আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গলির ধারের ছেলেটি কিংবা তালেব মাস্টার কবিতার ড. আশরাফ সিদ্দীকি

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী। এই পৃথিবীর সবাই ভালো থাকুক। তোমরা সবাই ভালো থেকো। এমনটিই ড. আশরাফ সিদ্দীকি কামনা করেন, সবসময়। ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্রছাত্রী সহ কবিতার পাঠকেরা নিশ্চয় তালেব মাস্টার কবিতাটির কথা জানেন।

এই কবিতায় গ্রামের একজন স্কুল মাস্টারের যে নির্মম বেদনা ও দুঃখ দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে, একজন মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষের ভেতরে তা গভীরভাবে রেখাপাত করে সহজেই। কিংবা বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের ছবি সুভাষ দত্ত পরিচালিত ডুমুরের ফুল সিনেমার গল্পটি ড. আশরাফ সিদ্দীকির, যা গলির ধারের ছেলেটি নামে পরিচিত, এবং বাংলা সাহিত্যে এই গল্পটি একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। ড. আশরাফ সিদ্দীকি। যিনি বাংলার লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি আর কিংবদন্তীর কথা লিখে নিজেই এখন একজন কিংবদন্তী হয়ে আছেন। বাংলার লোকঐতিহ্য, সংস্কৃতির ইতিহাস লিখে নিজেই এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন।

একই সাথে যিনি একজন লেখক, একজন কবি, একজন গবেষক, একজন সংগঠক, একজন সমাজ সচেতন মানবিক পুরুষ, একজন শিক্ষাবিদ এরকম অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও সৃষ্টিকর্মকে উপস্থাপন করা দুরূহই বটে। তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, লোক বিজ্ঞানী হিশেবে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমধিক পরিচিত মুখ। প্রাচুর্যের হাতছানি, বিদেশে আয়েশি জীবন যাপনের বহুবার সুযোগ, এই দেশপ্রেমিক মানুষটিকে বিন্দু পরিমাণও আকর্ষিত করতে পারেনি। আমরা হয়ত অনেকে জানিই না, বাংলা একাডেমী বইমেলা, জাতীয় পর্যায়ে বৈশাখী মেলা, যাত্রা ও সং এর নাটক উদযাপন, উচ্চতর পর্যায়ে বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা, চার খণ্ডে নজরুল রচনাবলীর প্রকাশ, প্রাচীন সাহিত্যিকদের রচনা প্রকাশ এবং যার মৌলিক ভুমিকার ফলশ্রুতিতে প্রথম বাংলা টাইপ রাইটার মুনির অপটিমা বাজারজাত করে বাংলা সাহিত্যের বিকাশে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গৃহীত হয়, তিনি ড. আশরাফ সিদ্দীকি। এমনকী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আজকের যে সমাধিস্থল, সেই স্থান নির্বাচনে ড. আশরাফ সিদ্দীকির ভুমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

জীবন ও কর্মঃ বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেসব ব্যক্তিত্ব, আশরাফ সিদ্দীকি তাঁদের মধ্যে একজন। চল্লিশ এর দশকের শুরুতে প্রতিশ্রুতিময় কবি হিশেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই অপার স্বাচ্ছন্দে তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায়। তিনি রচনা করেছেন পাঁচশ’র ও অধিক কবিতা। বাংলার লোকঐতিহ্য নিয়ে করেছেন গভীর গবেষণা।

তিনি একাধারে প্রবন্ধকার, লোকসাহিত্যিক, ছোটগল্প লেখক এবং শিশু সাহিত্যিক। এ অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছিলেন ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও কবি মনসুরুদ্দিনের মতো সর্বসৃজনশীল ব্যক্তিরা। পরবর্তী সময়ে সেই ধারা নিরন্তর গতিশীল রাখতে কাজ করেছেন যারা; ড. আশরাফ সিদ্দীকি তাদেরই একজন। ড. আশরাফ সিদ্দীকি একজন কবি, একজন শিক্ষক, তবে বহির্বিশ্বে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত লোকবজ্ঞানী হিশেবে। জন্ম ও বেড়ে উঠাঃ লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গাইলের নাগবাড়ী গ্রামে ড. আশরাফ সিদ্দীকির জন্ম ও শৈশব।

তাঁর বাবা আব্দুস সাত্তার সিদ্দীকি ছিলেন এ অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারের সন্তান এবং সৌখিন হোমিও চিকিৎসক। আর সেই সুবাদেই তাঁর বাড়ি ডাক্তার বাড়ি বলে পরিচিত। মা সমীরণ নেসা ছিলেন জমিদার কন্যা এবং একজন স্বভাব কবি। তাঁর লালন-পালনের দায়িত্বে ছিলেন সুরতির মা নামের এক গ্রামীণ গৃহকর্মী। সব কথাতেই মা ছড়া কাটতেন আর সুরতির মা শোনাতেন লোকগাঁথা।

তাঁর মনোজগত এভাবে গড়ে উঠে এইসব ছড়া, গান, প্রবাদ, ডাক, খনার বচন আর লোকগাঁথার মধ্য দিয়ে। সেসময় বৃহত্তর পরিসরে যাত্রা, সংয়ের নাটক, পালাগানের অনুষ্ঠান হতো। এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতেন, বাড়ির মেয়েরা নাইওরে আসতেন। ভাই-ভাগ্নে-বন্ধুসহ স্ববান্ধবে কিশোর আশরাফ সিদ্দীকি এগুলো রাতভর উপভোগ করতেন আর দিনভর সেগুলো অনুকরণের চেষ্ঠা করতেন। এই সাহিত্যিকের ছাত্রজীবন শুরু হয় নানাবাড়ির পাঠশালায়।

ক্লাস টু থেকে সেভেন পর্যন্ত পিতার প্রতিষ্ঠিত রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলে পড়েন। আজ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে রতনগঞ্জের সেই স্কুলটি। পরবর্তীতে রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলের পাঠ চুকিয়ে আশরাফ সিদ্দীকি ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। ময়মনসিংহে কলকাতা কেন্দ্রিক বৃহত্তর বাংলা সাংস্কৃতিক জগতের সাথে পরিচয় ঘটে মাতুতালয়ে। এই সময়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন কবিতা।

সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়েই নওরোজসহ একাধিক পত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। সেই কৈশোরেই কবি সিদ্দীকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কিছু ছড়া সংগ্রহ করে পাঠালে, কবি তার উত্তরে ছোট্ট কবিকে আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি লিখেন। কবিগুরুর সেই আশীর্বাদ আজকের ড. সিদ্দীকির নির্মাণে নিঃসন্দেহে বড় ভুমিকা রেখেছে। স্বাভাবিক কারণেই মেধাবী আশরাফ সিদ্দীকি’র পরিবার চেয়েছিলেন তিনি ডাক্তার বা উকিল হবেন। কিন্তু তার সৃজনশীল সাহিত্য মন তাকে পরিচালিত করে, পরিবারের সাজানো ছক থেকে বের হয়ে তার ভবিষ্যত তিনি নিজেই রচনা করেন, চলে যান শান্তিনিকেতন।

সেখান থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যান। শুরু হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ। ড. আশরাফ সিদ্দীকি’র “রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন” এবং “শান্তিনিকেতনের পত্র” পড়লে বোঝা যায় শান্তিনিকেতনের দিনগুলো তাঁর জীবন ও সংস্কৃতি চর্চাকে এক সুত্রে বেঁধে দিয়েছে। এই বিদ্যাপীঠের বছর ভরে ঋতুভিত্তিক উৎসব, পার্বণ উদযাপনের সংস্কৃতি, বহু আলোকিত মানুষের সাহচর্য আর নানা ধর্মের মানব প্রেমের অনুষ্ঠান ও দর্শনগুলোর সাথে নিবিড় অনুষঙ্গ তাঁর মূল্যবোধ গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রাখে। আর তারই সুত্র ধরে তাঁর নিজস্ব দর্শনে, জীবনাচরণে তিনি হয়ে উঠেন একজন মানবপ্রেমিক।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেলো। আশরাফ সিদ্দীকির পরীক্ষার ব্যাপারে দেখা দিলো জটিলতা। তিনি ১৯৪৮ সালে করটিয়া সাদত কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পরীক্ষা দিলেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ড. আশরাফ সিদ্দীকি এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় এম এ ডিগ্রী লাভ করেন।

একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৬৬ সালে শেষ করেন ফোকলোরে পিএইচডি। চাকুরী জীবনঃ ড. আশরাফ সিদ্দীকি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের কুমুদীনি কলেজে। পরে ১৯৫১ সালের ১৫ই জুলাই রাজশাহী সরকারি কলেজে প্রভাষক হিশেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্নেহভাজন। তারই আগ্রহে সে বছর নভেম্বর মাসে গবেষণার জন্য ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

একবছর পরেই সিদ্দীকি ফিরে যান তাঁর পূর্বের কর্মস্থল রাজশাহী কলেজে। ১৯৫৭ সালে তিনি বদলি হয়ে আসেন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকেই তিনি পিএইচডি’র উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমান। পিএইচডি শেষ করে ১৯৬৭ সালে কিছুদিন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের ছাত্রদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার এ এসিস্ট্যান্ট চিফ এডিটর হিশেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার এর চিফ এডিটর নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৬ বছর বাংলা একাডেমীতে কাজ করার পর, ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করেন। এই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হিশেবেই তিনি চাকুরি জীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন। আশরাফ সিদ্দীকি’র কাছে কর্মই ধ্যান।

তাই তিনি চাকুরি জীবন হতে অবসর নিলেও সাহিত্য এবং সংস্কৃতি জগত হতে এক মুহুর্তের জন্যেও অবসর নেননি। প্রকাশনাঃ ড. আশরাফ সিদ্দীকির লেখা ও সম্পাদনায় এ যাবত প্রকাশিত হয়েছে ৭২টি গ্রন্থ। কিশোর বয়স হতে ড. আশরাফ সিদ্দীকির কবিতা অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় কবির কালজয়ী প্রথম কাব্যগ্রন্থ “তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা”। ২৮টি কবিতা নিয়ে রচিত এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।

১৯৫৫ সালে প্রকাশ পায় তাঁর আরও দুটি কবিতার বই “বিষকন্যা” ও “সাত ভাই চম্পা”। ১৯৫৮ সালে কবি প্রকাশ করেন “উত্তর আকাশের তারা”। “তিরিশ বসন্তের ফুল” প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে দুই খণ্ডে, কবির সবগুলো কবিতা একত্র করে। পাঠকদের জন্য কবির বিখ্যাত তালেব মাস্টার কবিতাটা এখানে তুলে ধরলামঃ তালেব মাস্টার (মনিক বন্দ্যোপাধ্যায়- কে) তালসোনাপুরের তালেব মাস্টার আমি: আজ থেকে আরম্ভ করে চল্লিশ বছর দিবসযামী যদিও করছি লেন নয় শিক্ষার দেন (মাফ করবেন! নাম শুনেই চিনবেন) এমন কথা কেমন করি বলি ! তবুও যখন ঝাড়তে বসি স্মৃতির থলি মনে পড়ে অনেক অনেক কচি মুখ, চপল চোখ : শুনুন :গর্বের সাথেই বলি : তাদের ভেতর অনেকেই এখন বিখ্যাত লোক ! গ্রাম্য পাঠশালার দরিদ্র তালেব মাস্টারকে না চিনতে পারেন ! কিন্তু তাদেরকে নাম শুনেই চিনবেন । (মূনাজাত করি ; খোদা তাদের আরও বড় করেন ।

) অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে আমার পিঠ বেঁকে গিয়েছে আর চোখেও ভাল দেখি না তেমন তাই ভাবছি : সময় থাকতে থাকতে এখন আত্মকাহিনীটা লিখে যাবো আমার ! রবিবাবূ থেকে আরম্ভ করে আজকের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপধ্যায় আরও কত সাহেব , চট্টোপাধ্যায় ,মুখোপাধ্যায়, রায় , কত কাহিনীই ত আপনারা লিখে গেলেন ! কিন্তু মানিকবাবু ! আপনি কি এমন একটি কাহিনী শুনেছেন : কোথাও রোমাঞ্চ নেই ! খাঁটি করুণ বাস্তবতা - এবং এই বাংলা দেশেরই কথা ! নমস্কার আমিই সেই তালসোনাপুরের তালেব মাস্টার । আরম্ভটা খুবই সাধারণ ! কারণ রক্তস্নানে শুভ্র হয়ে সত্তর বছর পূর্বে যখন প্রথম আলো দেখলাম,হাসলাম এবং বাড়লাম তখন থেকেই ট্রাজিডি চলছে অবিরাম ! লেখাপড়ায় যদিও খুব ভাল ছাত্র ছিলাম অষ্টম শ্রেণীতে উঠেই বন্ধ করে দিতে হল কারণ - পিতা - মাতার সংসারে নিদারুণ অনটন ! জমিদার সাহেবের কৃপায় চাকুরি জুটে গেল একখানা ডজন খানেক ছেলেমেয়ে পড়ানো ; মাসিক বেতন তিন টাকা আট আনা ! (তাদের ভেতর একজন এখন ব্যরিস্টার ! জানিনা তালেব মাস্টারকে মনে আছে কি না তার !) পাঠশালা খুলেছি তারপর সুদীর্ঘ দিন ধরে বহু ঝঞ্চা ঝড় বয়ে গেছে । ভুলেছি- অক্লান্তভাবেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলেছি । পানির মত বছর কেটে গেল কত ছাত্র গেল, এল- প্রমোশন পেল কিন্তু দশ টাকার বেশী প্রমোশন হয়নি আমার ! কপালে করাঘাত করেছিলাম জীবনে প্রথম সেবার যখন টাকার অভাবে একটি মাত্র ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হল । আক্রার বাজার ।

চাল-নুনেই কাবার ! কী-ই বা করার ছিল আমার ! ঘরে বৃদ্ধ মা বাপ পুরাতন জ্বরে ভুগে ভুগে তারাও যখন ছাড়ল শেষ হাঁপ দু:খ করে শুধু খোদাকে বলেছিলাম একবার: এতো দরিদ্র এই তালেব মাস্টার ! তবু ছাত্রদের বুঝাই প্রাণপণ : ‘সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন ’! দেশে আসলো কংগ্রেস, স্বদেশী আন্দোলন খিলাফতের ঝড় বইছে, এলোমেলো খড়ো ঘরে ছাত্র পড়াই আর ভাবি :এ -ই সুদিন এল ! মন দিয়ে বুঝাই পলাশীর যুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালার হত্যা হজরত মোহাম্মদ,রাম-লক্ষ্মণ আর বাদশা সোলেমানের কথা গুন্ গুন্ করে গান গাই : ‘একবার বিদায় দাও মা গো ঘুরে আসি অভিরামের হয় দ্বীপান্তর ক্ষুদিরামের হয় -মা গো ফাঁসি ’! আসলো মোসলেম লীগ, কম্যুনিস্ট বন্ধু সকলের কথাই ভাল লাগে : ভাবি এরাও বুঝি দেশের বন্ধু ! কোথায় শুনি ঝগড়া লেগেছে । আগুন জ্বলেছে জ্বলুক ! ওরা- তবু ত জেগেছে! ভায়ে ভায়ে ঝগড়া কদিন থাকে ! নিভবেই! বলি : লেজে যদি তোদের আগুন লেগেই থাকে তবে শত্রুর স্বর্ণ- লঙ্কাই পোড়া ! ছেলেটি কাজ করে মহাজনী দোকানে মাসিক পাঁচ টাকা বেতন । প্রাণে তবুও বেঁচে আছি আসলো পঞ্চাশ সাল ঘরে- বাইরে হাটে-বাটে আকাল। ঘোর আকাল ! একশো টাকা চালের মণ- পঞ্চাশ হায় পঞ্চাশ ! ঘরে বাইরে দিনের পর দিন উপাস হায় উপাস! গ্রামের পর গ্রাম কাল- কলেরায় উজাড় ! নিরীহ তালেব মাস্টারের বুকেও বজ্র পড়লো ! কলেরায় ছেলেটি মারা গেল বিনা পথ্য বিনা শুশ্রষায় ! কাফনের কাপড় জোটেনি তাই বিনা কাফনে বাইশ বছরের বুকের মানিককে কবরে শুইয়ে দিয়েছি এখানে ! এ-ই শেষ নয় -শুনেন : বলি : মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিলাম পলাশতলী সেখানেও আকাল ! মানুষে মানুষ খায় । তিন দিনের উপবাসী আর লজ্জা বস্ত্রহীন হয়ে নিদারুণ ব্যথায় দড়ি কলসী বেঁধে পুকুরের জলে ডুবে মরেছিল একদিন সন্ধ্যায় মানিকবাবু, আমি জানি : প্রাণবান লেখনী আপনার তালেব মাস্টারের সাথে হয়ত আপনিও অশ্রু ফেলছেন বেদনার কিন্তু আশ্চর্য ! আজও বেঁচে আছি আমি এবং অক্লান্তভাবে দিবসযামী তালসোনাপুরের প্রাইমারী পাঠশালায় বিলাই জ্ঞানালোক: ছাত্রদের পড়াই -‘ধৈর্য্য ধরো, ধৈর্য্য ধরো বাঁধ বাঁধ বুক যত দিকে যত দু:খ আসুক আসুক ...’।

শুভাকাঙ্খীরা সকলে আমায় বলে ‘বোকা মাস্টার’ কারণ ঘরের খেয়ে যে বনের মোষ তাড়ায় তা ছাড়া সে কি আর ! যুদ্ধ থেমে গেছে । আমরা তো এখন স্বাধীন । কিন্তু তালেব মাস্টারের তবু ফিরল না তো দিন ! স্ত্রী ছয় মাস অসুস্থা আমারও সময় হয়ে এসেছে : এই তো শরীরের অবস্থা ! পাঁচ মাস হয়ে গেছে : শিক্ষা বোর্ডের বিল নাই । হয়ত এ - বারের টাকা আসতে আসতে শেষ হবে আয়ু তাই শতছিন্ন জামাটা কাঁধে ফেলে এখনো পাঠশালায় যাই ক্ষীণ কন্ঠে পড়াই: ‘হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে... মনে মনে বলি : যদিই ফোটে একদিন আমার এইসব সূর্যমুখীর কলি! ইতিহাস সবই লিখে রেখেছে । রাখবে- কিন্তু এই তালেব মাস্টারের কথা কি লেখা থাকবে? আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু নিজের জীবনই অন্ধকারমালা ।

মানিকবাবু ! অনেক বই পড়েছি আপনার পদ্মানদীর মাঝির ব্যথায় আমিও কেঁদেছি বহুবার খোদার কাছে মুনাজাত করি : তিনি আপনাকে দীর্ঘজীবী করুণ আমার অনুরোধ: আপনি আরও একটা বই লিখুন আপনার সমস্ত দরদ দিয়ে তাকে তুলে ধরুন আর,আমাকেই তার নায়ক করুন ! কোথাও রোমান্স নেই ! খাঁটি করুণ বাস্তবতা আর এই বাংলাদেশেরই কথা। । চলবে... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.