(একজন লিপির আত্নকথন)
মাঝে মাঝে মনটা বড় উদাস হয়ে যায়। একাকিত্ব ঘিরে ধরে আমার চারিদিকে। জীবনের সেই কালো দিনগুলো আমার সব কিছুকে গোল পাকিয়ে দেয়। ভাবি, আমার এই রক্ত মাংশের দেহ হয়তো এই সভ্য সমাজে ফিরে এসেছে কিন্তু মনটা কি ফিরে পাবোনা?সেই কৈশরের হারিয়ে যাওয়া পবিত্র দিনগুলির মত,যে সময় আমার ভাবনা ছিলো উজ্জ্বল উচ্ছল। আমার জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না,স্বপ্ন ছিলো,জীবন চলার পথ অতিক্রম করবো বহমান নদীর মত, যে চলার পথে থাকবে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ।
কিন্তু কেন আমার চলার পথে অশ্রু আর কাঁটায় ভরা। আমি আজ খাঁচায় বন্দী বাবা মায়ের অবিশ্বাসের পুতুল। মাঝে মাঝে মনটা সন্তান হারা বাঘিনীর মতো হিংস্র জানোয়ার হয়ে যায়। ঘৃণা হয় এই সমাজ ব্যবস্থার উপর। টেনে হিচরে খুলে দিতে ইচ্ছে করে প্রেমিক নামধারী ভদ্রবেশী প্রতারকদের মুখশ।
যারা আমার জীবনের সমস্ত স্বপ্নকে একদিন মাটি চাপা দিয়ে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো অন্ধকার জগতে।
আমি ছিলাম যশোর জেলা শহরের দুই ভাই বোন ও বাবা মায়ের সংসারের এক মাত্র আদরের কন্যা। বাবা আমার নাম রেখে ছিলো লিপি। বাবা মা দুঃখ কি কখনো বুঝতে দেয়নি। দুই ভাই বোনের প্রত্যাশার অপূর্ণতা রাখেনি কখনো।
সব মিলিয়ে আমাদের সংসারটা ছিলো ভালোবাসা আর সুখে পরিপূর্ণ একটি ছোট্ট নীড়। এই সুখ আর ঐশর্য্যের মধ্যে দিয়ে একদিন শৈশব কৈশরের খোলশ ঝেড়ে ফেলে পদার্পন করলাম যৌবনে। যৌবনে অন্য আট দশটি মেয়ের মত আমিও স্বপ্ন দেখেছি প্রেমিকের ভালোবাসা পাওয়ার। কল্পনা তাড়িত মন ভেসে বেড়াতো মেঘের ভেলায়। স্বপ্নের মানুষটির জন্য অধির হয়ে থাকতাম সব সময় ।
ভাবতাম,আমার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হারিয়ে যাবো কল্পলোকে, যেখানে থাকবেনা কোনো সংঘাত,থাকবে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা। একদিন কল্পনার মানুষটি বাস্তবতায় রুপ নিয়ে আবির্ভাব ঘটলো আমার জীবনে। ওর নাম পার্থ। ওর ডাকেই সাড়া দিয়ে সমস্ত দেহ প্রাণ মন সপে দিয়েছিলাম শুধু ওর ভালোবাসার জন্য। এক বাঁধ ভাঙ্গা ভালোবাসায় হাবুটুবু খেয়েছি দিনের পর দিন।
ওই সময়টাতে আমার সমস্ত চিন্তা চেতনায় পার্থকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনি। ওর যে গুনটি আমাকে সব চেয়ে বেশী মুগ্ধ করতো সেটি হলো ওর শুদ্ধ করে গুছিয়ে কথা বলা। । ওর মুখের একটু মিষ্টি কথা শোনার প্রতিক্ষার প্রহর গুনে আমার দিনগুলো পার হয়ে যেতো। কতো দিন কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্থের হাতে হাত রেখে পার্কের লেকের ধারে কাঁটিয়ে দিয়েছি ঘন্টার পর ঘন্টা বুঝতেই পারিনি।
এভাবেই একটা ঘোরের মধ্যে জীবন থেকে কেটে গিয়েছে ছয়টি মাস।
এর পর থেকে পার্থের মধ্যে লক্ষ্য করতে লাগলাম নতুন একটি লক্ষণ,ও মাঝে মাঝে আমার কাছে টাকা চাইতো। ও চেয়েছে এই ভেবে কোন কিছু না জিজ্ঞেস করেই ওকে টাকা দিতাম। কিন্তু ব্যাপারটা যখন নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাড়ালো, তখন আমার মধ্যে একটু একটু করে সন্দেহ বাসা বাঁধতে লাগলো। কৌতুহলের জায়গা থেকে অনুসন্ধান করে জানতে পারি পার্থ মাদকাসক্ত ও জুয়া খেলার প্রবনতাও রয়েছে।
ব্যাপারটা জানার পর নিরবে নিভিতে কেঁদেছি অনেক দিন। আমার ভাবতেই কষ্ট হতো যে আমার ভালোবাসার মানুষটি অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। অনেক দিন ক্ষোভে দুঃখে পার্থের সাথে দেখা করিনি। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি ওর জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু ওর ভালোবাসা আমার দেহ মনকে এতটাই আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলো যে বার বার নিজের কাছে নিজেই হেরে গিয়েছি।
এক দিন আমার মাথায় হাত রেখে পার্থ শপত করে বলেছিলো, এখন থেকে সে আর অন্ধকারে পা বাড়াবে না,তবুও যেন ওর জীবন থেকে আমি মিলিয়ে না যাই। সেই দিন ওর মধ্যে আমার জন্য যে আকুতি দেখেছিলাম, যে হাহাকার দেখেছিলাম আমি আর ফিরে আসতে পারিনি ওর জীবন থেকে। নতুন এক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে আমরা ভালোবাসার নতুন দিগন্তে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। এর পর থেকে পার্থ আমার কাছে আর টাকা চাইতো না। ওর আচরনে পরিবর্তনের এক নতুন ধারা লক্ষ্য করলাম।
বাবা মায়ের অগোচরে আমার আর পার্থের সম্পর্ক আরো এক বছর অতিবাহিত হলো।
এর মধ্যে বাবা আমার জন্য অন্য একটি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে। ছেলে ঢাকাতে ব্যবসা করে। অর্থ বিত্ত ও বৈভব সবই আছে। বাবা বিয়ের পাকা কথাও ছেলে পক্ষের সাথে চূরান্ত ফেলে।
ধীরে ধীরে বিয়ের চূরান্ত লগন ঘনিয়ে আসতে লাগলো। আর আমার পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। কি করবো কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। পার্থকে সব কিছু খুলে বললাম একটা উপায় বের করার জন্য। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে পার্থের ব্যাপারে বাবা মাকে বললে কখনোই রাজী হবে।
বাবা কখনোই চাইবেনা বিয়ের চূরান্ত কথা তুলে নিয়ে পার্থের মত বেকারের হাতে আমাকে তুলে দিতে। আর পার্থের মাদকাসক্তের ব্যাপারটা যদি কোন ভাবে জেনে ফেলে তাহলে হিতে বিপরিত হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি। তাই বাবা মাকে পার্থের বিষয়টা বলার ব্যাপারে সেদিন সাহস করিনি। পার্থও সাফ জানিয়ে দেয় এই মূহুর্তে বিয়ের ব্যাপারে তার পরিবারের সাথে কথা বলা সম্ভব নয় তবে আমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। পার্থ একটি উপায় বের করে বলে,লিপি চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করে কিছু দিন লুকিয়ে থাকি দেখবে এক সময় উভয় পরিবারই আমাদেরকে মেনে নেবে।
পার্থকে জীবন থেকে না হারানোর আশায়, কোন উপায় না পেয়ে আমার বিবাহের চূরান্ত দিনের ২দিন আগে পার্থের কথা মত, সরল বিশ্বাসে মায়ের সোনার অলংকার,সিন্ধুক থেকে ত্রিশ হাজার টাকা ও আমার প্রয়োজনীয় কাপড় চোপর নিয়ে গভীর রাতে পার্থের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
পার্থ একটি মাইক্রোবাস বাস ঠিক করে রেখেছিলো, ঐ মাইক্রোবাসেই আমরা রওয়ানা হই এবং ভোর রাতে এসে পৌঁছাই এক নদী বন্দরে। নদী বন্দরের ডান পাশে ছোট ছোট ঝুপরি ঘর বিশিষ্ট বিশাল চরপাড়া গাঁও। ঐ পাড়াগাঁও দেখিয়ে পার্থ আমাকে বলে, এখানে আমার এক বোন থাকে,ঐ বোনের বাড়ীতেই এখন থেকে আমরা সংসার পাতবো। একটা বাঁশের সাঁকো পার হয়ে পার্থ আমাকে দ্রুত পাড়া গাঁয়ের একটি বাড়ীতে নিয়ে যায় এবং বলে এইটাই আমার বোনের বাড়ী।
একটা ঘরের মধ্যে আমাকে বসিয়ে রেখে পার্থ প্রায় চল্লিশ বছরের বয়স্ক এক মহিলার সাথে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতে থাকে,আলাপের এক পর্যায়ে মহিলা পার্থকে অনেকগুলো টাকা দেয়। আলাপ শেষ করে পার্থ আমার কাছে এসে বলে,লিপি নতুন সংসারের জন্য অনেক কিছু কিনতে হবে,অনেক টাকার প্রয়োজন তার উপর বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলতে হবে,কিছুতেই দেরি করা ঠিক হবে না,আমার কাছেতো তেমন কোন টাকা পয়সা নেই,তোমার কাছে যা টাকা পয়সা ও স্বর্ণের অলংকার আছে আমাকে দিয়ে দাও,প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসি আর কাজী ডেকে নিয়ে আসি। আমি পার্থকে নগদ পঁচিশ হাজার টাকা ও স্বর্ণালংকর যা ছিলো সব ওর হাতে তুলে দেই। "আমি সব কাজ কর্ম সেরে যত দ্রুত সম্ভব কাজী সাথে করে নিয়ে ফিরে আসবো, তুমি তৈরী থেকো" এই বলে পার্থ আমাকে রেখে চলে যায়।
পার্থ চলে যাওয়ার এক ঘন্টা পর পার্থের কথিত বোন এসে আমাকে বলে "এই মেয়ে তোমাকে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে,খবরদার এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে না,চেষ্টা করলে পরিণাম ভালো হবেনা,আমাদের লোক চারদিকে ছড়িয়ে আছে নিশ্চিৎ ধরা পড়ে যাবে,অনেক দূর থেকে যাত্রা করে এসেছো আজ ভালোভাবে বিশ্রাম নাও আগামী কাল থেকে ঠিক মত কাজ শুরু করে দেবে"
.... মহিলার কথাগুলো শোনার পর আমার বুঝতে খুব একটা দেরি হলোনা যে আমি কোন নড়কপুরিতে এসে পৌঁছেছি।
মহিলা কিছু উপদেশ বানী শুনিয়ে বললো,এখানে যে পুরুষেরা আমাদের কাছে আসে তারা আমাদের কাছে মনিবের মত,এদের সাথে কখনো খারাপ আচরন করবেনা যতটা সম্ভব ভালো ব্যবহার করবে যাতে পুনরায় তোমার কাছে আসে আর এখন থেকে তোমার নাম হবে মহুয়া।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,নিকোশ কালো অন্ধকার ভেদ করে পূর্ব গগনে সূর্য্য উঠলো কিন্তু পার্থ আর আমার কাছে ফিরে এলোনা। মনে মনে ভাবতে লাগলাম পার্থ তুমি জুয়ারী ছিলে আমি জানতাম কিন্তু তুমি একদিন আমার মাথায় হাত রেখে শপত করে বলেছিলে,তুমি আর অন্ধকারে পা বাড়াবে না কিন্তু সেই তুমিই আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে আমার জীবন নিয়ে জুয়া খেললে!আমিতো ভালোবাসা ছাড়া তোমার কাছে আর কিছুই চাইনি, সমস্ত কষ্ট মেনে নিয়েইতো তোমার হাত ধরে সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পথে বেড়িয়ে পড়লাম কিন্তু তুমি কেন একটা জীবন,একটা স্বপ্নের সাথে ঘাতকতা করলে?কোন কিছুরই উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলামনা,জীবনের কোন হিসেব মেলাতে পারছিলামনা আমি।
জানতে পারলাম এই পল্লীর নাম দৌলতদিয়া পতিতা পল্লী,রাজবাড়ী জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর পতিতা পল্লী। আমার কোন আকুতি,কোন অনুনয়,কোন অনুরোধ কোন কিছুতেই মন গলাতে পারলোনা পাথর হৃদয়ের আমার পতিতা সর্দারানীর,মুক্তি মিললোনা আমার,আমার নতুন পরিচয় হলো মহুয়া পতিতা নামে,জীবনের যাত্রা শুরু হলো অন্ধকার জগতের এক নতুন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে।
জীবনে স্বপ্ন দেখেছি একটি বাসর শয্যা হবে,অনেক যত্নে সংরক্ষিত সতিত্ব সমর্পণ করবো প্রেমিক পুরুষের হাতে কিন্তু সেই সতিত্ব লুটে নিলো মানুষ রুপি এক আধমরা হিংস্র জানোয়ার। হায়রে নিয়তি.....!অনেক বার আত্নহত্যার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হয়নি।
এই পল্লীতে প্রতিদিন অর্থের বিনিময়ে আমার দেহ হাত বদল হতো ভদ্রলোকের খোলশ লাগানো বিভিন্ন পরুষদের হাতে আর রাত হলে মাঝে মাঝেই আমার সর্দারানী আমার ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে যেতো বিভিন্ন বয়সী পুরুষ। এভাবেই চলতে লাগলো আমার ধারাবাহিক জীবনপঞ্জি। আমার বাড়িওয়ালী আমার দেহ বিকিয়ে যে অর্থ আয় করতো তার বিনিময়ে আমার কপালে জুটতো তিন বেলা পেটপুরে খাবার আর বাজারের ভোগ্য দেহটাকে সাজিয়ে রাখার বস্ত্র ও প্রসাধনী সামগ্রী।
রাতে যে সব পুরুষ আমার সাথে থাকতো তাদের অনেকের কাছে হাত জোর করে মিনতি করে বলেছি,'ভাই আমাকে বাঁচান, আমি এখানে প্রতারনার শিকার,দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন এই নরকপুরি থেকে'। আমার আর্তনাদে কিঞ্চিৎ পরিমান হৃদয় গলেনি নারী পিপাশু পুরুষদের। বরং সাড়া রাত ভোগ আনন্দে মেতে উঠে ভোর হলে ভদ্রলোকের লেবাজ লাগিয়ে ফিরে যেত আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজে। এই পতিতা পল্লীর জীবন থেকে চিনতে পেরেছি আমাদের সভ্য সমাজের দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকারের চরিত্র।
রাতের পুরুষদের কাছে মুক্তির জন্য সাহায্যের বিষয়টা আমার বাড়িওয়ালী জেনে ফেলার পর থেকে আমার উপর মাঝে মাঝেই চলতো শারিরিক নির্যাতন, সেই সাথে আমার উপর শকুন দৃষ্টি আরো বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
এক রাতে বাড়িওয়ালী আমার ঘরে আনুমানিক পঁচিশ বছরের এক যুবককে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যায়। যুবকটি ঘরে ঢুকেই দীর্ঘক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিজে থেকেই আমার সম্পর্কে জানতে চায়। এই পল্লীতে যত রাত বিভিন্ন পুরুষের সাথে রাত কাটিয়েছি কেউ নিজ থেকে আমার সম্পর্কে জানতে চায়নি। যুবকটিকে দেখে আমার মধ্যে অন্য রকম ভালোলাগা এক অনুভূতি অনুভব করলাম।
তাই আমার সমস্ত ঘটনা,সমস্ত বেদন ব্যক্ত করলাম যুবকটির কাছে। আমার সব কিছু শোনার পর যুবকটি আমাকে সমবেদনা জানালো এবং আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে আমার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিলো। যুবকটির নাম রিয়াজ। রাজবাড়ী জেলার ছেলে। রিয়াজ ভোর বেলা আমার কাছ থেকে যাবার বেলায় বললো,'দুই দিন পর এসে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো,তৈরি থেকো' আর আমাকে কিছু কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিলো।
রিয়াজ চলে যাওয়ার পর মনে হলো,লোকটা ভালো মানুষ সাজার জন্য সুন্দর কিছু কথা বলে গেলো,আসলে সুন্দর কথায় মোহিতো হয়েইতো আজ জীবনের এই পরিণতি, তাই কোন সুন্দর কথাই এখন আর হৃদয়ে দাগ কাঁটেনা।
ঠিক দুই দিন পর রাত আটটার দিকে বিয়াজ আমার ঘরে হাজির। রিয়াজকে দেখে আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে ওকে জরিয়ে ধরেছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিলো,আজকেই হয়তো আমার দুর্বিসহ জীবনের অবসান ঘটবে। ঠিক তাই,রিয়াজ আমাকে খুব দ্রুত তৈরী হয়েনিতে বলে,ওর নির্দেশনা অনুযায়ী এখান থেকে বের হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেলি।
রাত ১টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে পতিতা পল্লীর সমস্ত কালো দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আমরা দৌলতদিয়া ঘাঁট এলাকায় পৌঁছাই। তারপর রিয়াজের রিজার্ভ করে রাখা মাইক্রোবাসে আমরা যশোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। রাত চারটার দিকে আমাদের মাইক্রোবাস যশোর শহরে এসে পৌঁছায়। ড্রাইভারের ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে রাতের বাকিটুকু সময় আমরা একটা হোটেলে কাটাই।
হোটেলে একটু রেষ্ট নিয়ে ফ্রেস হয়ে দুপুরের দিকে আমি আর রিয়াজ আমাদের বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেই।
রওনা দেয়ার আগে রিয়াজকে বলি,রিয়াজ তুমি আমাদের বাড়ীতে আমার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেবে এবং এখন থেকে আমাকে মহুয়ার পরিবর্তে লিপি নামে ডাকবে,বাকীটা আমি সামলাবো। রিয়াজ আমার কথা মত রাজি হয়।
বাড়ীতে পৌঁছে কলিংবলে টিপতেই মা গেট খুলে আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে থাকে। মাকে বলি,মা ও তোমাদের জামাই, রিয়াজ। মা আমাকে এবং বিয়াজকে ঘরে তুলে নিয়ে যায়।
মা তার হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পেয়ে আমার প্রতি তার অভিযোগ,ক্ষোভের পরিবর্তে তার মধ্যে এক অনাবিল আনন্দধারা লক্ষ্য করলাম। মায়ের আনন্দ দেখে আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছিলো। ভয় ছিলো বাবাকে নিয়ে। কিন্তু বিকেলে বাবা বাড়ী ফিরলে মা বাবাকে বুঝিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক করে। রিয়াজকে বাবার সাথে পরিচয় করি দিলে বাবা রিয়াজকে স্বাভাবিক ভাবে জামাই হিসেবে গ্রহন করে।
বাবার কোন বড় ছেলে না থাকায় রিয়াজকে পেয়ে বাবা এক দিক থেকে খুশীই হয়েছিলেন। তাই বাবার দুইটি ব্যবসার দায়িত্ব বাবা রিয়াজকে বুঝিয়ে দেন। রিয়াজ বাবার ব্যবসা ও অন্যান্য দায়িত্ব দক্ষতার সহিত পালন করায় কয়েক দিনের মধ্যে খুব বিশ্বস্ত হয়ে যায়। সেই সাথে রিয়াজের আচার আচরন পরিবারের সবার মধ্যে এক মুগ্ধতা এনে দেয়। মনে হচ্ছিলো আমাদের পরিবারটা যেন আবার সেই পুরোনো হাঁসি আনন্দে ভরে উঠেছে।
যেন শুস্ক মরুতে বৃক্ষ উদ্যানে ছেয়ে যাওয়ার মত।
এক রাতে রিয়াজকে বলি,'রিয়াজ এভাবে মিথ্যে স্বামি স্ত্রী সেজে আর কত পাপ করবো,এসো আমরা গোপনে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলি'। রিয়াজ আমার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যায়। আমরা দুজন মিলে বিয়ের দিন ধার্য্য করি ২৫নভেম্বর। এর পর থেকে আমি ২৫ নভেম্বরের প্রতিক্ষায় প্রহর গুনতে থাকি আর রিয়াজকে প্রকৃত স্বামি হিসেবে পাবো এই ভেবে হৃদয়ে পুলক লাগছিলো।
অন্য রকম এক অনুভূতিতে আমার সমস্ত দেহ মন ভেসে যাচ্ছিলো। জীবনের অন্ধকার স্মৃতিকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবনের স্বপ্ন বীজ বুনতে শুরু করছিলাম।
২৪নভেম্বর রিয়াজ বাসা থেকে নাস্তা করে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। ঐ দিন দুপুরে খেতে বাড়ীতে আসেনা। ভেবেছিলাম দোকানে কাজের বেশী ব্যস্ততার কারনে আসতে পারে নাই,হয়তো বাইরে থেকে খেয়ে নিয়েছে।
রাতে বাবা বাড়ী ফিরে এলে, বাবাকে রিয়াজের কথা জিজ্ঞেস করলে বাবা জানায় রিয়াজতো আজকে দোকানে বসেনি। এ কথা শোনার পর সারা রাত আমি না ঘুমিয়ে রিয়াজের প্রতিক্ষায় থাকি কিন্তু ঐ রাতে রিয়াজ আর বাসায় ফেরেনা। আমার প্রতিক্ষার কাংখিত ২৫তারিখ আসে, ২৬তারিখ চল যায়, এভাবে আরো দশ দিন অতিবাহিত হয় কিন্তু রিয়াজ আর আমার কাছে ফিরে আসেনা।
রিয়াজের জন্য আমি মানসিক ভাবে প্রচন্ড রকম ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমার এমন মানসিক অবস্থা দেখে বাবা আমার কাছে রিয়াজের যে ঠিকানা ছিলো ঐ ঠিকানা নিয়ে রিয়াজের খোঁজ করতে রাজবাড়ী যায়।
কিন্তু বাবা রাজবাড়ী থেকে ফিরে এসে জানায় ঐ ঠিকানায় রিয়াজ নামে কেউ থাকেনা। খবরটা শুনে আমি নির্বাক নিথর হয়েগেলাম। রিয়াজের সান্নিধ্যে আমি ক্রমান্বয়ে আমার অভিশপ্ত অতীতকে ভুলে জীবনের স্বাভাবিক গতি ফিরে পাচ্ছিলাম,স্বপ্ন দেখছিলাম নতুন একটি সোনালী ভবিষ্যতের। বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও পদদলিত করে রিয়াজের অস্তিত্ব মিলিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে। এখন আমার কোন বর্তমান নেই,ভবিষ্যৎ নেই..এই পৃথিবীর বুকে আমি যেন শুধুই এক দিক ভ্রান্ত...পথিক............................
বিঃদ্র যখন সাংবাদিকতার সাথে জরিতো ছিলাম তখন পেশাগত কারনে এই গল্পের রিয়াজ চরিত্রের সাথে আমার বাস্তবে আলাপ হয় এবং তার কাছ থেকে জানতে পারি এই গল্পের নায়িকা লিপির জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা।
ঘটনাটা শুনে আমার মধ্যে চরম এক অনুতপ্ততা অনুভব করি লিপির জন্য। সেই অনুতপ্ততার জায়গা থেকে আমার অনুভূতিতে লিখে ফেলি অন্ধ গলির জীবন নামে লিপির আত্নকথন। লেখাটি প্রথম ছাপা হয় ০৯ ডিসেম্বর ২০০০ সালে দৈনিক গতকাল পত্রিকায়। লিপির জীবনের এই পরিণতির জন্য লিপির অন্ধ আবেগী ভালোবাসা দায়ী? পার্থ দায়ী? পিতা মাতার অবাধ ভালোবাসা? রিয়াজ?নাকি আমাদের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা,নাকি লিপির নিষ্ঠুর নিয়তি........?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।