বিয়ে হলো বাসর হলো না
বিজয়কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। জয় নিরুপায়। সাথে নববধূ বিজয়িনী। বিজয়িনী কিছুই জানতে পারেনি। সে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।
নতুন পথে সে চলতে পারে না। কারো হাত ধরে চলতে হয়। বিজয়িনীকে নিয়ে জয় নিজের বাড়িতে এলো। বাবাকে বলল, “বাবা আমি বিয়ে করেছি। ”
“ও।
” একটু নীরব থেকে, “ভালো কথা। তোমার বিয়ে তুমি করেছো। তাতে আমাদের কি প্রয়োজন?”
“বাবা, আমি নিরুপায়। ”
“যাক, এখনতো উপায় করেছো। বেশ ভালোই হয়েছে।
”
জয়ন্ত বাবুর কণ্ঠস্বর নরম কিন্তু গভীর। শ্যামাদেবীও হয়তো রাগে নিচে না নেমে সিঁড়ির কোণা থেকে ফিরে গেছেন। নিচেই নামলেন না।
সন্ধ্যা নিচে নেমে এলো।
“দাদা, এতো দিনে তোমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।
”
“সন্ধ্যা, ও অন্ধ। ”
“দাদা! তুমি এ কি করলে?”
“কেন? তুই অন্ধ হলে কি তোর ঘর বাঁধার সাধ জাগতো না? ওর চোখ দু'টো অন্ধ মনটা অন্ধ নয়। অন্তত ভালোবাসতে পারবে। ”
“দাদা, যে অন্ধ তার কোন পথ নেই। কারো পদধ্বনি অনুসরণ করে তাকে চলতে হয়।
আর অজান্তে ভালোবাসা সেতো উলোট-পালট পৃথিবী। ”
সন্ধ্যা আস্তে আস্তে বিজয়িনীর কাছে এলো। ডান হাতটা ধরে, “বৌদি এসো। ”
বিজয়িনীকে দোতলায় নিয়ে এলো। বলল, “বৌদি, কি নাম তোমার?”
“বিজয়িনী।
”
“নামটা কে দিয়েছে?”
“জানি না। ”
“আমি তোমার নাম দিলাম ‘তমসা’। বাবা-মা হয়তো কোন নামেই তোমাকে ডাকবে না। দাদাতো বিজয়িনী নামেই ডাকবে। আপাতত আমিই তোমাকে এ নামে ডাকব।
আমার নাম সন্ধ্যা। প্রায় তমসার কাছাকাছি। ”
“তুমি কেন আমার কাছে যাবে?”
“তা না হলে তুমি যে নিরুপায়। যাক্ বাজে প্যাঁচাল। বল তুমি কি ভালোবাস?”
“দিবাকরের আলো দেখতে।
”
“স্বপ্নে না অনুভবে?”
“বাস্তবে। তবে আমি গান গাইতে ভালোবাসি। ”
“ভালো। বাবাও খুব গান পছন্দ করে। তবে তোমার গান পছন্দ করবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
”
“সে-কি? গানতো গানই। ”
“সে উনার ব্যাপার। ”
“তোমাদের বাড়িতে মন্দির নাই?”
“না। ”
“আমি যে প্রতি দিন পূজা করি। ”
“কেন? এখানে দিতে পারবে না? তোমার কাছেতো সবই মন্দির।
”
“তবু, জানতে ইচ্ছে হলো। ”
সন্ধ্যা ভাবল, বৌদিকে হয়তো মন্দিরে যেতে দেবে না। কিন্তু অন্ধেরতো একটা সান্ত্বনা চাই। নীরবে মনে মনে কথা বলার জন্য। সাধনা যে তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
আশ্রমই তার একমাত্র আশ্রয়। সন্ধ্যা ক্ষণিক ভেবে বলল, “ঠিক আছে তোমাকে একটা ফটো স্থাপন করে দেব আর আমি প্রতিদিন সকালে ফুল এনে দেব। তুমি থাকো আমি নিচে যাচ্ছি। ”
“আমাকে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে যাও। ”
“তুমি দেখবে?”
“আমি যেখান দিয়ে একবার যেতে পারি সে পথ দিয়েই আবার ফিরতে পারি।
”
“আমি নিচে থেকে একটু আসি। ”
রাত্রি নেমে এলো। তমসা সম্পূর্ণ একাকিনী। ঘরের কোণায় বসে আছে। সেই বন বাদারের মেয়ে তমসা।
ঝিঁঝির ডাকে যে ঘুমে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে। ফুল বাগানের কিনার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল পৃথিবীটা খুবই ছোট। চোখ না থাকলেও সে এ পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবে। পৃথিবীর সব পথই তার চেনা। অথচ্,সে ছোট্ট একটা ঘরের কোণায় বন্ধী।
তার সামনে কি তাও সে জানে না। মনে হয় কোন দিন এ পৃথিবী সে দেখেনি। আজ যেন তার প্রথম জন্ম হলো। হঠাৎ পায়ের শব্দ হলো। তমসা বুঝল জয় আসছে।
কারণ, এ পদক্ষেপ সন্ধ্যার মত চঞ্চল নয়। আস্তে আস্তে দাঁড়াল।
“ঠিক আছে তোমাকে উঠতে হবে না। ”
“আমার কেমন যেন ভয় করছে। ”
“কিসের?”
“আঁধারের।
”
“তুমি কি কখনও আলোর সন্ধান পেয়েছো?”
“চোখ না থাকলেই অন্ধ। যারা চোখ থাকতে দেখে না?”
খানিক ক্ষণ নীরবে থাকল। বিজয়িনী বলল, “ভুল পথে চলেল তার পথ যে বেড়ে যায়। কারণ, ঠিক পথে চলতে হলে তাকে আবার সে পথে ফিরে আসতে হবে। ”
“তুমি কি ঠিক পথে এসেছে?”
“আমিতো পথই চিনি না।
অন্যের হাত ধরে চলি। বাবার হাত ধরে চলতে চলতে তোমার হাত ধরেছি। ”
“কেমন লাগছে আমাদের বাড়ি?”
“ভালো। জানো? সন্ধ্যা আমার একটা নাম দিয়েছে, ‘তমসা। ”
জয় দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে, “আর কি নাম দেবে।
তুমিতো ওখানেই আছো। জানো আমি কোন দিন বাবার অবাধ্য হইনি। হঠাৎ করে কি যেন হয়ে গেল। তাই একটা সপথ নিয়েছি। ”
“আমাকে বলবে না?”
“তুমি সহ্য করতে পারবে না।
”
“সহ্য করতে পারব না?”
“না। ”
“আমার কি আছে আমি জানি না। আমি জানি, আমি অন্ধ। শুধু জানি আমার হাত আছে তোমার হাতে। তুমি ছাড়া আমার পৃথিবীতে আর কোন পরিবর্তন নেই।
সব কিছু থাকলেও যেমন না থাকলেও তেমন। ”
“তবে কথা দাও; আমার কথা রাখবে?”
“তোমার জন্য একটা কথা কেন চোখের মত আমার মুখের কথাও বন্ধ করে দিতে পারি। শুধু প্রার্থনা তোমার পথে হাত ধরে নিয়ে যাবে। ”
“আমি ভাবছি যত দিন পর্যন্ত বাবাকে রাজি করাতে না পারব ততদিন আমাদের বাসর হবে না। ”
“বাসর হবে না!”
তমসা যেন থম থম আঁধারে থমকে দাঁড়াল।
মনে মনে বলল, “ভগবান, সারা জীবনই তোমার পূজা করে গেলাম। জন্মে জন্মেই যেন করতে পারি। আমাকে যদি কিছু দিতে ইচ্ছে হয় দিওনা তোমার কাছেই রেখ। ”
“কি ভাবছো?”
“না, কিছু না। ভাবছি তোমার পাওয়ার না হয় এতটুকুও পাওনা থাকল।
আমিতো রাত্রি। দিনের শত গঞ্জনাকে তোমার বুকে মাথা রেখে ফুরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম পরবর্তী রাত্রের। কিন্তু আমারতো রাত একটাই দিনের গঞ্জনা কোথায় পাব। ”
“বিজয়িনী, তোমার চোখের জল বড় কোমল।
তুমিতো বিজয়িনী। বাবা-মাকে জয় করা তোমার কাছে সামান্য। ”
“জয়, আমি অন্ধ। নিজেকেই জয় করতে পারি না। বাবা-মাকে কি দিয়ে জয় করব?”
“ভালোবাসা দিয়ে।
”
“এতো ভালোবাসা আমি কোথায় পাব?”
“আমি দেব। ”
“একটা অনুরোধ করব, রাখবে?”
“বল। ”
“আজতো আমাদের বাসর। জীবনের সবচেয়ে মধুময় রাত। শুধু তোমার বুখে একটু মাথা রাখি।
আমি আর কিছুই চাইব না। আমার বাসর নাইবা হলো। তোমাকে আমি আমার বলে পেয়েছি সেই অনেক। ”
জয় তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। জয়ের বুকে মাথা রেখে বিজয়িনী বলল, “জয়, এই হলো আমার জীবনের আলিঙ্গন।
তুমি না চাইলে তোমাকে আমি স্পর্শও করব না। না হয় এটাই হবে আমার চিরকালের আরতি। ”
“তুমি এখানে ঘুমায়। আমি পাশের ঘরে আছি। কোন কিছুর দরকার হলে এটা চাপ দিও।
আমার ঘরে কলিংবেল বেজে উঠবে। ”
বিজয়িনীকে শুয়ে দিয়ে জয় চলে গেল।
সকালে সন্ধ্যা ফুল এনে, “বৌদি, তোমার দেবতার জন্য আমার ফুল। ”
বিজয়িনী পূজা সেরে, জয়ন্ত বাবুর দরজার কাছে দাঁড়াল।
“কে?”
“আমি বাবা।
”
“কেন?”
“প্রতিদিন পূজা করে বাবাকে প্রণাম করি আজও এলাম। ”
“ঠিক আছে এখানে আসা দরকার নেই। ”
বিজয়িনী দু’টো পা ঘরের মধ্যে নিয়ে কিছু দূর থেকেই জয়ন্ত বাবুকে একটা প্রণাম করল। ফিরতেই সন্ধ্যার সাথে ধাক্কা খেল।
“কোথায় গিয়েছিলে?”
“বাবাকে প্রণাম করতে।
”
“ফল হলো?”
“কি জানি; আমি ওতো বুঝি না। ”
সন্ধ্যা বিজয়িনীকে নিয়ে আবার বাবার কাছে গেল। বলল, “বাবা, একবার দেখ। এমন রূপ তোমার মন্দিরের দেবতারও নেই। ওকে সাজাতে তোমার দেবতার ঈর্ষা জন্মেছিল তাই সব কিছু দিয়েও কিছুই দিল না।
তোমার দেবতা শুধু দেখে শোনে না আর তমসা শোনে দেখে না। ওকে ফাঁকি দিলে কোন লাভ হবে না। ”
সন্ধ্যা বিজয়িনীকে তার ঘরে নিয়ে এলো। বলল, “তুমিতো সারা জীবনই পরের পায়ের কাছে বসে গেলে আমি একটু তোমার পায়ের কাছে বসি?”
“কি মতলব?”
“কোন মতলব নেই। বল, আমি যা চাইব দেবে?”
“আমি কি এতোই ধনী?”
“ধন থাকলেই ধনী হয় না।
তাছাড়া ধন দিতে হলে মন থাকা দরকার। ”
“বল তবে। দেখি, কি ধন দিতে পারি। ”
“তোমার দেবতার কাছে আমার একটা প্রার্থনা রাখতে হবে। আমি বলতে না পেরে মনে মনে যাকে চেয়ে গেলাম তাকেই যেন পাই।
”
“চাইলেই কি পাওয়া যায়? আর দেবতা; সেতো অনেক দূরের। জানো কি বোন? পূজা করে দেবতাকে পাওয়া যায় না। দেবতাকে যারা পায় এমনিতেই পায়। আমরা শুধু অজীবন পূজা করেই যাব, দেবতাকে পাব না। জানতে পারি, কি নাম তার? কে সে রাজকুমার?”
“বিজয়।
দাদার বন্ধু। সে আমাকে বোনের মত দেখে অথচ্ মনে মনে সারা জীবন আমি তার পূজা করে এসেছি। কাউকে কোন দিন বলতে পারিনি। ”
“পূজা করে যাও একদিন প্রসাদ মিলবে। ”
“আমিতো প্রসাদ চাইনা, দেবতাকে চাই।
”
“প্রসাদ পেলেই দেবতাকে পাওয়ার মত একটা গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ”
“কোনদিন কাউকে যেন বল না। ”
“বিজয়কেও না?”
“না, বৌদি। এমন ভুল তুমি কর না। ”
“তবে পাবে কি করে?”
“ভালোবাসার সাধনা করে।
”
“তোমার ঘরেও কি মন্দির আছে না-কি?”
“তুমি আমার মন্দির। ”
“মন্দির না প্রতিমা। ”
“প্রতিমাতো নির্বাক। ”
“আমি ওতো অন্ধ। ”
“কিন্তু দেখ।
প্রতিমার চোখ থাকতেও দেখে না। আর এতো সুন্দর হাসি ফোটা ঠোঁট তাতে একটা কথাও বলে না। ”
“আমি কি তাই নয়?”
“তুমি নিতে না জানলেও দিতে জান। দেওয়ার মাঝেইতো আনন্দ। বৌদি, তোমাকে যদি একটা কিছু দেই তুমি নেবে?”
“যদি হারিয়ে ফেলি? তার চেয়ে তোমার কাছেই থাক।
”
“দাদা, আসছে আমি যাই। ”
জয় ঘরে ঢুকতেই, “তোমাকে না বারণ করেছি, তুমি দাঁড়াবে না। ”
“কেন জানি তোমার এ কথাটি রাখতে পারি না। ”
কাছে বসে, “বিজয়িনী, তুমি আমার উপর রাগ কর?”
“কেন বলোতো ? কোনদিন কি আমার মুখে সে ছাপ দেখেছো?”
“না। এমনিতেই বলছি।
বাবা-মা কেউ তোমাকে মেনে নিতে পারে না। ”
“আমাকে দেখে যদি কারো পছন্দ না হয় কেন আমাকে মেনে নেবে?”
“বিজয়িনী, মন দূরে থাকলে কাউকেই সুন্দর দেখায় না। ”
“আমি কি সুন্দর?”
“তা হয়তো আমি জানি না। ”
“একটা কথা বলি। ”
“বল।
”
“বাবার পছন্দ মত আবার তুমি বিয়ে কর। ”
“বিজয়িনী। ”
“আমার জন্য তুমি কেন কষ্ট করবে?”
“তোমারও সুখ শান্তি সান্ত্বনা নিয়ে জন্ম হয়েছে। সুখ না হয় আমি না দিতে পারব দুঃখকেতো ভাগ করে নিতে পারব। ”
“আমারতো কষ্টের জন্যই জন্ম হয়েছে।
”
“আমার হয়তো সে জন্য জন্ম হয়নি। কিন্তু কাউকে কষ্ট দেয়া আমার ধর্ম না। আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। তুমি সাবধানে থাকবে। ”
“কবে ফিরবে?”
“তিন চার দিনে।
”
জয় চলে গেল। বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। বিজয়িনীর বড় ভয় করছে। জয়ন্ত বাবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, “বাবা, আসি। ”
“কেন?”
“ও ঘরে একাকা তাই ভয় করছে।
”
“আমি কি করব?”
“কি আর করবেন। আপনার পাশে একটু বসি?”
বিজয়িনী ঘরে ঢুকে গেল। জয়ন্ত বাবু পা গুটিয়ে নিল। বিজয়িনী বুঝতে পারল না। ”
“বাবা, জানেন; গান্ধারী কখন তার শত পুত্রের মুখ দেখেছিল?”
জয়ন্ত বাবু বিজয়িনীর দিকে তাকিয়ে আছে।
“যখন তারা সবাই মরে গিয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্রে এসে গান্ধারী সর্ব প্রথম তার শত পুত্রের মুখ দেখেছিল। অথচ্ সে অন্ধ ছিল না। ”
জয়ন্ত বাবু বিরক্তবোধ করল। তবু কথাগুলো খেয়াল করে শুনল।
বিজয়িনী আবার বলল, “বাবা, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? আমাদের একটা মন্দির তৈরি করেন। আমি আর কিছু চাইব না। আপনারা যা বলবেন আমি তাই শুনব। তবে চলে যেতে বলবেন না। জানি আপনারা আমাকে পছন্দ করেন না।
যদি পারেন আপনার ছেলেকে আবার বিয়ে দিন। আমি বারণ করব না। ”
বিজয়িনীর চোখে জল। আস্তে আস্তে তা গড়িয়ে গেল। দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
পিছন দিকে একবার ফিরে আবার চলে গেল। জয়ন্ত বাবুর মনটা যেন একটু গলে গেল। মনে মনে বলল, “আমাদের বাড়িতে মন্দির আছে তাও তাকে জানায়নি। ঠিকই করেছে। হয়তো আমরা ওকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দিতাম না।
জয়ন্ত বাবু স্ত্রীকে ডাকলেন, “সুপ্রিয়া। ”
“কি?”
“মেয়েটাকে মন্দির দেখিয়ে দাও। ”
সুপ্রিয়া বিজয়িনীর দরজার কাছে এসে, “শোন। ”
“কে? মা। ” বিজয়িনী উঠে দাঁড়াল।
“এসো। ”
“কোথায়?”
“মন্দিরে। ”
“মন্দিরে?”
“হ্যাঁ। ”
“আমি পরের মন্দিরে পূজা দিতে জানি না। ”
“আমাদের মন্দির।
”
“আমাদের মন্দির?”
“হ্যাঁ। তোমাকে হয়তো যেতে দিত না। তাই মিথ্যা বলেছিল। ”
“জানেন না? আজ থেকে উনিশ বছর আগের এক পূর্ণিমার রাত্রে শিব মন্দিরে আমার জন্ম হয়েছিল আমাবস্যা হয়ে। আমি গেলে যদি আমাদের মন্দিরের ক্ষতি হয় তবে আমাকে নিয়েন না।
এ ঘরই আমার কাছে মন্দির। দেবতা নাইবা আসুক পূজা করার মত অধিকার আমার আছে। আমি অন্ধ। সবার করুণার পাত্র। ভগবান আমাকে দেখার অধিকার দেননি।
কিন্তু কেন? কি দোষ আমি করেছিলাম? কেন এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ আমি দেখতে পেলাম না? জন্ম হয়েও আমি সেই মাতৃ গর্ভেই রয়ে গেলাম। ক্ষমা আমাকে কোন দিনই আপনারা করবেন না তা আমি জানি। কিন্তু আমিতো কোন অপরাধ করিনি। অপরাধ যদি হয়েই থাকে সে আপনার ছেলে করেছে। ” চোখের জল মুছে, “মা, আমাদের কিসের মন্দির?”
“শ্যাম মন্দির।
”
“জানেন না? শিবের সাথে শ্যামের একদিন যুদ্ধ হয়েছিল। ”
“কে জিতেছিল?”
“শ্যামই জিতেছিল। ”
সুপ্রিয়া বিজয়িনীকে মন্দিরে নিয়ে গেল।
“মা, মন্দির কেন পশ্চিম দিকে?”
“তুমি দেখতে পাও?”
“না। ”
“সবগুলি দিকইতো তার।
”
বিজয়িনী ফুল পাতা সাজিয়ে ঊলূর ধ্বনি দিল।
“আমরাতো ঊলূর ধ্বনি দেই না। ঠিক আছে আজ হতে তুমি দেবে সাথে ঘণ্টা ও শঙ্খ বাজাবে। ”
বিজয়িনীকে তার ঘরে রেখে গেল। জয়ন্ত বাবু বলল, “সুপ্রিয়া, ঊলূর ধ্বনি দিলে?”
“আমি না বিজয়িনী।
ওতো আর জানে না। ”
“আজ যেন সর্ব প্রথম এবাড়িতে পূজা হলো। দেখ দেবতারা সব এবাড়ির দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। ”
রাত্রে জয়ন্ত বাবুর চোখে ঘুম এলো না। মনে মনে বলল, “সত্যিকারে আমরা মেয়েটার প্রতি অবিচার করছি।
”
সকালে সুপ্রিয়া ফুল এনে, “বৌমা, ফুল। ”
এতদিন পরে বিজয়িনী যেন বধূবেশের স্বীকৃতি পেল। বলল, “মা, দাঁড়ান। ”
বিজয়িনী একটা প্রণাম করল।
“সে-কি?”
“মা, আজ আপনাকে আমার মায়ের মত লাগছে।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মা আমাকে ফেলে চলে গেল। মাকে দেখতে পারিনি। দেখার ইচ্ছেও জাগেনি। আজ আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ”
বিজয়িনী পূজা শেষ গান ধরল,
শ্যাম কালিয়া কিশোরী
কোন রূপে সাজাইলি তুই ভুবনটাকে।
তুই সাজলি যদি অরূপ রূপে
রাখলি কেন আমায় ঢেকে
ভুবন ভরা আলোর রেখা
রাখলি আমায় আঁধার পারে।
জয়ন্ত বাবু সুপ্রিয়াকে ডাকল।
“কে গান গায়?”
“বিজয়িনী। ”
“সত্যি সুপ্রিয়া ওর যেন মন্দিরেই জন্ম হয়েছিল। সারা বাড়িটা ও মন্দির করে তুলছে।
ওকে মন্দিরেই মানায়। বিজয়িনী পূজারিনী নয় প্রতিমা। এর পর বিজয়িনীর গর্ভেই যেন আমার জন্ম হয়। আমি ওকে বার বার প্রণাম করব। ”
বিজয়িনী প্রসাদের থালা নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, “বাবা, আসি?”
“মা।
”
বিজয়িনীর যেন এত সুখ সইল না। দরজায় বেঁধে পড়ে গেল। প্রসাদের থালা ছিটকে গেল বহু দূরে। সবাই বিজয়িনীকে ধরল। বিজয়িনীর ঘরে নিয়ে গেল।
সন্ধ্যা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরল। তার মুখে হারোনোর দাগ বসে গেছে। বিজয়িনীর ঘরে এসে, “বৌদি, তোমার পাওনা। ”
“সে-কি। ”
“বৌদি আমার মন্দির ভেঙ্গে গেল।
তোমার ধন রাখার মত জায়গা আর আমার নেই। ”
সন্ধ্যা একটা আংটি বিজয়িনীকে পরিয়ে দিল। বলল, “দাদাও আজ ফিরবে। ”
বিজয়িনীর শরীর আরো ক্লান্ত হয়ে উঠছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকে থাকাই তার কষ্ট হচ্ছে।
সন্ধ্যার খাণিক পরে জয় এলো। জয়ের পায়ের শব্দ বিজয়িনী বুঝতে পারল। কিন্তু ওঠার মত শক্তি আজ আর নেই। জয় পাশে বসে, “কেমন আছো বিজয়িনী?”
“কেন এত পরে এলে?”
“বলব। ”
“জানো, আমার সিঁথির সিঁদুর কেন যেন ধরে রাখতে পারছিনা।
এমনিতেই ঝরে যাচ্ছে। ”
জয় বলতে পারল না, সে তার স্বামী নয়। তার স্বামী আজ মরে গেছে। বিজয় তার বন্ধু। কৌশলে বন্ধুর আমানত রক্ষা করতে চেয়েছিল।
জয়ের সেদিনের রাতের কথা মনে পড়ল, “জয়, আমি যদি ছাড়া না পাই তুই ওকে আমার পরিচয় দিবি না। ” আজ বিজয় নেই। জয় বিজয়িনীর বাম হাতটা ধরল। দেখল একটা আংটি। বলল, “এ আংটি তোমাকে কে দিল?’
“সন্ধ্যা।
”
“জানো ওতে কি লেখা আছে?”
“না। কি লেখা আছে?”
“বিজয়। ”
“বিজয়কে ও ভালোবাসে। ”
৩রা মাঘ রবিবার ১৪১০
১৬ জানুয়ারী ২০০৫ ইং
নিজ বাড়ি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।