আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৃদ্ধা আশ্রমে রুনা বেগম বারবার মনে করছেন,তাঁর স্বামী মরার আগে যদি মিরপুরের বাড়িটা তাঁকে লিখে দিতেন, তাহলে হয়তো আজ ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে পারত না।

গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী রুনা বেগমের বয়স সাতষট্টি। ছয় ছেলেমেয়ের জননী। দুই মেয়ে, চার ছেলে। মেয়েরা তাদের স্বামী নিয়ে বিদেশে থাকেন। দুই ছেলে থাকেন রাজশাহী, দুজন ঢাকায়।

রুনা বেগমের স্বামী বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। তিন বছর আগে মারা গেছেন। খুব ভালো লোক ছিলেন তিনি। প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সংসারে তেমন অভাব ছিল না।

রুনা বেগম বেশির ভাগ সময় ছোট ছেলে মাসুদের কাছে থাকতেন। মাসুদ ডাক্তার। তাঁর দুই ছেলেমেয়ে। মেয়েটা বড়। ওর নাম মিম! ছেলেটা ছোট, মারুফ।

মারুফ আর মিম দাদিকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু রুনা বেগমকে তবুও এই বৃদ্ধা আশ্রমে এসে থাকতে হলো। ছেলে অবশ্য তেমনভাবে চাননি মা আশ্রমে থাকুন। কিন্তু সংসারে প্রায়ই অশান্তি লাগার চেয়ে এই ভালো। তাই তিনি যখন বৃদ্ধা আশ্রমে আসার জন্য জেদ ধরলেন তখন মাসুদ তেমন একটা জোরালো বাধা দেননি।

রুনা বেগমের মন আজ ভালো নেই। তিনি বারবার মনে করছেন, তাঁর স্বামী মরার আগে যদি মিরপুরের ২৭ নম্বর বাড়িটা তাঁকে লিখে দিতেন, তাহলে হয়তো আজ ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে পারত না। বাড়ির লোভে ছেলে, ছেলের বউরা তাঁকে একটু মান্য করত। কিন্তু হায়! তাঁর স্বামী তা করেননি। তাই আজ বহু বছর পরও মৃত স্বামীকে কেমন যেন পরপর লাগছে।

ইচ্ছা করলে তাঁর স্বামী কিন্তু এ কাজটা করে যেতে পারতেন। রুনা বেগম এসব ভাবছিলেন আর আশ্রমের বাগানে হাঁটছিলেন। এমন সময় পেছন থেকে আশ্রমের বাবুর্চি করিম এসে ডাকতে থাকে_দাদি, দাদি, আপনি একটু আসবেন, চার নম্বর রুমে না ভীষণ ঝগড়া লেগেছে। রুনা বেগম বললেন, কী নিয়ে ঝগড়া? কিছুক্ষণ আগেই তো ভালো দেখলাম। _কী নিয়ে ঝগড়া জানি না।

আপনি আগে আসুন, সবাই আপনাকে খুব মান্য করে, আপনি গেলেই ঝগড়া থেমে যাবে। করিম একরকম টানতে টানতে রুনা বেগমকে নিয়ে যায়। ২. রুনা বেগম রুমে ঢুকতেই শুনতে পান ৮০ বছরের মোমেনা খালা জোরে জোরে বলছেন, তোমরা কী ভেবেছ আশ্রমে আছি বলে আমার কেউ নেই! আমার চার ছেলেমেয়ে, সবাই চাকরি করে। _থাকলে তো এত দিন দেখতে আসত। কই, ছয় মাস হলো তো এসেছেন, কেউ তো দেখতে এল না।

বললেন পাশের রুমের জমিলা খালা। মোমেনা খালা বললেন_আমার ছেলেদের চাকরি খুব কঠিন, ছুটি পায় না, ছুটি পেলে অবশ্যই আসবে। _আর আসছে, ছয় মাসে কারো টিকিটা তো দেখলাম না, আপনার বড় বড় গল্প বাদ দেন। আমাদের কারো ছেলেমেয়েই ভালো না, ভালো হলে কী এখানে আসতে হয়? বললেন জমিলা খালা। তোমার ছেলে ভালো না হতে পারে কিন্তু আমার ছেলেরা খুব ভালো।

_তাই নাকি? তাহলে ভালো ছেলেরা আপনাকে এখানে রেখে গেছে কেন? এবার মোমেনা খালা আর কথা বলতে পারেন না। ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন। রাহেলা বেগম কাছে এসে খালার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ছি বড় আপা, কাঁদবেন না। আশ্রম তো ভালো জায়গা, খাওয়াদাওয়া ভালো, ঘোরাঘুরির জায়গা আছে, সব থেকে বড় কথা, ঝগড়া নেই। কষ্ট পাবেন না, ছেলেমেয়েদের দোষ খুঁজে লাভ হবে না।

আমরা ছেলেমেয়েদের সামনে কিছুই বলতে পারি না। যান গোসল করে নিন, তারপর নামাজ পড়ে ডাইনিংয়ে খেতে যান। আর জমিলা আপা, আপনি তো অনেক জ্ঞানী মহিলা, শুনেছি মহিলা কলেজে চাকরি করতেন, আপনার তো মাথা খারাপ হওয়ার কথা নয়। জমিলা খালা মন ভালো করে বললেন, ভালো লাগছে না আপা, বাড়িতে যেতে মন চাইছে। চাকরির কত লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি করলাম, অথচ তারা সবাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল।

দেখে নেবেন ওদের কারো ভালো হবে না। বকবক করতে করতে নিজের রুমে চলে যায় জমিলা আপা। রাহেলা আপন মনে বলে ওঠেন, আপা ছেলেমেয়েদের অভিশাপ দেবেন না, ওরা আসলে ছকে বাঁধা। ৩. রুনা বেগম শুয়ে শুয়ে ভাবছেন, ছেলেমেয়ে না থাকলে মানুষের আরো করুণ অবস্থা হয়। একটা লাশ নেওয়ার মতো মানুষ থাকে না।

চিন্তা করলেই বুকটা কেমন যেন ব্যথায় টনটন করে ওঠে। রাহেলা বেগম শুয়ে শুয়ে আরো নানা কথা ভাবতে থাকেন। হঠাৎ ফোনটা মাথার কাছে বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিতেই অপর প্রান্ত থেকে ছোট মেয়ে রুনার কণ্ঠ ভেসে আসে। _হ্যালো মা, কেমন আছ? তোমার বুকের ব্যথাটা কি একটু কমেছে মা! মা মৃদু স্বরে বললেন, ভালো আছি রে।

তোরা কেমন আছিস? লুভা, লিওন ওরা ভালো তো! _আমরা ভালো আছি মা! জানো মা তোমার জামাই তো ভীষণ রাগ, কেন তুমি বৃদ্ধা আশ্রমে গেলে, ভাইয়ার ওখানে তোমার কী অসুবিধা ছিল? রাহেলা বেগম কথা বলেন না, চুপ করে থাকেন। _কী, কথা বলছ না কেন? তুমি কি এখানে কানাডায় আসবে মা? _না, রাহেলা বেগম এবার কথা বললেন, আমি কোথাও যাব না রে, এখানে বেশ আছি, তোরাও ভালো থাক। রুনা বেগম ফোনটা কেটে দেন, তারপর শুয়ে শুয়ে ভাবেন, কাল তাঁর জন্মদিন, মেয়েটা এত দূর থেকে কথা বলল কিন্তু কই তাঁর জন্মদিনের কথা তো একবারও বলল না। অথচ চার বছর আগে এই মায়ের জন্মদিন পালন করা হতো খাসি জবাই করে। কিন্তু আজ আশ্রমে আসার পর সব শেষ হয়ে গেল।

৪. রুনা বেগম নাশতা করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ তাঁর জন্মদিন। ছেলেমেয়েরা তাঁকে উইশ করার জন্য এখানে অবশ্যই আসবে। আর যারা আসতে পারবে না, তারা হয়তো ফোন করবে। কিন্তু হায় কপাল! বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল, দুপুর গড়িয়ে রাত তবু কেউ এল না, একটা ফোনও করল না।

রাহেলা বেগমের বুকের ব্যথাটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তিনি কষ্ট করে রুমে ঢুকে শুয়ে পড়েন। করিম বাবুর্চি রুমে ঢুকে রুনা বেগমের অবস্থা দেখে চিৎকার করে বলে, দাদি দাদি, আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? রুনা বেগম বুকের বাঁ পাশটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে খুব আস্তে বললেন, করিম, তুমি আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে পারবে? করিম দৌড়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে রাহেলা বেগমকে দিল। রাহেলা বেগম এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু খেয়ে ফেললেন। তারপর মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, করিম রিং দাও তো আমার ছোট ছেলে মাসুদকে! আজ আমার জন্মদিন।

সবাই ভুলে বসে আছে, এটা কী হলো..রুনা বেগমের কথা শেষ হয় না। তার আগেই চার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই হাজির। একসঙ্গে বলে ওঠে, হ্যাপি বার্থডে টু মা। সব ছেলেমেয়ে আর নাতি-নাতনিকে দেখে রুনা বেগমের চোখে জল এসে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠেন, তোরা কাছে আয়, এত দেরি করলি কেন? একটা দিন কী তোরা আমার জন্য রাখতে পারিস না? অথচ দেখ তোদের আমি ১০ মাস ১০ দিন পেটে রেখেছিলাম, শুধু এখানেই শেষ নয়, আরো আছে।

রুনা বেগম আর কথা বলতে পারেন না। বুকের বাঁ পাশের ব্যথাটা বেড়ে যায়। করিম কাছে এসে দাদির মাথার বালিশটা ঠিক করে দেয়। সে ভেবে পায় না, দাদি এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলল। রুমে তো কেউ নেই।

তাহলে? করিম ভাবতে ভাবতে হয়রান হয়ে যায়, তবু কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না। রুনা বেগম আধো ঘুমে মৃদু স্বরে না তাকিয়ে বললেন, মাসুদ, তুই একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দে বাবা, তোদের ছাড়া আমার না রাতে ঘুম আসে না, আমাকে কি এই আশ্রম থেকে নিয়ে যাবি বাবা? এ বয়সে একা থাকতে খুব কষ্ট হয় রে, রুনা বেগম কথাগুলো অনেক কষ্টে বললেন। দাদির এ রকম অবস্থা দেখে করিম খুব অস্থির হয়ে যায়। সে ভেবে পায় না এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৮ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.