ভালবাসি
পদ্মা সেতুর টাকা দেবে কে-তা এখনো নিশ্চিত নয়। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কথা বলতে চান না। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য মালয়েশিয়ার কথা বলছেন। কিন্তু আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মালয়েশিয়ার সাথে যতই সমঝোতা স্মারক সই হোক না কেন তাদের টাকায় পদ্মা সেতু হবে না। এমনকি সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও তাই মনে করেন।
তাদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় পদ্মা সেতু হবে।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা এখনো মালয়েশিয়ার সাথে পদ্মা সেতু চুক্তির বিরোধিতা করছেন। এক্ষেত্রে শুধু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর মালয়েশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার মালয়েশিয়ার সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর (এমওইউ) করায় তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু বিশ্ব ব্যাংকের টাকায়ই হবে।
মাঝখানে পানি ঘোলা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ ঋণের সুদ হবে সবকিছু মিলে এক শতাংশের নিচে। আর মালয়েশিয়ার টাকায় হলে এ টাকার সুদ হবে লাইবর প্লাস। তার মানে এ সুদ গিয়ে দাঁড়াবে ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এরপর তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা তুলে নেবে।
সে সময়ের মধ্যে টাকা উঠে না এলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংক সুদ কম নিলেও বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা বেঁধে দেবে যার আর্থিক পরিমাণও নেহায়েত কম না।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জেলেকের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হয়েছেন জিম ইয়ং কিম। তাই নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর ভাগ্যও ফিরে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে মালয়েশিয়ার সাথে চুক্তি করায় তাতে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ১০ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে পদ্মা সেতু ও এ সম্পর্কিত সুবিধাদিসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ বিষয়ক 'কো-অপারেশন অন পদ্মা মাল্টিপারপাস ব্রিজ অ্যান্ড আদার ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোজেক্ট' শিরোনামে এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং মালয়েশীয় সরকারের দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ দূত দাতো সেরি সামি ভেলু চুক্তিতে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব তুন রাজাক। অনুষ্ঠানস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মত বিনিময় করেন।
এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দাতাদের সঙ্গে সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত এ প্রকল্পে মালয়েশিয়ার অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেবে না সরকার। পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে ইতোমধ্যে যাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তির আগের দিন বলেন, পদ্মা সেতু নয়, সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে মালয়েশিয়ার সাথে এমওইউ স্বাক্ষর হবে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
তবে অর্থনীতিবিদ ড. জাইদ বখত বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে যতই এমওইউ করা হোক না কেন পদ্মা সেতু বিশ্বব্যাংকের টাকাই হবে।
নয়তো বাংলাদেশের অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিতে পারে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণে যে সুদ মালয়েশিয়ার ঋণে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সুদ দিতে হবে। আর এ ধরনের বড় প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশ তাদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী জানান, মালয়েশিয়ার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে।
যা জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। কারণ কোনো দেশ থেকে ঋণ নিলে অতি উচ্চ সুদ হবে। আর বিশ্বব্যাংকের সুদ খুবই সামান্য। তাই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সঠিক হবে।
এদিকে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগামী ১০ মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
তিনি বলেন, সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। শিগগিরই জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখেই নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে।
যোগাযোগমন্ত্রী অবশ্য বলেন, বিশ্বব্যাংক শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দেশের ছোট-বড় প্রায় ৩০টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন চলমান। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণের কাছে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সরকারের হাতে সময় কম। বিশ্বব্যাংক দেরি করায় সরকার বিকল্প অর্থায়নে মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এতে বিশ্বব্যাংকের সাথে কোনো বিরোধ তৈরি হবে না।
অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে মালয়েশিয়ার অর্থায়ন প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি নতুন করে আর কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে এ সেতু সির্মাণে কোত্থেকে টাকা নেয়া হবে সে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারই নেবে।
কিন্তু গত ১৭ এপ্রিল আকস্মিকভাবে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির জন্য ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারকে তাগিদ দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ পরিচালক অ্যালেন গোল্ডস্টেইন এক বিবৃতিতে বলেন, তারা গত সেপ্টেম্বর থেকেই পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির গুরুতর তথ্য সরকারকে দিয়ে আসছেন। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে তদন্ত করছে তা সঠিক।
জানা গেছে, মালয়েশিয়া বিল্ট অন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে চায়। দুর্নীতির দায়ে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত হওয়ার পর মালয়েশিয়া দেশের সর্ববৃহৎ এই নির্মাণ প্রকল্পের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়।
এরপর গত ২৫ মার্চ মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করে।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সমাঝোতা স্মারকের আওতায় মালয়েশিয়ার সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো সংস্থা পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেবে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে অন্তত ২৩০ কোটি ডলার। তবে প্রকল্পের খরচ বাড়তে পারে।
এতে আরো বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার যে প্রতিষ্ঠান সেতু প্রকল্পের দায়িত্ব পাবে তারা এর কারিগরি ও অর্থনৈতিক প্রস্তাব তৈরি করে জমা দেবে।
এর ভিত্তিতেই নির্মাণ, মালিকানা, পরিচালনা ও হস্তান্তরের (বিওওটি) বিষয়গুলোর ফয়সালা হবে। সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ থাকবে সই হওয়ার তারিখ থেকে ৯ মাস।
এদিকে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সাথে পদ্মা সেতুর চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উভয়পক্ষ চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক বাড়িয়েছে ৬ মাস, এডিবি আর জাইকা ৩ মাস করে। আর আইডিবির সাথে চুক্তি করার ৬ মাসের মধ্যে তা কার্যকর হয়ে গেছে।
ফলে তাদের সাথে মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। নিয়ম অনুযায়ি উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি হওয়ার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যদি চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানো হতো তাহলে চুক্তি বাতিল হয়ে যেত। কিন্তু উভয়পক্ষের সম্মতিতেই নতুন করে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় সরকার বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতাদের মাধ্যমেই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে এখনো আগ্রহী।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে এর আগে বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করে সরকার।
কিন্তু তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গত বছরের অক্টোবরে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করলে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প আটকে যায়। কানাডায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এখন তদন্ত চলছে।
চুক্তি অনুযায়ী, ২৯০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা। এছাড়া এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলার ঋণ দেবে। বাকি অর্থের জোগান দেয়ার কথা ছিল সরকারের।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো অর্থ ছাড় করবে না। আর বিশ্ব ব্যাংকের পথ অনুসরণ করছে অন্য দাতা সংস্থাগুলো। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।