দেশহীন মানুষের কথা
পাহাড়ের বন্ধু, যেয়ো না দেশান্তর
সঞ্জীব দ্রং | তারিখ: ০৯-০৪-২০১৩
আমরা কি একটি স্বপ্নহীন, দিশাহীন রাষ্ট্র ও সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছি? হয়তো বা এ কারণেই হরতালের দিন আমাদের এক বন্ধু চলে গেল দেশান্তরে। কয়েক দিনের মধ্যে আরও কয়েকজন চলে যাওয়ার পথে আছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা শহরে পিআর (পারমানেন্ট রেসিডেন্ট) নিয়ে বন্ধুটি চলে গেল সপরিবারে। ওদের সাড়ে তিন বছর বয়সী ফুটফুটে একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি আদিবাসী ককবরক গান গাইত চমৎকার, বাংলা গানও গাইত।
আমাকে দেখলে কোনো কোনো দিন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরত।
যে বন্ধুকে আমরা হারালাম, সে খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছিল মেলবোর্নে। প্রথমবার খুব ভালো ফল করার কারণে অস্ট্রেলিয়া সরকার তাকে দ্বিতীয়বার বৃত্তি দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। ফিরে এসে পাহাড়ি ছেলেটি জাতিসংঘ আর আইএলওতে কাজ করছিল।
ভালো বেতন ও সম্মানীর চাকরি। দেশে থেকে নয় বছরের বেশি সেবা দিয়ে সে অবশেষে চলে গেল। ধরে নিলাম, ছেলেটির বাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের চেংগী নদীর তীরে কোনো পাহাড়ি গ্রামে অথবা দীঘিনালার কাছে ভাইবোনছড়ায় অথবা কুরাদিয়াছড়ায়। ছেলেটি বলত, শৈশবে তাকে গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হতো। বহুদূরের পাহাড়ি পথ বেয়ে, ছড়ার পানি পেরিয়ে স্কুলে যেতে হতো।
আমার স্থির বিশ্বাস, ছেলেটি আমার কাজকে ভালোবাসত। ও জানত, লেখালেখির বাইরে আমি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়ে বেড়াই। ওর কারণেই আমি সর্বশেষ গত ২৫ মার্চ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিলাম। কয়েক শ শ্রোতার মধ্যে প্রায় সবাই বাঙালি ছাত্রছাত্রী, কয়েকজন বিদেশি ছাড়া। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন।
তিনি আমার বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। আদিবাসী জীবন ও অধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই মানুষ। আকাশসীমার এক পৃথিবী, রক্ত সবার লাল। চাঁদ-সুরুজের আরতি হয় সন্ধ্যা ও সকাল। আবার বলেছিলাম ওই গানের মতো, প্রথমত আমি মানুষ, দ্বিতীয়ত আমি মানুষ, তৃতীয়ত এবং শেষ পর্যন্ত আমি মানুষ।
দুঃখের বিষয়, মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে বৈষম্য আছে। যেদিন সমাজে ও রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না, সেদিন আমাদেরও আদিবাসী হিসেবে অধিকার চাইতে হবে না। আমি বলেছিলাম, ধরে নিই আজ ২৫ মার্চ, ২০১৩। আজ নিশ্চয় আফগানিস্তানের কান্দাহারে একটি কন্যাশিশুর জন্ম হবে। আবার নরওয়ের অসলোতে অথবা কানাডার অটোয়াতে অথবা সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে কন্যাশিশুর জন্ম হবে।
আমার প্রশ্ন হলো, কান্দাহারের কন্যা আর অসলো বা অটোয়ার কন্যাশিশুটি কি সমান অধিকার ও মানমর্যাদা নিয়ে বড় হবে? যদি না হয়, তবে কেন হবে না? আমি আরও প্রশ্ন করেছিলাম, থানছি বা রোয়াংছড়ির কোনো শিশু অথবা রংপুরের গঙ্গাছড়ার কোনো শিশু আর এই ঢাকা নগরের দামি হাসপাতালে জন্মানো শিশু কেন সমান মর্যাদা পাবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। আমাদের রাষ্ট্র আর পৃথিবী বৈষম্যপীড়িত। আমরা অন্য রকম পৃথিবী ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি, যেখানে আদিবাসী মানুষকে তার ভিন্ন পরিচয়ের কারণে শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হতে হবে না।
যে ছেলেটি একেবারে চলে গেল দেশান্তরে, বুঝি বা সুন্দরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অথবা বর্তমান যা-ই হোক, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
দেশান্তরে ওর চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম আরও কিছুকাল থেকে যেতে। এই দুঃখিনী মায়ের দেশে যোগ্য ও ভালো মানুষের তো সত্যি আকাল। ও কিছুদিন থেকে গিয়েছিল। স্ত্রী ও সন্তানকে ক্যানবেরায় রেখে এসে আবার একাকী ফিরে এসেছিল দেশে।
গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশে ছিল। আমি আর কী করে বলি আরও কিছুদিন থেকে যেতে? গত কয়েক মাসে দেশ চলছে অনিশ্চয়তার মধ্যে। হরতালের পর হরতাল। এখানে মানুষের জীবন মূল্যহীন। সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ঘরবাড়ি প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে।
আমি ভাবলাম, ওকে আরও কিছুদিন থেকে যেতে বলা হবে ভীষণ ভুল।
তাই তার যাওয়ার বেলায় আমরা বন্ধুরা মিলে ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম। তরুণ-তরুণীরা গান গাইল। রাজা দেবাশীষ রায় চাকমা গান গাইলেন। আমি আর রোবায়েত ফেরদৌস মিলে একটি কবিতা লিখে বাঁধাই করে দেশান্তরি বন্ধুর হাতে তুলে দিলাম।
এই উপহার তুলে দেওয়ার আগে আমরা কবিতাটি পাঠ করলাম:
প্রিয় বন্ধু,
...কখনো যদি অলস দুপুরে, অথবা মধ্যরাতে আলো ঝলমল আর
ভরা জোছনায় ক্যানবেরার আকাশপানে চেয়ে প্রিয় জন্মভূমি কুরাদিয়াছড়া আর ভাইবোনছড়ার
পায়ে হাঁটা পথ, চেংগী নদীতীরে ফেলে যাওয়া স্বজনের কথা মনে পড়ে,
যদি ভিনদেশে অকারণে বুক শূন্যতায় হাহাকার করে ওঠে,
হে বন্ধু, চলে এসো, আমরা তো রয়েছি এখানে,
ফিরে এসো পাহাড়ি জননীর চোখ ছলছল স্নেহছায়ায়,
বুকে বুক বেঁধে আজ বলি, হে বন্ধু, বিদায়!
এই কবিতা শুনতে শুনতে ছেলেটি কেঁদে দিল শিশুর মতো। পুরো সভাকক্ষ স্তব্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বর্তমানে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. ডালেম বর্মণ ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা কি ভেবে দেখেছি, কেন আমাদের এ জন্মভূমি ছেড়ে মেধাবী সন্তানেরা চলে যাচ্ছে। কেন তারা চলে যায়? আবার দেশান্তরে যাওয়ার সময় কেন তবে চোখের জলে ভাসে?
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।