আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পদ্মা সেতু প্রকল্প: এক অনিশ্চিত স্বপ্নযাত্রার পথে পদ্মা পাড়ের মানুষগুলি

Life is a Target.... Life is a Mission... এক অজানা আর অনিশ্চিত স্বপ্নযাত্রার পথ পাড়ি দিচ্ছেন পদ্মা তীরের মানুষগুলি। তাদের এই স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিলো আজ থেকে দশ বছর আগে। সেই স্বপ্নযাত্রার বয়সটা এখন দশ পেরিয়ে এগারোতে গিয়ে ঠেকছে প্রায়। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্ত-বায়ন আজও দেখতে পায়নি পদ্মা পাড়ের এই মানুষগুলি। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

নতুন করে জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তবে এটা সত্য যে, শুধু পদ্মা পাড়ের মানুষই নয়; এই স্বপ্নযাত্রায় একে একে সামিল হতে থাকে এ দেশের আপামর জনতা। বিশেষ করে আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মনে নতুন করে সঞ্চারিত হয় এক অমোঘ আশার বাণী। কিন্তু কী হবে? এন্ড্রু কিশোরের ‘আশায় আশায় দিন যে গেল, আশা পূরণ হলো না’- এই বিখ্যাত গানটির মতোই কেটে গেল এ দেশের মানুষের কয়েকটি বছর। স্বপ্ন যেন কাছে এসেও ধরা দিচ্ছে না।

অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ করেই যেন অনাকাঙ্খিত কারণে থমকে দাঁড়াল তাদের সেই লালিত স্বপ্নের রথযাত্রা। কিন্তু তাই বলে কি বসে থাকতে হবে। আকাশ হবে মনের বাড়ি, মনের সাথে করছি আড়ি। তাই স্বপ্ন খেলছে যে লুকোচুরি। এভাবেই চলছে আমাদের জীবনটা।

স্বপ্ন আসে, স্বপ্ন যায়। কখনো উঁকি দেয় রোদেলা সকালে। আবার কখনো মেঘলা কোনো আকাশে। তবুও স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন রবে। কারণ স্বপ্ন দেখতে নেই যে মানা।

স্বপ্নপূজারী মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আর এই বড় স্বপ্নের বিশালতার খোঁজ পাওয়া গেল পদ্মা তীরের মাওয়া ও মুন্সীগঞ্জ জেলার দক্ষিণ মেদিনী মন্ডল এলাকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। ‘দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে পদ্মা সেতু হোক। আমার জমি গেছে তাতে কোনো ক্ষতি নাই। ’ পদ্মা সেতুর কথা বলতে গিয়ে এভাবেই নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন দক্ষিণ মেদিনী মন্ডল বাজারের একজন ক্ষুদ্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. লিটন খাঁ।

স্ত্রী-সন্তানাদি নিয়ে মাত্র চার সদস্য নিয়ে লিটন খাঁ’র পরিবার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ভাই-বোন মিলে মোট ভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশ যার পুরোটাই পড়েছে পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণের আওতায়। ভূমি অধিগ্রহণের অংশ হিসেবে লিটন খাঁ নিজের ভাগের সাড়ে তিন শতাংশ ভূমির জন্য পেয়েছেন মোট সাত লাখ টাকা। আর টাকাটা পেয়েছেন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেই। প্রায় দুশো দোকান নিয়ে পদ্মার পাড়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ মেদিনী মন্ডল বাজার।

এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায়। এখানে অনেক দোকান বা ঘর দেখতে টঙ বা মাচা আকৃতির। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হলে এ বাজারটিকে স্থানান্তরিত করে উত্তর কুমারভূক বাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। দক্ষিণ মেদিনী মন্ডল বাজারেরই আরেক জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেন নূর মোহাম্মদ। পদ্মা সেতুর ভূমি অধিগ্রহণে আওতায় তার রয়েছে চৌদ্দ হাত দৈর্ঘ্য ও সাত হাত প্রস্থের ঘর, টিউবওয়েল ও বাথরুম।

এজন্য তিনি পেয়েছেন তিন লাখ ত্রিশ হাজার টাকা। জায়গা ও টাকার ব্যাপারে নূর মোহাম্মদের বক্তব্য হচ্ছে, টাকা দিসে আর আড়াই শতাংশ জায়গাও দেওয়া হবে থাকার জন্য। তবে কাগজপত্র এখনও পাইনি। জায়গা দিলে সেখানে চলে যাবো। ওপাশ থেকে আবার অনেকের মুখেই শোনা গেল ক্ষোভ আর প্রতিবাদের ধ্বনি।

এখানে স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জানা গেল যে, ভূমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা তোলায় ঘুষ নিয়েছেন অফিসাররা। হাজারে একশো আর লাখে পনের হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ‘আমার কাছ থেকে চার লাখ বারো হাজার দুশো ছিয়ানব্বই টাকায় ঘুষ নিছে তেত্রিশ হাজার টাকা। আগে টাকা জমা নিয়ে পরে টাকা দিছে। এক মাস আগে টাকা জমা না দিলে ফাইল খোলেন না।

’ ভূমি অধিগ্রহণের টাকা উত্তোলনে ঘুষ গ্রহণের অভিজ্ঞতার বর্ণনাটি এভাবেই উঠে এসেছে মো. নূরুল ইসলাম নামের একজন দোকানীর মুখে। তাছাড়া টেবিলের নিচ দিয়ে টাকা লেনদেনের বিষয়টিও এখানে উঠে এসেছে। আর দুদক থেকে শুরু করে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল বলছে ভিন্ন কথা। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ এই পর্যন্ত শুরু হওয়া কোনো কাজে দুর্নীতি হয়নি। দুদক বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি, তবে দুর্নীতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

মাওয়া থেকে কাওড়াকান্দি পর্যন্ত লঞ্চ কর্তৃপক্ষের মতে, পদ্মা সেতু হলে আমাদের লঞ্চ ব্যবসায় একটা ভাটা পড়বে। এখানে কর্মরত শ্রমিক-মালিকসহ অনেকের কর্মসংস্থানের সমস্যা হবে। তবু আমরা চাই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্রুত ও সফল বাস্তবায়ন হোক। আমাদের কাছে এ ক্ষুদ্র স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ অনেক বড়। অন্যদিকে, মাওয়া ফেরিঘাটে দর্শনার্থী ও যাত্রীদের জন্য রয়েছে অনেক ভাড়াটে স্পিডবোট।

এখানে বছরের বিভিন্ন সময় অনেকেই ঘুরতে আসেন। পদ্মা সেতু হলে এখানে যাত্রীর সংখ্যা কমে গেলেও দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়বে মনে করেন স্পিডবোট ব্যবসায়ীরা। ফলে তাদের ব্যবসায় কিছুটা লাভ আসবে। তাছাড়া মাওয়া পদ্মা পাড়ে রয়েছে কিছু ইটের ভাটা। এসব ইটের ভাটাগুলোতে অনেক শ্রমিক, দিনমজুর কর্মরত রয়েছেন।

তাদের কণ্ঠেও একই সূর-সেতুর বাস্তবায়ন চাই। পদ্মা সেতু যেন সবারই প্রাণের দাবি। মাওয়া ফেরিঘাটে বাংলাদেশ নৌ পরিবহন সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি’র আওতায় ফেরি রয়েছে প্রায় চৌদ্দ থেকে পনেরটি। এখানে প্রায় চারশত লোক কর্মরত আছেন। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে মাওয়া ফেরিঘাটের সাব-এসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার রুবেল- উজ-জামান জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু হলে মাওয়া ঘাটের ব্যস্ততা মোটামুটি কমে যাবে।

চাঁদপুর, শরিয়তপুর জেলায় নতুন রুট চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। নতুন চালু করে এখান থেকে শ্রমিক স্থানান্তরিত করা হতে পারে। তাছাড়া এখানে লোকবলের সংকট রয়েছে। এর মধ্যে আবার ২০১৪ সালের মধ্যে অনেকে অবসরে চলে যাবেন। ফলে এদিক থেকে পদ্মা সেতু হলে তেমন বেশি সমস্যা হবে না।

অনিশ্চিত স্বপ্নযাত্রার পথে.... অনিশ্চিত এক স্বপ্নযাত্রার পথে এ দেশের মানুষ। অজানা অথচ আত্মবিশ্বাসী এক স্বপ্নে বুক বেঁধেছেন পদ্মা পাড়ের মানুষগুলো। ২০০১ সালে তাদের সেই স্বপ্নের জন্ম হলেও আজ পর্যন্ত তারা তাদের সে স্বপ্নের বাস্তব রূপটি প্রত্যক্ষ করতে পারে নি। প্রত্যক্ষ করতে পারে নি তাদের সেই কাঙ্খিত স্বপ্ন পদ্মা সেতুর অবকাঠামোকে। শুধু একটি নকশার মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ থেকেছে স্বপ্ন-সেতু পদ্মা সেতু।

নানা কারণে এ স্বপ্ন আজ অবধি থেমে রয়েছে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার পর থেকে চলতি বছরের এই সময় পর্যন্ত পদ্মা সেতুর মূল কাজই শুরু হয়নি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ফলে পদ্মা সেতুকে নিয়ে আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো এ দেশের মানুষ, এ পদ্মা পাড়ের মানুষ। ২০১৩ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ করা হবে বলে ঘোষণা দিলেও এখন এই সেতু নির্মাণ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিশ্চয়তা।

দেখা দিয়েছে এক ধোঁয়াটে পরিবেশ। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সবচেয়ে বড় দাতা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে দেয়া তার এক তদন্ত প্রতিবেদনে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং কানাডীয় একটি পরামর্শক নিয়োগ প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভলিন গ্রুপের বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ করে এতে ঋণ সহায়তা স্থগিত করেছে। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে করা তদন্ত প্রতিবেদনটি গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রীকে দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের ভাষায় অত্যন্ত গোপন এই প্রতিবেদনটি দিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্ড এফ ম্যাকার্থি।

পাঁচ সপ্তাহ সময় নিয়ে বিশ্বব্যাংক এটি তৈরি করেছে। এতে চার দেশের কমপক্ষে ১২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আর এরই প্রেক্ষিতে সংস্থাটি পদ্মা সেতুর তিনটি কার্যক্রমে প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এই কার্যক্রমগুলো হলো: তদারকি কাজের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, নদী-শাসন প্রাক-যোগ্যতার কাজের দরপত্র মূল্যায়ন এবং সেতুর মাওয়া দিকের অ্যাপ্রোচ রোডের দরপত্র। বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগগুলো তদন্ত করছে দুদক।

পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ে অনিয়মের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক এখনো দুদকের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি। দুদক বলছে, বিশ্বব্যাংকের জবাব পাওয়ার পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কানাডীয় কর্তৃপক্ষের নাম আরসিএমপি (রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ) ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন ইউনিট। এটি অন্টারিয়তে লাভলিন অফিসে অভিযান চালিয়েছে। লাভলিনের বদনাম কোনো নতুন বিষয় নয়।

এর আগে লাভলিন ফ্রড বা প্রতারণার দায়ে বিশ্বব্যাংকেরই প্রকল্পে নিষিদ্ধ হয়েছিলো। তাছাড়া সে দেশের একটি টাস্কফোর্স প্রতিবেদনও বলেছে যে, কুইবেকে সরকারি ঠিকা কাজের মূল্যবৃদ্ধিতে লাভলিনও জড়িত। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পাঠানো দুটি চিঠির জবাবে দিয়েছে এভাবে- ‘পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজে দুর্নীতির বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ’ বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় বন্ধ করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে জাপান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও (আইডিবি) অর্থ দেবে না বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন সহায়তাকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক এই প্রথমবারের মতো কোনো প্রকল্পে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তা স্থাগিত করলো।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু হাজারো স্বপ্নের মাঝে একটি স্বপ্ন পদ্মা সেতু। এই সেতু প্রকল্পের আওতায় মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৬ মিটার। দ্বিতল এ সেতুর ওপরে সড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেলপথ। এছাড়াও রয়েছে রোড ভায়াডাক্ট ৩.৮ কিলোমিটার ও রেল ভায়াডাক্ট ০.৫৩২ কিলোমিটার। সেই সাথে থাকবে ১৪ কিলোমিটার নদী শাসন এবং টোল প্লাজা, সেবা অঞ্চল নির্মাণসহ ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক।

ঢাকা- মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে হবে এই সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার দেশীয় টাকায় যা প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকাই ঋণ-সহায়তা থেকে ব্যয় হবার কথা রয়েছে। বিশ্বব্যাংক-এর ১২০ কোটি ডলার বা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬১ কোটি ডলার, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪ কোটি ডলার এবং জাইকা ৪০ কোটি ডলার।

আর বাকি অর্থ দেবে বাংলাদেশ সরকার। পদ্মা সেতুর জন্য মাদারীপুর জেলা থেকে অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল মিলিয়ে মোট ২৯৮ হেক্টর ভূমি নেওয়া হয়েছে। আর শরিয়তপুর জেলা থেকে নেওয়া হচ্ছে প্রায় ৩৯৭ হেক্টর ভূমি। এর ক্ষতিপূরণ মূল্য প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা। মুন্সীগঞ্জ জেলা থেকে নেওয়া হচ্ছে ২১৪ হেক্টর ভূমি এবং এর জন্য ক্ষতিপূরণ হবে প্রায় ৫১৮ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধূরীর নেতৃত্বে দুই বছরের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আইনুন নিশাতও আছেন। কমিটির দুই বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলেও এরই মধ্যে এ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও গাড়ীক্রয়সহ নানা কর্মকান্ডে এক হাজার ২১ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এ অর্থের বেশিরভাগই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ব্যয় হয়।

কেন এতো বেশি ব্যয়? পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯০ কোটি ডলার । অথচ আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত চীনের হাঙজু ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার। যা পদ্মা সেতুর চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বড়। তাছাড়া পদ্মা সেতু তৈরি হবে নদীর ওপর।

আর হাঙজু তৈরি করা হয়েছে সাগরের বুক চিরে। চীন সাড়ে তিন বছরে এ ব্রিজের কাজ শেষ করে ২০০৯ সালে একে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর ব্যয় সম্পর্কে এর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধূরীর বক্তব্য হচ্ছে, পদ্মা সেতুতে একই সাথে সড়ক ও রেল সুবিধা থাকছে। তাছাড়া ১২০ মিটার গভীরে গিয়ে এ সেতুর কাজ করতে হবে। এজন্য এতে ব্যয় বেশি হচ্ছে।

এছাড়াও বিশেষজ্ঞ প্যানেল সদস্য ড. আইনুন নিশাত বললেন একই কথা। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু হাঙজু সেতুর চেয়েও পদ্মা সেতুর ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে পদ্মায় নদীশাসনে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। এছাড়াও পদ্মা সেতুতে হেভি লোড বহন করার মতো রেললাইন ও সড়ক থাকছে। উপরন্তু জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে অনেক ব্যয় হচ্ছে। যমুনা সেতু নির্মাণের সময়ও সেতু নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে নদীশাসনে খরচ হয়েছিলো বেশি।

স্বপ্ন দেখতে নেই মানা পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে আছে এ দেশের মানুষ। তাকিয়ে আছে এদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আর পদ্মা পাড়ের হাজারো মানুষ। এ প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে মংলা বন্দর, শিল্পনগরী খুলনাসহ এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ভবিষ্যৎ। তাছাড়া এ সেতু নির্মাণ এবং পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা হলে কেবল মংলা বন্দরই নয়, গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপটই বদলে যাবে। সেই সাথে বদলে যাবে গোটা বাংলাদেশের চিত্র।

তখন দক্ষিণ এশীয় সোশ্যাল ফোরাম-এর স্লোগানটির অনুকরণে আমরা প্রতিটি বাংলাদেশী বলতে পারবো- `Another Bangladesh is possible’ বা ‘অন্যরকম এক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব’। সরকারের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হার ১.২% বৃদ্ধি এবং প্রতি বছর তা ০.৮৪% হারে দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে। এখনও শীতের ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়নি বাংলাদেশ। সাদা মেঘ ভেসে বেড়ানো শরতের শুভ্র আকাশের পর বাংলার মানুষ এখন প্রত্যক্ষ্য করছে হেমন্তের হিমেল হাওয়া। আর শীতের ঘন কুয়াশায় যেন পদ্মা সেতুর স্বপ্ন ঢেকে না যায়।

এতো কিছুর পরও এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নই তাদের বড় সম্পদ। বহু স্বপ্ন আর প্রত্যাশার বারতা নিয়ে এসেছিলো পদ্মা সেতু। কিন্তু সে স্বপ্নকে মিথ্যে হতে দেয়া যায় না। বাংলাদেশের মানুষ তাই খুব দ্রুতই দেখতে চায় তাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ সুষ্ঠুভাবে শুরু হয়েছে বেশ রমরমা ও আনন্দঘন পরিবেশে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.