " বিশেষকরে ইরান-ইরাক যুদ্ধে সৌদি সরকার সাদ্দামকে মদদ দেয়ায় তাদের ওপর ছিলাম মারত্মক চটা। সুফী ভাই এটাসেটা কিছু বললেন, বাকিরাও উসখুস করছিল। তারপর কোনমতে বৈঠকের বাকি সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিদায় নিলেন তিনি। আর কখনো যোগাযোগ করেননি।

এটা আজ নিশ্চিত করে বলতে পারি, ওখানে যারা গিয়েছিল আমার সমবয়েসীরা, তারা আমাদের সময়ের সেরাদের মাঝেই গণ্য হবে। কেউ তারা টেকেনি, নানান কারণে। কিন্তু আজ যাদের এই পথে দেখি, সর্বাংশে ধান্ধাবাজ অংশ, নানান সুবিধার পেছনে ছুটে যোগ দেয় ছাত্র শিবিরে, তাদের সাথে আশির দশকের শেষার্ধ পর্যন্ত ইসলামী বিপ্লবের মোহে ঝাপিয়ে পড়া কিশোরদের তফাত আকাশ-পাতাল। কিন্তু ঐ পথে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মাত্র ঐটুকুই। বরং পরে আরেক সুযোগে আরেক বন্ধুর গুটিয়ে যাবার নাটিকাটির বর্ণনা করা যাবে প্রথম কিস্তির জন্য দেখুন Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।