আমি সত্য জানতে চাই
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবিকা ৷ মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা প্রসার ও অবরোধপ্রথা রহিত করার জন্য যাঁরা জীবন উত্সর্গ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী হল শামসুন নাহার হল তার নামে নামকরণ করা হয়। দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ বেগম শামসুন নাহার মাহুদের ৪৬তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর ফেনী মহকুমার গুতুমা গ্রামে, মুন্সীবাড়ীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভী মুহাম্মদ নুরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মুন্সেফ এবং মা আছিয়া খাতুন চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী।
বেগম শামসুন নাহারের বয়স যখন ৬ মাস তখন তাঁর বাবা নুরুল্লাহ চৌধুরী হঠাৎ ইন্তেকাল করেন। ১৯০৯ সালে পিতা মোহাম্মদ নুরুল্লা মৃত্যুবরণ করলে সংসারে নেমে আসে দৈন্যের ছায়া। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর মা শিশুকন্যা নাহার ও তার ৩ বৎসরের পুত্র সন্তান বাহারকে নিয়ে পিত্রালয় চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামের তামাগুমন্ডিস্থ নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজের বাড়িতে মা ও ভাই হবীবুল্লাহ বাহারের সাথে বড় হন তিনি। দুই ভাই বোনের মধ্যে বেগম শামসুর নাহার ছোট।
বড় ভাই হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ছিলেন সাহিত্যমনা ব্যক্তিত্ব। বেগম শামসুন নাহারের মাতা আছিয়া খাতুন ছিলেন যথার্থ শিক্ষিতা। তিনি বেশ ভাল বাংলা লেখাপড়া জানতেন। এছাড়া উর্দু, আরবি ও ইংরেজিও জানতেন। ছেলেমেয়ের চরিত্র গঠনে, লেখাপড়া, আদব কায়দা, ধর্ম শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ খেয়াল ছিল।
শিক্ষা ছিল তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য। আর তাই, তিনি সেই সমাজের অবরোধের প্রাচীর ভেঙে নিজে শিক্ষিত হয়ে অসম্ভবকেও সম্ভব করেছিলেন।
(জেষ্ঠ্য ভ্রাতা হবীবুল্লাহ বাহার)
বেগম শামসুন নাহার লেখা পড়া করেন চট্রগ্রামের ডাক্তার খাস্তগীর গার্লস হাই স্কুলে। বেগম শামসুন নাহার ছিলেন পড়াশুনায় অতি আগ্রহী ও নিষ্ঠাবান। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর বাধা এল স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে।
কারণ তখনকার দিনে মেয়েরা একটু বড় হলেই পর্দা বা অবরোধের জন্য বাইরে বা কোন পুরুষের সামনে যাওয়া ছিল নিষিদ্ধ। তাই তখনকার দিনের উচ্চশিক্ষিত অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেগম শামসুন নাহার স্কুলের পড়া সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। সমাজের তাড়নায় আর আত্মীয়-স্বজনের নিন্দার ভয়ে তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য বেগম শামসুন নাহারের প্রবল আগ্রহ ও অভিবাবকদের সহযোগীতায় তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিলেন। ফল বের হলে দেখা গেল চারটি লেটারসহ প্রথম বিভাগে শতকরা আশির কাছাকাছি নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন।
ঘোর অবরোধের অন্তরালে বসে বেগম শামসুন নাহার যে কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করেছেন তা সার্থক হল। বেগম শামসুন নাহারের বিএ পাশ করা উপলক্ষে বেগম রোকেয়া এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। কিন্তু পাশ করার পর কলেজে পড়ার আর সুযোগ হল না।
বিয়ের পর স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করবেন এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৯২৬ সালে ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ শামসুন নাহারকে বিয়ে করেন। ডা. মাহমুদ তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
তিনি স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে যেমন সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তেমনি জীবনভর স্ত্রীর সব কাজে সমর্থন দিয়েছেন। বিয়ের পর বেগম শামসুর নাহার স্বামীর সাথে কলকাতায় আসেন। তিনি শুধু স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতা করেননি, সারা জীবন স্ত্রীর সব কাজেই সর্বতোভাবে সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। এভাবে স্বামীর সার্বিক সহযোগিতায় তিনি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পান। পরীক্ষা পাশের পর প্রায় ৪/৫ মাস পর ভর্তি হলেন কলকাতার প্রথম শ্রেণীর ডায়োসেশান কলেজে।
নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। ১৯২৮ সালে তিনি বিংশতিতম স্থান অধিকার করে আইএ পাশ করেন। এ সময় তাঁর প্রথম সন্তান মামুনের জন্ম হলে কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হলো না তার। ফলে কিছুদিনের জন্য তাঁর পড়াশুনায় ছেদ পড়ে। তাই বলে তিনি হতাশ হলেন না।
বাড়িতে অবসর সময়ে লেখাপড়ার চর্চা চালিয়ে যেতে লাগলেন। সংসারের দায়িত্ব পালনের সাথে যথা সময়ে পরীক্ষা দিলেন। এবারও কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি লাভ করলেন ডিস্টিংশন নিয়ে। জয়যুক্ত হল তাঁর কল্পনা ও সাধনা। এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি সমাজসেবা, সাহিত্য সাধনা ও শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত পড়া লেখা করা সম্ভব হয়নি।
তবে দীর্ঘ ১০ বছর পর ১৯৪২ সালে তিনি এম.এ. পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে শিক্ষাক্ষেত্র ও সমাজসেবার ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এমবিই উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির মেম্বার ছিলেন। এছাড়াও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার পরীক্ষক ছিলেন। বেঙ্গল বোর্ড অব সেন্সর-এর সদস্যাও ছিলেন বেশ কয়েক বছর।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে তিনি স্বামী পুত্রসহ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন এবং রাজধানী ঢাকা শহরে বসবাস শুরু করেন। শামসুন নাহার কিছুদিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্ক ও মধ্য-প্রাচ্য ভ্রমণ করেন। কলম্বোতে ইন্টারন্যাশন্যাল কাউন্সিল অব ওমেন-এ তিনি একটি দলের নেতৃত্ব দেন। সমগ্র এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ অর্গানাইজেশনে যোগ দেন।
বেগম শামসুন নাহারের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে 'পঙ্গু শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র' স্থাপিত হয়। ১৯৬২ তে তিনি গনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর উদ্যোগে এবং প্রস্তাব অনুযায়ী শিশু কল্যাণ পরিষদের তরফ থেকে প্রতিষ্ঠিত হল 'শিশু কলাভবন'। ১৯৬৩ সালে সমগ্র পাকিস্তান শিশু কল্যাণ পরিষদের সভানেত্রী নির্বাচিত হন তিনি।
অল্প বয়স থেকেই বেগম শামসুন নাহার লেখাপড়ার প্রতি যেমন আকৃষ্ট হয়েছিলেন তেমনি সাহিত্যের প্রতিও অনুরাগ জন্মেছিল তাঁর বাল্যকাল থেকেই।
সেই সময় মুহম্মহ শহীদুল্লাহর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত মাসিক পত্রিকা 'আঙুর'। এই পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যেঃ
১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয় 'পূণ্যময়ী'।
১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয় 'ফুল বাগিচা'।
১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় 'বেগম মহল'।
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় 'রোকেয়া জীবনী'।
১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় 'শিশুর শিক্ষা'।
১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয় 'আমার দেখা তুরস্ক'।
'নজরুলকে যেমন দেখেছি' প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে।
তিনি স্কুলের পাঠ্য পুস্তকও রচনা করেছিলেন, এগুলো- 'সবুজ পাঠ', 'কিশোর সাথী', 'তাজমহল পাঠ', 'নতুন তাজমহল পাঠ', 'বিচিত্র পাঠ্য' ইত্যাদি।
১৯৬১ সালের ১ নভেম্বর ডা. মাহমুদ মারা যান। স্বামীর বিয়োগ-ব্যথা শামসুন নাহারের জন্য গুরুতর হয়। মনে মনে তিনি নিঃসঙ্গ ও অসহায় বোধ করতে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেগম শামসুন নাহার ছিলেন দুই পুত্রের জননী।
তাঁর আদর্শে গড়া বড় ছেলে মামুন মাহমুদ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। তাঁর দেশাত্ববোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই বড় ছেলে মামুন মাহমুদ দেশের জন্য প্রাণ দেন।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বেগম শামসুন নাহার মাহমুদকে মরণোত্তর 'বেগম রোকেয়া পদক, ১৯৯৫' প্রদান করে। ১৯৮১ সালে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে সমাজসেবার জন্য মরনোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করেন। শামসুন নাহার মাহমুদের স্মৃতি অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রীনিবাসের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়।
আজ এই মহীযসী নারীর ৪৬তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।