বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এখন আর কোনো কিছুই সহজভাবে বলা যায় না, করা যায় না, পদে পদে বাধা। ’৭২ সালে যখন মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলে যেতাম ১০-১২ মিনিট লাগত। এখন সেখানে হরহামেশাই এক-দেড় ঘণ্টা লাগে। কখনো তো দুই-আড়াই-তিন ঘণ্টার প্রয়োজন হয়। ভাবলাম, ৩৭-৩৮ বছরের জমা কথা সব হরহর করে বলে ফেলব।
কিন্তু পদে পদে এটা-ওটা সামনে এসে নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। তাই জমানো কথাগুলো বলার পথে ভীষণ ভীষণ সমসাময়িক কিছু ঘটনাও তোমাকে বলব। তাই প্রতি পর্বেই প্রথম দিকটায় বর্তমান ঘটমান দু-একটি ঘটনা অবশ্যই তোমাকে জানাব।
এবার ১৪১৯ বাংলা বর্ষে আশা করেছিলাম কালিমামুক্ত অমলিন হবে। কিন্তু শুরুর দিকেই যা দেখছি মনে হয় বছরটা ভালো যাবে না।
২ বৈশাখ, ১৫ এপ্রিল সোমবার রেলমন্ত্রীর এপিএস ফারুকের অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ মাথায় নিয়ে বর্ষীয়ান জননেতা শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত পদত্যাগ করেছিলেন। ষাটের দশকে আরেকজন মহান নেতা রেল দুর্ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে ভারতের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করে কিছুটা নিম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই পদত্যাগটা কেলেঙ্কারির পর মুহূর্তে হলে যতটা ভালো হতো, দেরি করায় ততটা হয়নি। কোনো নারীর সামাজিকভাবে স্বীকৃতি ছাড়া সন্তান হলে যেমন হয়, প্রায় তার কাছাকাছি হয়েছে।
আর প্রথমে হলে নরনারীর সামাজিক স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে সন্তান হলে যে আনন্দ ও গর্বের হয়, অনেকটাই তেমন হতো। তুমি তো বাবা, আমিও বাবা হয়েছি, তবুও অনেক কিছু বলতে পারি না। এরপর দেখোÑ যার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ, ১৭ এপ্রিল মঙ্গলবার সেই মুজিবনগর দিবস গেল তার খবরাখবর কোনো পত্রপত্রিকায় স্থান তেমন পেল না। শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনের পদত্যাগের খবর অনেক পত্রিকায় আট কলামেও এসেছে। কিন্তু মুজিবনগর দিবসের খবর কোনো পত্রপত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় এক কলামেও চোখে পড়েনি।
গতবার তোমার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং গিয়েছিলেন মুজিবনগরে। সে কী আড়ম্বর!
এবার মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়েছিলেন। লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়েও মুজিবনগর দিবস মানাত। তিনি যথার্থই মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন নেতা ছিলেন। কিন্তু এখন তার তো কোনো নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নেই।
তার সাথে গিয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ। এখন তিনি তোমার কবর দেয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডি মন্ত্রী। তোমার চিনতে অসুবিধা হতে পারে। ময়মনসিংহের ছাত্রনেতা ছিলেন। খুবই চিকন-চাকন ও হালকা-পাতলা।
তখনকার দিনে সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে তোÑ তাতেই নেতা। এখন তেমন কাজটাজ করে না, বেশ জনবিচ্ছিন্ন। তবু তোমার মৃত দলের সাধারণ সম্পাদক। মানে মুজিবনগর সরকার, মুজিবনগর দিবস অস্বীকার করা, এরপর তোমাকে অস্বীকার করা, তারপর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। এরপর অতিরিক্ত শখ হলে অন্যের অঙ্গীভূত হওয়ার যে সম্ভাবনা নেই তা-ও বলা যায় না।
বড় কষ্ট ও অস্বস্তিতে আছি। আবার দেখো স্বাধীনতার মূল কথাই হলো রাষ্ট্র কর্তৃক জীবন ও সম্পদ সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান। বর্তমানে মানুষের মানসম্মান ও জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। নিরাপদ মৃত্যুরও কোনো গ্যারান্টি নেই। এই তো সে দিন গভীর রাত থেকে ইলিয়াস আলীকে পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগে যে কত মানুষ গুম হয়েছে তা লেখাজোখা নেই। দোষে-গুণে মানুষ। ইলিয়াস আলী তাদের একজন। ছাত্রনেতা হিসেবে তাদের সংগঠনে সে খুবই সফল। এমপিও হয়েছেন।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন রাজনৈতিক মানুষ। ১৭ তারিখ মঙ্গলবার রাতে গুম হওয়ার পর থেকে আমার এই লেখা পর্যন্ত তার কোনো খবর নেই। এ রকম একজন রাজনৈতিক মানুষের যদি চরম কিছু ঘটে, তাহলে সেটা হবে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। আমরা পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগের জন্মদাতা সাধারণ সম্পাদক জননেতা শামসুল হককে পাকিস্তানি কুচক্রী মহলের গুম করার ষড়যন্ত্রের কথা জানি।
এখন তো আমরা কারো কলোনি নই, কারো দাস বা গোলাম নই। আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাহলে আমাদের নাগরিকজীবন নিরাপদ হবে না কেন? আমি পরম করুণাময় দয়ালু আল্লাহর কাছে ইলিয়াস আলীর সন্তানসন্ততির কাছে তার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন কামনা করি এবং সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব হারানোর কলিজাছেঁড়া কষ্ট আপনার চেয়ে বেশি অন্য কারো জানার কথা নয়। তাই আপনার নেতৃত্বে সরকারের সময় কোনো স্ত্রী তার স্বামী, কোনো সন্তান তার বাবা হারালে তার চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে!
সেনাবাহিনীর এক মেজর ও আরো ১০-১২ ঘাতক তোমার লাশের সাথে ছিল।
তারা তড়িঘড়ি জানাজা ছাড়াই তোমাকে মাটিচাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পরও দু-একজন বাঙালি ছিল, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সাহসের পরিচয় দিয়েছে। তেমনি কয়েকজন জানাজা ছাড়া তোমার লাশ কবরে নামাতে ওই কঠিন সময়েও রাজি হয়নি। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তোমাকে ধোয়ানো হয়। তোমার সারা গায়ে আঠারোটি গুলি ছিল।
যে আঙুল উঁচিয়ে পাকিস্তানিদের তুমি শাসাতে, ’৭১ সালে পরাজিত হয়ে যারা তোমার কাছে প্রাণভিা পেয়েছিল, তাদের দালালেরা তোমার সেই আঙুল থেঁতলে দিয়েছিল। কাছে থেকে গুলি করে আঙুলের ডগা ছিন্ন করেছিল। একটি সাধারণ মিসকিন নিহত হলেও ময়নাতদন্ত হয়। এটা রাষ্ট্রের বিধিবিধান। কিন্তু তোমার ময়নাতদন্ত হয়নি।
ঘাতকেরা ময়নাতদন্ত করার প্রয়োজনবোধ করেনি। আদৌ কোনো ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করেছিল কি না জানার চেষ্টা করিনি। জানই তো বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত হয়। মিলিটারিদের পা-চাটা পুলিশ কর্মকর্তারা একজনকেও জানাজায় শরিক হতে দিতে চায়নি। তোমাকে খুন করে যারা মতায় বসেছিল, তাদের সময় গোপালগঞ্জের সেই সব পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতি তো হয়েছেই, ২১ বছর পর তোমার মেয়ে মতায় এলেও তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
এখনো হয় না, যত অসুবিধা আমাদের। শুনলে খারাপ লাগবে কি না জানি না, তোমার জীবদ্দশায় তোমাকে যারা সব সময় জ্বালিয়েছে, ভদ্রতা-শালীনতার বালাই না রেখে গালাগাল করেছে, চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছে, তারা বড়ই আরামে আছে। কষ্টে পড়েছি আমরা, যারা তোমাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখি। তা না হলে সেই বিপ্লবী কন্যা, যে পল্টন কাঁপাত, সে আজ তোমার কন্যার সব থেকে প্রিয় মন্ত্রী। তোমাকে খুন করে যারা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, সেই মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাকারী এইচ টি ইমাম এখন সব চেয়ে মতাবান।
রাজাকারদের কথা ছেড়েই দিলাম। তোমার মৃত্যুর পর জিয়া ও এরশাদের মন্ত্রিসভায় যারা দুর্দান্ত প্রতাপে ছিল, তারা আজ সবচেয়ে ভালো অবস্থায়। শুধু নামে যারা তোমাকে খুন করেছে তারা বাদে আর সবার অবস্থা ভালো। টুঙ্গিপাড়ায় জানাজা ছাড়া যারা তোমার কবর দিতে আপত্তি করেছিল, ’৯০ সালে দেশে ফিরে আমরা তাদের সাধ্যমতো সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছি। নাম বললে সবাইকে চিনবে।
তারা হলোÑ শেখ আবদুল হাই, আলহাজ আবুল কাশেম, আ: মুকিত ফকির, গাজী ইমাম উদ্দিন, হাজী কেরামত আলী, শেখ মো: ইদ্রিস, নাজির মোল্লা, সোহরাব মাস্টার, আ: হালিম শেখ, শেখ নুরুল হক, গোলাম আলী মোল্লা, ইলিয়াস হোসেন সরদার, কাজী ইদ্রিস, কাজী আকবর, মুন্সী জর্জিস শেখ, তোতা মিয়া মুন্সী, শেখ আ: মান্না ও শেখ আয়ুব আলী। এরাও অনেকে পরপারে চলে গেছে। তুমি এদের জন্য দোয়া করো। বাংলার মানুষের জন্য তোমার দোয়া আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন কখনো ফেলবেন না। তুমি তো জানই, যত গাউস, কুতুব, ওলি আবদেল আছেন বা ছিলেন, তারা কারো জন্য দোয়া করলে সে দোয়া প্রথম রাসূল সা:-এর দরবারে যাবে।
রাসূলে করিম সা: রাজি-খুশি হয়ে যদি দোয়া করেন, তবেই সে দোয়া দয়ালু আল্লাহর আরশে পৌঁছবে, তার আগে নয়। কিন্তু মহান স্রষ্টা তার সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের এত উচ্চাসন দিয়েছেন, যা চিন্তারও বাইরে। বাবা-মা যদি খুশি হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করে তাহলে তা সরাসরি তাঁর কাছে পৌঁছে এবং সন্তানের জন্য কোনো বাবা-মায়ের দোয়া তিনি ফিরিয়ে দেবেন না, মঞ্জুর করবেন। তাই বাঙালি সন্তানদের জন্য তোমার দোয়া কি আল্লাহ কবুল না করে পারেন? আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই পরম দয়ালু রাব্বুল আলামিন কবুলে মঞ্জুর করবেন।
’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
দিনে দিনে দিন তো আর কম হলো না। দেখতে দেখতে চলে গেছে তিন যুগ। সে দিনের সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা অনেকে ভুলেই গেছে। তুমি তো জানইÑ কখনো কখনো কারো পৌষ মাস কারো আবার সর্বনাশ। তোমার অবর্তমানে আমরা কেউ কেউ সর্বহারা, দিশেহারা।
আবার কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ। ছিল রাস্তায়, উঠেছে প্রাসাদে। মাঝে মধ্যে বড় বিব্রত হই। কোনো কোনো সময় কিছুই ভালো লাগে না। আবার তোমার কথা চিন্তা করে শান্ত হই।
তুমি কতবার কতভাবে বলেছ, ত্যাগীরা ত্যাগ করবে, ভোগীরা ভোগ করবেÑ এ নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। তাই মাঝে মধ্যে হতাশ হয়ে পড়লে তোমার ওই সব কথা মনে করে বুকে বেশ জোর পাই, হালকা লাগে। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, তাই এত দিনে কথারও অনেক ডালপালা গজিয়েছে। কত কিছু ঘটে গেছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি।
সারা দেশে ব্যাপক যানজটের মতো তোমাকে বলতে যাওয়া কথা একের আগে আরেক এসে গোলমেলে করে ফেলছে। তবু চেষ্টা করছি সব কিছু ঠেলেঠুলে সোজা রাস্তায় যেতে। তুমি তো জানই, হাতে চাবুক থাকলে আমি সব পারি। তুমি নেই তাই দুর্বল বোধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি আমাদের যোগাযোগ ছিল না।
তোমার আদেশ-নির্দেশ-চেতনাই ছিল মূলধন। তার ওপর ভরসা করেই আমরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। তোমাকে হত্যা করে ঘাতকেরা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের বড় বেশি তি করেছে। সে তুলনায় আমার তি তো খুবই সামান্য। কিন্তু তবু যখন একা থাকি, নীরবে থাকি বুকের ওপর কেমন যেন পাথরচাপার মতো বোঝা অনুভব করি।
তোমার মৃত্যুর দিন ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার। যদি দিন-রাতের হিসাব ধরা হয়, তাহলে সেদিনও গভীর রাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আমার মা লতিফা সিদ্দিকী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ছিল। জেলা গভর্নরদের ট্রেনিং নিতে বঙ্গভবনে যাওয়ার পথে প্রত্যেক দিন সকাল-বিকেল মাকে দেখতে যেতাম। দশ ছেলে-মেয়ের আমার বাবা-মা ছিলেন খুবই ভাগ্যবান।
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা তাদের ঘিরে থাকতাম। সে রাতেও মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইল থেকে বাবর রোডের বাসায় বহু লোক আসায় হাসপাতালে যেতে দেরি হয়েছিল। মায়ের সাথে বি-ব্লকের কেবিনে তখন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের খালা-ফুফু কেউ একজন ছিলেন। মুখে কিছু না বললেও আমাদের জন্য তাদের ডিস্টার্ব হতো।
বুঝতাম তবুও মাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। মাও তার সন্তানদের ছেড়ে থাকতে পারত না। তাই ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় পিজিতে গিয়ে রাত সাড়ে ১২টা বা পৌনে ১টায় সেখান থেকে বেরিয়েছিলাম। রাত ১২টায়ই ১৫ আগস্ট পড়ে গিয়েছিল। তাহলে সেটা ১৫ আগস্ট সকাল হবে, নাকি রাত? নাকি আমরা যেভাবে সূর্য ওঠার পর সকাল ধরি, সেইভাবে ধরলে ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টা বা পৌনে ১টা হবে।
তা যেভাবেই হোক, রাতে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। পিজি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকটা ট্যাঙ্ক দেখি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোল রুম, কাকরাইল মসজিদÑ এসব জায়গায় ট্যাঙ্ক দেখতে দেখতে বাসায় ফেরার পথে মনে হচ্ছিলÑ শেরেবাংলানগর রীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার দেখে যাই। বহু দিন পর তোমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তারই প্রস্তুতি চলছিল সব দিকে।
উত্তেজনার কারণ হয়েছিল আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পুরান ঢাকায় বোমা ফাটায়। সে জন্য তুমি নাকি তিনটি ট্যাঙ্ক নামার অনুমতি দিয়েছিলে। রাস্তায় ট্যাঙ্ক ঘোরাফেরা করতে দেখে রীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে গিয়ে পরিচালক আনোয়ারুল আলম শহীদকে পেয়েছিলাম। ট্যাঙ্ক ঘুরছে কেন বলতেই সে বলছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরান ঢাকায় গ্রেনেড পড়েছে। তাই মহড়া দিতে রাস্তায় তিনটা ট্যাঙ্ক নামাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অনুমতি দিয়েছেন।
’ ‘কী বলো? আমি তো চারটার বেশি দেখলাম। ’ সে বলল, ‘হতেও পারে। আপনি বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলে দেখুন। মনে হয় তিনি এখনো ঘুমাননি। এইমাত্র আমি তার সাথে কথা বলেছি।
’ কত হবে তখন, রাত ১টা ৬-৭ মিনিট। এখনকার মতো তখন কোনো যানজট ছিল না। ক্রিসেন্ট রোড থেকে ডানে মোড় নিয়ে বামে ফিরলেই আমার বাড়ি আর বামে মোড় নিয়ে ডানে ফিরলে তোমার বাড়ি। সে রাতে তাই করেছিলাম। মনে হয় রাত ১টা ১০-১২ মিনিটে তোমার গেটে গিয়েছিলাম।
মিনিটখানেক লেগেছিল গেট থেকে রিসিপশন রুমে যেতে। এক ডিএসপি টেলিফোনের কাছে ছিল। আমাকে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে বলেছিল, ‘স্যার, স্যারকে রিং আমি দেবো, না আপনি দেবেন?’
Ñ না, আপনিই দিন। এক রিংয়েই তুমি ফোন ধরেছিলে। কাদের সিদ্দিকী এসেছে বলতেই বলেছিলে ওকে নিয়ে এসো।
গিয়ে দেখি লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ে দাঁড়িয়ে আছো। পিতার ব্যাকুলতা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে, ‘কী হয়েছে, এত রাতে?’ বলেছিলাম, ‘তুমি তো জানো, মা হাসপাতালে। ’
Ñ হ্যাঁ, তা তো জানিই। সেদিনই তো তাকে দেখে এলাম। কেন, কী হলো?
Ñ না, মায়ের কিছু হয়নি।
মা ভালোই আছেন। কিন্তু মাকে দেখে ফেরার পথে রাস্তায় চার-পাঁচটা ট্যাঙ্ক দেখলাম। আমার ভালো লাগেনি। তাই এসেছি।
Ñ কেন, তুই জানিস না, সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা ফেটেছে? পুরান ঢাকায় বোমা ফেটেছে? বোমাবাজদের বুঝাবার জন্য মহড়া দিতে তিনটা ট্যাঙ্ক বেরোতে পারমিশন দিয়েছি।
Ñ তিনটা কেন, আমি তো বেশি দেখেছি।
Ñ আরে না রে, সবটাতেই তোর সন্দেহ, বাড়াবাড়ি। একটাই হয়তো দু’বার দেখে গোলমাল করছিস।
- না, না, তা হতেই পারে না। চালাকিতে পাকা না হলেও অঙ্কে কখনো অত কাঁচা ছিলাম না।
তিনটাকে চার-পাঁচটা গোনার মতো বেকুব আমি না। ’ আমার কথা শুনে তুমি পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলে, ‘যা, ঘুমা গিয়ে। যদি পারিস সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিস। ’ মনে হয় তোমার সে দিনের স্পর্শ আজো আমার গায়ে লেগে আছে। আমি কিন্তু তোমার কথাতেও সে দিন দমিনি।
আবদার করেছিলাম আমার সাথে ঢাকা শহরে বেরিয়ে পড়তে। তুমি আশ্চার্য হয়ে বলেছিলে, ‘আরে পাগল, আমি দেশের প্রেসিডেন্ট না? একটা রাষ্ট্রীয় প্রটোকল আছে না? আমি একা তোর সাথে বেরোবো কী করে?’ তুমি তো জানই, আমি তোমার কাছেও কিছু চাইতাম না। তাই কথা বলতে দ্বিধা হতো না। কোনো কিছু বলতে ভয় করত না। সাথে সাথে চোখে-মুখে বলেছিলাম, ‘কেন, মাত্র ক’মাস আগে শুধু ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে তুমি যে সন্তোষে হুজুর মওলানা ভাসানীকে দেখতে গিয়েছিলে, তখন তোমার প্রটোকল ছিল কোথায়?’ তুমি অবাক হয়ে বলেছিলে, ‘কী বলিস? ওসব তুই জানলি কী করে?’ ‘কেন, আমি তো তোমাদের পিছেই ছিলাম।
তোমাকে রেখে মনসুর ভাই যখন বাড়ি ফেরেন তখন তার সাথে কথা হয়েছিল। ’ তুমি খুবই অবাক হয়ে বলেছিলে, ‘তাই তো কোনো গাড়ি ফলো করছে বলে ড্রাইভার বলেছিল। ’
Ñ হ্যাঁ, ওটাতেই আমি ছিলাম। তাহলে আজ বাইরে যেতে আপত্তি কোথায়? কত রাজা বাদশাহ তো তার নাগরিকদের সুখ-সুবিধা দেখতে রাতে শহর ঘুরেছে। চলো না যাই।
শহর দেখে বঙ্গভবনে রাত কাটিয়ে সকালে ওখান থেকেই না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে। ’ আমাকে প্রবল জোরে বুকে চেপে ধরে বলেছিলে, ‘শেষ পর্যন্ত আমাকে তুই বাদশাহ হারুনুর রশীদ বানাতে চাস নাকি? পাগলামি করিস না। অনেক রাত হয়েছে, বাড়ি যা। ’ নিচে নেমে ঘড়িতে দেখি রাত ১টা ৪০ মিনিট। সারা জীবন খুব বেশি ঘুমের ওষুধ খেতে হয়নি।
আর তোমার সান্নিধ্যই ছিল আমার কাছে ঘুমের দাওয়াইয়ের মতো। শুয়ে পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
লেখাটা শেয়ার করা।
লিনক.
http://www.dailynayadiganta.com/details/42210 ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।