আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসছেন হিলারী-প্রণব, সফল পররাষ্ট্রনীতি

গত দুই বছরে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে আসার সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এবার সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টার সফরে আজ শনিবার বিকেল ৪টার দিকে ঢাকায় পা রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। অন্যদিকে আজ রাত ৯টার দিকে ঢাকায় পৌঁছাবেন ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। দুই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিআইপি) ঢাকা সফর নিয়ে কূটনীতিক অঙ্গনে এখন ভীষণ ব্যস্ততা।

বাংলাদেশ সফর শেষ করে গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকা ছেড়েছেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি হিসেবে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটিই তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। গত দুই বছরে তাঁর বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা একাধিকবার শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। গত বছরের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তরে বৈঠক করার সময় হিলারিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

সে সময় তিনি ২০১২ সালের কোনো একসময় বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। চীন ও ভারত সফরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে আসছেন। হিলারি ঢাকা সফরে ৪০ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেকের সঙ্গে আরো একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল ঢাকায় পৌঁছেছেন। আজ হিলারির নেতৃত্বে আসছেন ৩৮ জন।

এর মধ্যে ১৪ জন সাংবাদিক রয়েছেন বলে জানা গেছে। হিলারি ঢাকায় কোন হোটেলে থাকছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো তা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি। তারা ধারণা করছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েস্টিন বা র্যা ডিসন হোটেলের কোনো একটিতে আজ রাত্রিযাপন করবেন। সর্বশেষ সফরসূচি অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে তিনি পৌঁছাবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে প্রথমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে।

এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হতে পারে। হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত সংলাপের ব্যাপারে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নিজ নিজ দেশের পক্ষে ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করবেন বলে জানা গেছে। হিলারি ক্লিনটন কাল রবিবার সকাল পৌনে ৯টায় যাবেন বারিধারায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে।

সেখান থেকে ১০টার দিকে আসবেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে। ১০টা ২৫ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত হিলারির কার্যসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ সময় তিনি সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন বলে জানা গেছে। দুপুর সোয়া ১২টায় তিনি কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে। প্রণব আসছেন রাতে : সফরসূচি কয়েক দফা রদবদলের পর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ শনিবার রাত ৯টার দিকে ফিলিপাইনের ম্যানিলা থেকে ঢাকায় পৌঁছাবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

একই বিমানে আসছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। রবিবার তাঁদের দুজনের প্রাতরাশ বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ভারতের অর্থমন্ত্রী রবিবার সকাল ১০টায় মধ্যে যাবেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। সেখান থেকে দুপুর ১২টার দিকে তিনি গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

গণভবনেই মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিয়ে প্রণব যাবেন সোনারগাঁও হোটেলে। সেখানে বিকেল ৩টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর প্রণব মুখোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে দেখা করবেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ওই সফরে দুই দেশের সামগ্রিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ হবে।

বাংলাদেশ তা করবে। এ ছাড়া ৭ মে দিল্লিতে যৌথ কমিশনের বৈঠকে সামগ্রিক সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা হবে। এতে বাণিজ্য, সংযোগ (কানেকটিভিটি), সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ সব ইস্যুতে আলোচনা হবে। সফল পররাষ্ট্রনীতি: শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে। একই সালে ২১ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনে ৬৭তম স্টেট-সেক্রেটারি বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন হিলারি রডহাম ক্লিনটন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে আজ বাংলাদেশ সফরে আসছেন হিলারি। ত্রিদেশীয় এ সফরে চীন থেকে বাংলাদেশ এরপর ভারত যাবেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম হলেও হিলারি এর আগে ১৯৯৫ ও ২০০০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ বছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে তিনি বাংলাদেশিদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। তার সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে আমরা মনে করি।

হিলারি রডহাম ক্লিনটন ওবামা প্রশাসনে যোগ দেওয়ার আগে আইনজীবী, অ্যাটর্নি (সরকারি উকিল), ফার্স্ট লেডি এবং সিনেটর ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন। নিউইয়র্ক থেকে সিনেটর ছিলেন ২০০০ থেকে ২০০৯। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমেরিকার ফার্স্ট লেডি ছিলেন। আরাকানসাসের ফার্স্ট লেডি ছিলেন দুবার; বিল ক্লিনটন গভর্নর থাকাকালে- ১৯৭৯-১৯৮১ এবং ১৯৮৩-১৯৯২ পর্যন্ত।

১৯৬৮ থেকে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জড়িত। ১৯৭৩ সালে ইয়েল ল স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে আইনি পেশায় নিযুক্ত হন হিলারি। ১৯৭৫ সালে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৯৭৯ সালের মধ্যেই তিনি আমেরিকার ১০০ জন প্রভাবশালী আইনজীবীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পান। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফার্স্ট লেডি হিসেবেও তিনি জনগণের জন্য কাজ করেছেন।

১৯৯৮ সালে বিলের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে সৃষ্ট দুঃসহ মুহূর্তগুলো মানসিক শক্তি দিয়ে কাটিয়ে উঠেছেন। বুশ প্রশাসনকে সহায়তা করেছেন; ইরাক যুদ্ধের দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে সজাগ থেকেছেন। ১৯৯৫ সালে বেজিং-এ তিনি বিখ্যাত একটি উক্তি করেন; এটি হলো '' নারীর অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হিলারি গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। ২০০০ সালে তিনি মার্কিন সিনেটে সিনেটর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। নিউইয়র্কে একজন নারীর সরাসরি সিনেটে নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস এর আগে ছিল না।

সিনেটর হিসেবে তিনি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি ফের সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালান। তবে ২০০৮ সালে বারাক ওবামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন এবং ওবামা প্রশাসনের স্টেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।

হিলারি অনেকগুলো বেস্ট সেলার গ্রন্থের লেখক। তার 'লিভিং হিস্টোরি' এবং 'টেকস এ ভিলেজ' উল্লেখযোগ্য। আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদের সমন্বয়ে তৈরি হিলারির ব্যক্তিত্ব তাবৎ বিশ্বে আজ অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ও অরাজকতার পরপরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসছেন। কূটনৈতিক মহল তার জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, হিলারির ঢাকা সফরকালে টিকফা চুক্তি ছাড়াও প্রাধান্য পাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়। কারণ গত কয়েক বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঘুরে ফিরেই ছিল প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) এবং সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার ইস্যু। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বড় পরিসরে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি করতেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে একটি ফোরাম গড়ে উঠবে এবং দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত এবং মোকাবেলা করা যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং গত বছর এ দু'দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৬০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছে। হিলারির সফর দুদেশের মধ্যে ব্যাপক ও বৃহৎ পরিসরে সম্পর্ক গড়ে তোলার সোপান। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্যসহ আরো বেশকিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তার সফর কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসা হচ্ছে অনেক আগে থেকে। সেখানকার বস্ত্রখাতের চাপে এবং বিষয়টি মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদনের প্রয়োজন বলে সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। অন্যদিকে মালবাহী জাহাজ প্রস্তুতকারক হিসেবে, তথ্য-প্রযুক্তিতে, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরিতে, সমুদ্রজাত খাদ্য রপ্তানিতে, রেশম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে, ভবিষ্যতে পাট তন্তুর নতুন নতুন ব্যবহারে বিশ্বের অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হবে এ দেশ। হিলারির সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান কনোকো-ফিলিপসের কার্যক্রম আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ্য, তারা বঙ্গোপসাগরের ১০ ও ১১ নাম্বার বস্নকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ নিয়েছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর অন্য ছয়টি বস্নকেও অনুসন্ধান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া গত মাসে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম নিরাপত্তা সংলাপ হয়। সেসময় ঢাকা আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী সেক্রেটারি অ্যান্ডু্র শাপিরো। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আজ স্পষ্ট। সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তা দিতেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সম্প্রতি নিরাপত্তা সহযোগিতা বিষয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সংলাপও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সংলাপে বাংলাদেশের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে বর্তমান সরকারের গ্রিন সিগন্যালও নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে হিলারির এই সফর উভয় দেশের জন্য তাৎপর্যবহ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির সাফল্যের স্বাক্ষর হিলারির সফর।

একইভাবে একই সময়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সফর সূচিও গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে ঢাকা সফর করছেন জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা। এছাড়া ভারতের স্পিকার মীরা কুমারের নেতৃত্বে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলেরও এ মাসের শেষ দিকে ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিশ্ব নেতাদের পৃথক সফরগুলোকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। তবে বেশ কয়েকবার হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের কথা উঠলেও তা আর হয়ে ওঠেনি।

অনেকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণের বিষয়টি। তাই থমকে ছিল হিলারির ঢাকা সফরও। ধারণা করা হয়েছিল, বর্তমান সরকারের মেয়াদে হিলারির আর ঢাকা সফর হবে না। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। সব ধারণাকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়েই হিলারি বাংলাদেশে আসছেন।

নিঃসন্দেহে এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করবে। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামল ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য ছিল। সে সময় বিশ্ব নেতাদের উপস্থিতি বাংলাদেশের জনজীবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা তথা বিশ্বের স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা আর ইয়াসির আরাফাতের মতো ব্যক্তিত্ব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও এদেশ সফর করেন।

আবার মার্কিন সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সে-দেশ সফর করেন ২০০০ সালে। বর্তমান সময়ের মতো তখনো শেখ হাসিনা আঞ্চলিক ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছিলেন। এনটিপি, সিটিবিটি, ভূমি মাইন বিরোধী চুক্তি এবং রাসায়নিক অস্ত্র বিরোধী সমঝোতা অনুমোদন করেন তিনি। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষার পর দুদেশের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টায় দেশ দুটিতে ভ্রমণ করেন তিনি। তার আমলেই একুশে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষিত হয়।

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বশান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়' এই নীতির আলোকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে বর্তমান সরকার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করে চলেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বহুমুখী সহযোগিতা জোরদার হয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সফল দেশ হিসেবে পরিগণিত বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার হয়েছে। অর্থাৎ ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে শপথ গ্রহণের পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এক বছরের মধ্যে পররাষ্ট্র নীতিতে সাফল্য অর্জন করেছে। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমন করে ট্রান্সপারেন্সি অব ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির তালিকায় ২০০ দেশের মধ্যে ১৩তম অবস্থানে এসেছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ধর্মান্ধ জঙ্গীবাদের দায়ে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ তালিকাভুক্ত করেছিল গত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে। মহাজোট সরকারের এক বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের পর্যবেক্ষণ তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দিয়েছে।

এ বিষয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতিতে জঙ্গীবাদবিরোধী তৎপরতায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ভূমিকায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। উপরোন্তু সাউথ এশিয়া অ্যানালাইসিস গ্রুপের বিশেষজ্ঞ কলামিস্টরা ওয়েব ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকায় ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এদের একটি প্রতিবেদন ছিল 'বাংলাদেশ কামিং ইন লাইট'। এখানে বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গিবাদ, বোমাবাজ, গ্রেনেড হামলার আমল শেষে দেশের পরিস্থিতি আলোর ধারায় ফিরে আসার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে জেএমবি জঙ্গীনেতা বাংলা ভাইয়ের সশস্ত্র উত্থান যুক্তরাষ্টের জন্যও হুমকিস্বরূপ ছিল।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া সরকারের সেই সাফল্যকে বড় করে দেখেছে। তাই আজ হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসছেন। তাকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার চায় বাংলাদেশ: ২০০০ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বিল ক্লিনটন। ওই সময় তার সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের সুবিধা চেয়েছিলেন বর্তমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাতে কোনো কাজ হয়নি। অবশ্য ক্লিনটন এ ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতিও দেননি। এক যুগ পর ক্লিনটনের স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আজ বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাঁর সফরের পাঁচ দিন আগে ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সামনে আবারও একই দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কারণ বাংলাদেশের এ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি যে বিলে আছে, সেই নিউ পার্টনারশিপ ফর ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট (এনপিটিডিএ)-২০০৯ এখনো পাসের কোনো উদ্যোগ নেয়নি দেশটি।

বরং মার্কিন কংগ্রেসে ওঠা ওই বিলটিই তামাদি হয়ে গেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস বা জিএসপির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বল্পোন্নত বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ দিয়েছে। উন্নয়নশীল ভারতও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে এ সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র এ সুবিধা দিচ্ছে।

ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বছরে যে পরিমাণ ঋণ ও অনুদান দেয়, তার চেয়ে বেশি নেয় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক আদায় করে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে যে পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় সেখানে শুল্ক বসিয়েই দেশটি বছরে আদায় করে নিচ্ছে ৬০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন পেতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির প্রতিনিধিসহ সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকরা মার্কিন কংগ্রেসম্যান জিম ম্যাকডরমেট, সিনেটর গ্রেসলি, কটন কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের কার্যকরী প্রেসিডেন্ট, সিনেট ফিন্যান্স কমিটি ও ওয়েজ অ্যান্ড মিনস কমিটির সিনিয়র স্টাফস, ইউএসটিআর কর্মকর্তা, আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রম সংগঠন দ্য আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার অ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনস (এএফএল-সিআইও) নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জোরালো যুক্তি তুলে ধরা হয়। তাতেও কোনো ফল আসেনি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, কংগ্রেসে পরপর তিনটি বিল ওঠে।

সর্বশেষ বিলটি ওঠার পর গত দুই বছরে কোনো কিছু না হওয়ায় সর্বশেষ বিলটিও তামাদি হয়ে গেছে। তাই মার্কিন কংগ্রেসে এখন এ বিষয়ে আর কোনো বিল নেই। তিনি বলেন, যেহেতু হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাই সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে যাতে বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত সুবিধা দিতে আবারও এ ধরনের একটি বিল কংগ্রেসে উত্থাপন করার ক্ষেত্রে তিনি ভূমিকা রাখেন। ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট (টিকফা) চুক্তি হওয়ার পথে।

তাই সরকার এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার বিষয়টিও জোরালোভাবে হিলারির কাছে তুলে ধরতে পারে। তিনি বলেন, একসঙ্গে দেশের সব পণ্যের ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া গেলেও যাতে অর্ধেক পণ্যের ক্ষেত্রে অথবা সব পণ্যের শুল্কহার কমানো যায় সে বিষয়ে অনুরোধ করা যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরই বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজারের পরিমাণ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক।

এসব পোশাকের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধাও প্রযোজ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকগুলোর বেশির ভাগেরই ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যে ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ যত পণ্য রপ্তানি করে তার ৯৪ শতাংশের ওপর শুল্ক বহাল রয়েছে। বাকি ছয় শতাংশ রপ্তানি পণ্যের কিছু জিএসপি সুবিধার আওতায় রপ্তানি হচ্ছে।

বাকি পণ্যের ওপর শূন্য শতাংশ শুল্ক বহাল রয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক দিয়েছে ৫৯০ মিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক প্রত্যাহার হলে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেক বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে এখন রপ্তানি হচ্ছে না এমন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এনপিটিডিএ বিলে বাংলাদেশ সুবিধা পেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আফ্রিকার দেশগুলোর রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো নীতিনির্ধারকের মধ্যে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ার আটটি পণ্যের ওপর কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। তামাদি হয়ে যাওয়া এনপিটিডিএ বিল অনুযায়ী ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে, প্রথমবার তার মাত্র ৫০ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। এটি বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে আফ্রিকার দেশগুলোর ৯০ শতাংশ রপ্তানি পণ্যই এর আওতায় পড়ে। তাই বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলে আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেলে আফ্রিকার বদলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের রপ্তানি বাণিজ্য সংকুচিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। চীন তার রপ্তানি পণ্যের ৩৭ শতাংশই বিক্রি করছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৪৮৭ কোটি ডলার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ব্যয় ১১৪ কোটি ডলার। আর চলতি ২০১২ সালের প্রথম দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ৯২ কোটি ডলার।

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ব্যয় হয়েছে সাত কোটি ডলার। গত দুই বছরে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে আসার সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এবার সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টার সফরে আজ শনিবার বিকেল ৪টার দিকে ঢাকায় পা রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। অন্যদিকে আজ রাত ৯টার দিকে ঢাকায় পৌঁছাবেন ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়।

দুই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিআইপি) ঢাকা সফর নিয়ে কূটনীতিক অঙ্গনে এখন ভীষণ ব্যস্ততা। বাংলাদেশ সফর শেষ করে গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকা ছেড়েছেন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি হিসেবে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটিই তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। গত দুই বছরে তাঁর বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা একাধিকবার শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি।

গত বছরের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তরে বৈঠক করার সময় হিলারিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সে সময় তিনি ২০১২ সালের কোনো একসময় বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। চীন ও ভারত সফরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে আসছেন। হিলারি ঢাকা সফরে ৪০ সদস্যের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেকের সঙ্গে আরো একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল ঢাকায় পৌঁছেছেন।

আজ হিলারির নেতৃত্বে আসছেন ৩৮ জন। এর মধ্যে ১৪ জন সাংবাদিক রয়েছেন বলে জানা গেছে। হিলারি ঢাকায় কোন হোটেলে থাকছেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো তা গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি। তারা ধারণা করছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েস্টিন বা র্যা ডিসন হোটেলের কোনো একটিতে আজ রাত্রিযাপন করবেন। সর্বশেষ সফরসূচি অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টার কিছু আগে তিনি পৌঁছাবেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে।

সেখানে প্রথমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হতে পারে। হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত সংলাপের ব্যাপারে যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নিজ নিজ দেশের পক্ষে ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করবেন বলে জানা গেছে।

হিলারি ক্লিনটন কাল রবিবার সকাল পৌনে ৯টায় যাবেন বারিধারায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে। সেখান থেকে ১০টার দিকে আসবেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে। ১০টা ২৫ মিনিট থেকে ১২টা পর্যন্ত হিলারির কার্যসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ সময় তিনি সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারেন বলে জানা গেছে। দুপুর সোয়া ১২টায় তিনি কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে।

প্রণব আসছেন রাতে : সফরসূচি কয়েক দফা রদবদলের পর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ শনিবার রাত ৯টার দিকে ফিলিপাইনের ম্যানিলা থেকে ঢাকায় পৌঁছাবেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। একই বিমানে আসছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। রবিবার তাঁদের দুজনের প্রাতরাশ বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ভারতের অর্থমন্ত্রী রবিবার সকাল ১০টায় মধ্যে যাবেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি।

সেখান থেকে দুপুর ১২টার দিকে তিনি গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। গণভবনেই মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিয়ে প্রণব যাবেন সোনারগাঁও হোটেলে। সেখানে বিকেল ৩টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এরপর প্রণব মুখোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমের কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে দেখা করবেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ঢাকা সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, রবীন্দ্র সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন।

ওই সফরে দুই দেশের সামগ্রিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার সুযোগ হবে। বাংলাদেশ তা করবে। এ ছাড়া ৭ মে দিল্লিতে যৌথ কমিশনের বৈঠকে সামগ্রিক সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনা হবে। এতে বাণিজ্য, সংযোগ (কানেকটিভিটি), সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ সব ইস্যুতে আলোচনা হবে। সফল পররাষ্ট্রনীতি: শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে।

একই সালে ২১ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনে ৬৭তম স্টেট-সেক্রেটারি বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন হিলারি রডহাম ক্লিনটন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে আজ বাংলাদেশ সফরে আসছেন হিলারি। ত্রিদেশীয় এ সফরে চীন থেকে বাংলাদেশ এরপর ভারত যাবেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম হলেও হিলারি এর আগে ১৯৯৫ ও ২০০০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এ বছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে তিনি বাংলাদেশিদের শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন।

তার সফর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে আমরা মনে করি। হিলারি রডহাম ক্লিনটন ওবামা প্রশাসনে যোগ দেওয়ার আগে আইনজীবী, অ্যাটর্নি (সরকারি উকিল), ফার্স্ট লেডি এবং সিনেটর ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন। নিউইয়র্ক থেকে সিনেটর ছিলেন ২০০০ থেকে ২০০৯। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমেরিকার ফার্স্ট লেডি ছিলেন।

আরাকানসাসের ফার্স্ট লেডি ছিলেন দুবার; বিল ক্লিনটন গভর্নর থাকাকালে- ১৯৭৯-১৯৮১ এবং ১৯৮৩-১৯৯২ পর্যন্ত। ১৯৬৮ থেকে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জড়িত। ১৯৭৩ সালে ইয়েল ল স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে আইনি পেশায় নিযুক্ত হন হিলারি। ১৯৭৫ সালে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। ১৯৭৯ সালের মধ্যেই তিনি আমেরিকার ১০০ জন প্রভাবশালী আইনজীবীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পান।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফার্স্ট লেডি হিসেবেও তিনি জনগণের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে বিলের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে সৃষ্ট দুঃসহ মুহূর্তগুলো মানসিক শক্তি দিয়ে কাটিয়ে উঠেছেন। বুশ প্রশাসনকে সহায়তা করেছেন; ইরাক যুদ্ধের দিনগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে সজাগ থেকেছেন। ১৯৯৫ সালে বেজিং-এ তিনি বিখ্যাত একটি উক্তি করেন; এটি হলো '' নারীর অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হিলারি গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। ২০০০ সালে তিনি মার্কিন সিনেটে সিনেটর নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

নিউইয়র্কে একজন নারীর সরাসরি সিনেটে নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস এর আগে ছিল না। সিনেটর হিসেবে তিনি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি ফের সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালান।

তবে ২০০৮ সালে বারাক ওবামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন এবং ওবামা প্রশাসনের স্টেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। হিলারি অনেকগুলো বেস্ট সেলার গ্রন্থের লেখক। তার 'লিভিং হিস্টোরি' এবং 'টেকস এ ভিলেজ' উল্লেখযোগ্য। আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিদের সমন্বয়ে তৈরি হিলারির ব্যক্তিত্ব তাবৎ বিশ্বে আজ অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ও অরাজকতার পরপরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে আসছেন।

কূটনৈতিক মহল তার জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, হিলারির ঢাকা সফরকালে টিকফা চুক্তি ছাড়াও প্রাধান্য পাবে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়। কারণ গত কয়েক বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঘুরে ফিরেই ছিল প্রস্তাবিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) এবং সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার ইস্যু। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাতে বড় পরিসরে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি করতেও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে। টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।

এর ফলে একটি ফোরাম গড়ে উঠবে এবং দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত এবং মোকাবেলা করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।