আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মগের মুল্লুক ....

i m a simple boy. আগামি কাল হরতাল, সবাই এ নিয়ে বেশ চিন্তিত। বিশেষ করে যাদের ঘরে এইচএসসির পরীক্ষার্থীরা আছে তাদের বাবা-মায়েদের তো ঘুম হারাম। আর যারা খেটে খাওয়া মানুষ তারাও ঘরে বসে থাকতে পারবে না, বের হতেই হবে। সুতরাং হরতাল কে কেন্দ্র করে কিছু লোক ওত পেতে থাকে সুযোগের সৎ ব্যবহার করার জন্য। এর মধ্যে অন্যতম হল স্থলযান -বাস।

আর এই সুযোগটা আসে হরতালের ঠিক আগের দিন। মোটামুটি সবাই হরতালের দিন ঘরে বসে খবরে সবকিছু দেখে, বিশেষ কোন কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে চায় না। কিন্তু হরতালের আগের দিন তো আপনাকে অফিস বা কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরতেই হবে। আপনি নিরূপায় কিন্তু বাস ওয়ালাদের তো উপায়ান্তর এর অভাব নেই। আপনি ভাবছেন যেভাবেই হোক বাড়ি ফিরতে হবে আর তারা ভাবছে এ সুযোগে যেভাবেই হোক এদের গলায় পাড়া দিয়ে উপরি কমাইটা করতেই হবে।

এবার বাস্তব ঘটনায় প্রবেশ করি। আজকে রাত আটটা বেজেছে, মহাখালি ফ্লাইওভারের মোড় , চারিপাশে মানুষের হন্তদন্ত ছোটাছুটি । যেদিক থেকেই কোন বাস, ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, সিএনজি আসছে লোকজন দৌড়ে যাচ্ছে তার পিছুপিছু। কিন্তু তেমন একটা কূলকিনারা করতে পারছে না। কারন তাতে আগেই ঠাসা রয়েছে কোরবানীর গরূ সদৃশ মানুষেরা।

তারপরও একটু খানি যাওয়ার আশায়, বাড়িতে পৌছে একটু ডাল-ভাত খাওয়ার আশায় সাবাই ব্যার্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কেউ কেউ অবশ্য কোন একটাতে উঠে পড়তেও পারছে। যারা মহিলা, ছোট বাচ্চা সমেত পরিবার, বৃদ্ধ-ব্দ্ধা, অসুস্থ এদের যে সেই সময়টাতে কি দূর্গতি তা হয়তো সবাই নিজের নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারছেন। কারন আমি এই লিখাটা যারা গাড়িতে চড়ে এসির হাওয়া খেতে খেতে পড়ছেন তাদের উদ্দেশে লিখছিনা। আমরা সবাই খুব ভাল করেই জানি আমাদের দেশের পরিবহন ব্যাবস্খার কি হাল হকিকত।

আর কিভাবে নৈরাজ্য এবং দুনীঁতি ছেয়ে আসে এসবের মধ্যে। তারপরও জীবন যুদ্ধে আমরা পরাজিত হতে কেউ চাই না। শুধূ কিছু মানুষরূপি জানোয়ার এর ব্যতিক্রম ঘটাতে চায়। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ,গন্তব্যে পৌছানোর জন্য মানুষও আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে। এর সাথে আমিও যোগ দিলাম।

কিন্তু কোন উপায়ান্তর পেলাম না। হঠাৎ টাঙ্গাইল গামী একটা বড় বাস এসে থামলো মহাখালির মোড়ে, শত মানুষ তাতে ঝাপিয়ে পড়ল। দেখলাম কন্টাকটর হাকছে "যেখানে নামেন ৫০টাকা" মানে আপনি যদি মহখালি থেকে বনানী নামেন তাহলেও ৫০টাকা। যেখানে এই দুরুত্তের ভাড়া মাত্র ২ টাকা। দেখলাম মানুষ হুড়মুড়িয়ে তাতেও গাদাগাদি করে উঠছে।

কারন বুঝতেই পারছেন, আপনি নিরূপায়। আপনি বিপদগ্রস্থ আর সে সুযোগ সন্ধানী। আমার গন্তব্য নিকুঞ্জ, যার দুরত্ত মাত্র ৩.৮ কিলোমিটার,এবং ভাড়া লোকাল বাস-এ ৬টাকা আর বিআরটিসি বাস-এ ৭ টাকা। মাঝে মধ্যে কিছু বাস উপরি কামাই এর জন্য নিয়ে নেয় ১০টাকা। যা সাচ্ছন্দে মেনে নেয়া যায়।

কিন্তু এই ৫০টাকার কথা শুনে আমি যার পরনাই বিষ্মিত হলাম! এতো মগের মুল্লুক দেখছি। আর কেউ তো একটা টু শব্দও করছে না, মানে ১০০টাকা চাইলেও কারো কোন যায় আসে না। আমার মাথায় তখন একটেল-এর সেই বহূল প্রচলিত গালিটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। টাকা কি সত্যিই বলদের পেছন দিয়ে আসে? নাকি আমরা সবাই চুরি-ডাকাতি করে পয়সা কামাচ্ছি যে কারো কোন যায় আসে না? আমাদের নৈতিক অবক্ষয় কি এত পরিমানে হয়েছে যে কারো বিপদে আমরা সুযোগ খুজে বেড়াবো। আর আমরা এতই কাপুরূষ হয়ে গেলাম যে মুখ ফুটে কিছু বলার ও সুযোগ পাচ্ছি না।

কিছু শেণীর মানুষ যেমন ইচ্ছা করে যাবে, খেয়ে যাবে আর সাধারন মানুষদের তা মুখ বুঝে সহ্য করতে হবে? এজন্যই কি এদেশকে যারা ভালবাসবে তাদের পেছন দিয়ে বাঁশ ঢুকানো হবে? আমি এসব চিন্তা করার পরও সেই বাসটাতেই উঠলাম আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকলাম। মাথায় তখন ভাঙ্গচুরের একটি দৃশ্য ফুটে উঠছিল। ভাবছিলাম ভাড়া নিয়ে নিশ্চয় কিছু লোক কথা তুলবে। তাতে আমি নির্ভিগ্নে গলা মেলাতে পারবো। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো যে, এত বড় বাসে সবাই যেন পুতুল হয়ে বসে আছে।

আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। ভাড়ার জন্য যখন আমার কাছে আসলো তখন কন্টাকটর এর হাতে ১০টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, "কোন যুক্তিতে তুমি ৫০টাকা নিবে? মানুষ বিপদে পড়লো আর তোমাদেরও সুযোগ হলো, এটা কি মগের মুল্লুক? " কন্টাকটর উত্তরে বলল, "হ্ এইডা মগের মুল্লুক-ই" আমি উচ্চস্বরে আরো কিছু বললাম, কিন্তু ৫০টাকা দিতে কোনভাবেই রাজি হলাম না। আমি আরো আশ্চয্য হলাম আমার এত কথাকাটাকাটির মধ্যে কেউ একটা কথাও বলল না! উল্টো একটা লোক বলে উঠলো, "আপনি শুনেননি ৫০টাকার কথা?" মন চাইলো লোকটাকে বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেই। এসব বাকবিতন্ডায় আমার গন্তব্য চলে এল, কিন্তু কন্টাকটর আমাকে কোনভাবেই ৫০টাকা ছাড়া নামতে দিবে না। সে আমাকে আটকে রাখতে চাইলো, আমি আরো একটু ধমকি ধামকি দিলে আমাকে এক পর্যায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পঁয়তারা করল।

আমি নামতে সক্ষম হলাম কিন্তু ভাবনাটা আরো পগাঢ় হল যে আমরা কি নৈতিকতা বিবর্জিত জাতিতে পরিণত হলাম! নিজেদের স্বকীয়তা সব হারিয়ে ফেললাম! একটু স্মৃতিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। কদিন আগেই কলকাতায় আমার এক বন্ধুর সাথে শহর থেকে বেশ দূরে ট্রেনে চেপে গিয়েছিলাম। সময় লেগেছিল প্রায় ৪৫মিনিট হবে। জায়গাটার নাম বারইপুর। আমারা কাজ শেষ করে খেয়ে দেয়ে আবার যখন ট্রেনে চড়বো তখন জানতে পারলাম ঝড়ে রেল-লাইনের উপর গাছ পড়েছে, এবেলায় আর ট্রেন যাচ্ছে না।

কলকাতায় বেশিরভাগ মানুষই ট্রেনের উপর খানিকটা নির্ভর করে। তো স্বভাবতই সেদিন সড়কপথে বেশ চাপ হলো। এদিকে রাত হয়ে গেছে, দমকা হাওয়া বইছে, ঝড় আসছে। রাস্তার বাতিও কিছুক্ষণ পর নিভে গেল। কিন্তু আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যের গাড়ি আর পাওয়া যাচ্ছে না।

ওখানে আটেরিকশায় শেয়ার এ যাওয়া যায়। সাবাই হুড়মুড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু কেউ "গড়িয়া" যেতে রাজি হচ্ছে না। আমাদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য আরো অনেকেই অপেক্ষায় ছিল, তারপরও উপায়ান্তর খুজছিলাম। কারন আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। হঠাৎই ভাগ্যক্রমে একটা অটো পেয়ে গেলাম।

আমাদের সাথে আরো দুজন উঠলো। ভাড়া জিজ্ঞেস করলে বলল জনপ্রতি ১৫টাকা(রূপি), মানে এই দুরুত্তে সাধারনত ভাড়া ১৫টাকাই। আমাদের গড়িয়া যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগলো, তারমানে দুরত্তটা কিন্তু নিহায়েত কম না। আমি বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, এমন ঝড়ের রাত্রে, সবার এমন সংকটময় সময়ে, লোকটি চাইলেই আরো দাম হাকাতে পারতো, এবং আমরাও তা দিতে রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু অটোচালকটি তা না করে, বরং সে আমাদের এক প্রকার উপকারই করল বলা চলে।

আমি তখনই আমার দেশের পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা ভাবছিলাম। এখানে এমন পরপোকারির কথা ভাবাই যায় না। আজকের ঘটনায় তো তা আরো স্পস্ট। দুদিন আগের আরো একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমরা পহেলা বৈশাখের দিন রাতে ফরিদপুর থেকে ফিরেছি। তখন ১০টা বাজছে।

ফ্রামগেট পুলিশ বক্সের সামনে সিএনজি খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু কেউ উত্তরা যেতে রাজি হচ্ছে না। একটা কে পাওয়া গেল যিনি যেতে রাজি হল, তবে ৩০০টাকার কমে যাবে না। আমার সাথে থাকা রবিন ভাই জিজ্ঞেস করল, "মিটার ঠিক আছে? মিটার এ যাব" মিটার এ যাওয়ার কথা শুনে সেেলোকটি মনে হয় আমাদের পাগলই ভাবলো। ঢাকা শহরে কি আর আদতে মিটার এ কাজ চলে, এ সবই শো-শা। সরকার পবলিক কে বলে আপনারা মিটার এ যাবেন, না যেতে চাইলে পুলিশকে ধরিয়ে দিবেন।

আবার পুলিশ সিএনজি ড্রাইভার থেকে পয়সা খেয়ে বলে তুমি কাজ চালিয়ে যাও আমরা আছি তোমার সাথে। জনগন মাঝখান থেকে ঢেউটিন হয়ে সিএনজিতে চড়ে বসে। আমাদের যে গাড়ি নেই, সত্যিই কোন উপায় নেই। আর সিএনজি পেলেও তো কথা হতো, ধরা দিলো তো ডোরাকাটা হরিণ পেলেন। এবার মূল কথায় ফিরে আসি, রবিন ভাই এবারে ধৈয্যের বাধ ভেঙ্গে চড়াও হলো।

সিএনজির সামনে এসে দাড়ালো। ড্রাইভার একটু ভয় পেয়ে গেল, সে কিছুতেই যাবে না এবং আমরাও তাকে ছাড়বো না। সে বলল, "আপনাদের তো দেখে ভদ্রলোকই মনে হয়, তাইলে আমাকে আটকাইছেন কেন?" রবিন ভাই বলল, এত কষ্ট করে যখন সিএনজি পেতে হয় আর এরপর মিটারেও যেতে পারবো না তাহলে আমরা অভদ্রই হলাম"। ততক্ষনে আমরা সেই সিএনজিতে চড়ে বসেছি। অতঃপর উওরা পৌছে মিটারে ভাড়া উঠলো ১২০টাকা এবং তাকে আরো বাড়তি ২০টাকা দেওয়া হল।

সুতরাং এতসব কথা বলার মর্মার্থ হল আমি বিচলিত, বিস্মিত, মর্মাহত এবং বিধ্বস্থ। আমরা কি আরো খানিকটা মানসিকভাবে উন্নত হতে পারি না? ভাবতে পারি না এদেশকে নিয়ে! সবাই তো আর এমন না, যারা সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে তাদের সাথে আমদেরও ঝাপিয়ে পড়া উচিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।