আমার নানা প্রায়ই একটি গল্প বলতেন। এক পীর সাহেব তার সঙ্গী-সাথী নিয়ে নতুন এক দেশে গিয়ে হাজির। প্রথমেই তিনি সেই দেশের হাটে গিয়ে ওঠেন। গিয়ে দেখেন ঘি এবং তেল দুটোই পাঁচ আনা সের দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গী-সাথীদের বলেন, এই দেশ থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে।
যে দেশে ঘি আর তেলের দর এক সেটা কোনো সভ্য মানুষের দেশ নয়। এটা মগের মুলুক। মগের মুলুকে বেশিদিন থাকলে ইজ্জত থাকবে না।
একজন ডাক্তার রোগীর বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করেন। নাড়ি দেখে তিনি অসুখের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারেন।
একটি দেশের অর্থনীতির নাড়ি হলো সেই দেশের স্টক-এক্সচেঞ্জ মার্কেট। এই মার্কেটের নড়াচড়া দেখেই সারা দেশের অর্থনৈতিক চিত্রটি বোঝা যায়। স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবসা কেবল ফটকাবাজদের কেনা-বেচা নয়। এই বাজারের পণ্য হলো দেশের প্রধান সব কোম্পানির শেয়ার। কোম্পানিগুলো লাভ করলে শেয়ারের দাম বাড়বে আর লোকসান দিলে শেয়ারের দাম কমবে।
এটাই হলো স্বাভাবিক অবস্থা। সুতরাং শেয়ার মার্কেটের সূচক কমে যাওয়ার অর্থ হলো দেশের অর্থনীতিতে লাল বাতি জ্বলছে। একটি দেশের অর্থনীতির নেতা হলেন সেই দেশের অর্থমন্ত্রী। আমাদের অর্থমন্ত্রী নামের দিক দিয়েও আবুল মাল, অর্থাত্ অর্থের পিতা। কিন্তু আমাদের আবুল, মানে পিতা, সদর্পেই ঘোষণা করলেন তিনি শেয়ার মার্কেট বোঝেন না।
ডাক্তার যদি রোগীর নাড়ি না বোঝেন তাহলে তিনি কেমন ডাক্তার? আমাদের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দেশের এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক দুর্দিনে তাকে যখন আমরা মোটেও চিন্তিত দেখি না এবং তিনি যখন বলেন, আমি শেয়ার মার্কেট বুঝি না, তখন তো সঙ্গত কারণেই আমার নানার গল্পের মতো বলতে পারি আমরাও হয়তো একটি ‘মগের মুলুকে’ই আছি। যেখানে যোগ্যতার বিচারে পদবিন্যাস হয় না। সাম্প্রতিককালে পটুয়াখালীর এক সরকারি সংসদ সদস্য বলেই দিয়েছেন, দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আবুল হোসেন।
আমাদের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, নৌ-পরিবহন এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে। আজকের এই লেখায় অন্য কোনোদিকে না গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সীমিত থাকব।
কাল রাতে ফেইসবুকে এক যুবক আমাকে একটি বার্তা পাঠায়। যুবকের নাম আহমেদ কামাল। আমি তার সংক্ষিপ্ত বার্তার মধ্যে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখেছি।
কামাল জানায়, ৭০ শতাংশ লোকসান দিয়ে অবশেষে সে তার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিয়েছে। ভীষণ হতাশ এই যুবককে নানাভাবে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করি। এরপর সে জানায়, তার বন্ধু আজিজ ৫৫ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে এখন পাগল হয়ে গেছে। জায়গা-জমি বিক্রি করা টাকা হারিয়ে তার তো পাগলই হয়ে যাওয়ার কথা। সে মাঝরাতে উঠে দৌড় দিয়ে রেল লাইনের ওপর চলে যায়।
ওরা তিন বন্ধু মিলে সারাদিন আজিজকে পাহারা দিয়ে রাখে। এমনি আরও অনেক তরুণ-যুবক গত এক বছর ধরে নানা সময়ে আমাকে ই-মেইল করে, ফেইসবুকে বার্তা পাঠায়। আমি শুনতে পাই হাজারও স্বপ্নচারী তরুণের স্বপ্নভঙ্গ হৃদয়ের করুণ আকুতি। আমি দেখতে পাই কান্নায় ভেঙে পড়া ওদের মুখগুলো। বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছে কেন? কোম্পানিগুলো কি লোকসান দিচ্ছে? না দিচ্ছে না।
কোনো কোনো কোম্পানি ১০০ ভাগ বোনাসও ঘোষণা করেছে। তাহলে শেয়ার মার্কেটের এই অবস্থা কেন? নিশ্চয়ই একটি কৃত্রিম উত্থান ঘটানো হয়েছিল। হাজার হাজার কোটি টাকার মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিম উত্থান ঘটানোর ক্ষমতা নিশ্চয়ই এসব স্বপ্নচারী তরুণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর নেই। নিশ্চয়ই বড় বড় রাঘব-বোয়াল এই ঘটনা ঘটিয়েছে। কারা সেই রাঘব বোয়াল? যারা বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো ঘর থেকে বের করে এনে এক ভয়াবহ অন্ধকার গুহার ভেতরে ফেলে দিয়েছে? সেই রাঘব-বোয়ালদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব অর্থমন্ত্রীর।
যদি তিনি তা না পারেন তাহলে ধরে নিতে হবে তিনিও সেই রাঘব-বোয়ালদেরই একজন। তার সামনে এখন একটিমাত্র পথ খোলা আছে, পদত্যাগ করে সরকারকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করার আহ্বান জানানো। কেবল মগের মুলুকের অর্থমন্ত্রীর পক্ষেই এখনও পদ আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।