আমি খুবই সাধারণ রাসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘আর আমি তোমাদের পাঁচটি জিনিসের আদেশ দিচ্ছি, যা আল্লাহ্ আমাকে আদেশ করেছেনঃ আল-জামা’আ (ঐক্য), শোনা, মানা, হিজরত এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। ’’ [আহমদ, হারিছ আল আশআরী (রদিয়াল্লাহু আনহু)] এবং তিনি আরো বলেন, ‘‘হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন না তওবা বন্ধ হয়। আর তওবা বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য তাঁর অস্ত যাওয়ার দিক দিয়ে উদিত হয়। ’’ [আবু দাউদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত]
বেশ কয়েকটি কারণে হিজরত ওয়াজিব হয়, তন্মধ্যেঃ
১.যখন দ্বীনের ওপর ফিৎনার আশংকা থাকেঃ
দ্বীন রক্ষা করে মুশরিকদের থেকে নিরাপদে প্রস্থান করা যখন দ্বীনের ওপর ফিৎনার আশংকা থাকে। আর এটাই হল ‘দারুল কুফর’ থেকে ‘দারুল ইসলাম’ অথবা ‘দারুল আমান’-এ হিজরত করা, যার পক্ষে সম্ভবপর।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘‘সেইসব মুসলিমদের কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই যারা মুশরিকদের ভেতরে অবস্থান করে। ’’ (আবু দাউদ, তিরমিযী)
আতা ইবনে আবি বারাহ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বুখারী (রহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেনঃ আমি উবাইদ ইবনে উমাইর আল লাইছিকে সাথে নিয়ে আয়েশা (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে দেখা করি। এরপর আমরা তাদের হিজরতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি। তখন তিনি বললেনঃ ‘‘আজ আর হিজরত নেই, -মু’মিনগণের ভেতরে যে ব্যক্তির দ্বীনের উপর ফিৎনা আসবে সে যেখানে খুশী আল্লাহর ইবাদত করতে পারে; তবে জিহাদ এবং এর নিয়্যত ব্যতীত । ’’
এখানে সঠিক বক্তব্য হলোঃ এখানে সায়্যিদা আয়েশা (রদিয়াল্লাহু আনহু) যে হিজরতের কথা বলেছেন তা হলো ‘দারুল ইসলাম’ থেকে হিজরত।
কারণ তিনি বলেছেন,‘‘আজ আর হিজরত নেই’’, যখন তিনি ‘দারুল ইসলামে’ ছিলেন। এরপর তিনি হিজরতের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা হলো ফিৎনা থেকে দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য পলায়ন করা।
২. হিজরত আল্লাহর পথে জিহাদের সূচনা স্বরূপঃ
হারিছ আল আশআরী (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীস- রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি। যা আল্লাহ্ আমাকে আদেশ করেছেনঃ আল জামা’আ, শোনা, মানা, হিজরত এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। ’’ (আহমাদ)
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ ‘‘যারা নির্যাতিত হবার পর হিজরত করে, পরে জিহাদ করে এবং ধৈর্য্যধারণ করে; তোমার রব এই সবের পরে, তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
’’ (সূরা নাহল ১৬:১১০)
সুতরাং হিজরতই সর্বশেষ স্তর নয়। বরং এটি জিহাদের একটি সূচনা স্বরূপ। আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘‘হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন পর্যন্ত শত্রুদের সাথে যুদ্ধ চলবে। ’’ [আহমাদ, আব্দুল্লাহ ইবনে সাদী (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত]
এই গ্রন্থের শুরুতেই আমি আলোচনা করেছি যে, ঈসা ইবনে মরিয়াম (আঃ) এসে দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ বলবৎ থাকবে। আর এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ আছে যে এটাই হবে আল্লাহর রাস্তায় সর্বশেষ জিহাদ।
এই হিজরত হবে জিহাদের সূচনা স্বরূপ যা অন্য কোন দেশের জিহাদরত মুসলিম মুজাহিদীনদের সহায়তা করতে পারে অথবা মুসলিমদের জিহাদে প্রস্তুতি নেয়ার নিয়্যতে এবং লোক সমাগমের উদ্দেশ্যে যেন মুসলিমরা তাদের দেশে ফিরতে পারে জিহাদের জন্য তৈরী হয়ে।
অন্য এলাকায় হিজরতের হুকুম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইবনে কুদামাহ (রহিমাহুল্লাহ) “হিজরত সংক্রান্ত অধ্যায়ে বলেনঃ আর এটি হলো ‘দারুল কুফর’ ত্যাগ করে ‘দারুল ইসলামে’ আসা”-
আল্লাহ্ বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই যারা নিজেদের জীবনের প্রতি যুলুম করেছিল, ফেরেশতাগণ তাদের প্রাণ হরণ করতে গিয়ে বলবেঃ তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম। তারা বলবেঃ আল্লাহর দুনিয়া কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তন্মধ্যে হিজরত করতে? অতএব তাদেরই বাসস্থান জাহান্নাম এবং ওটা কত নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান”। (সূরা নিসা ৪:৯৭)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে, “সেইসব মুসলিমদের কারো সাথে আমার সম্পর্ক নেই যারা মুশরিকদের ভেতরে অবস্থান করে”। (আবু দাউদ, তিরমিযী) আর এগুলো ছাড়াও আরো যেসব আয়াত ও হাদীস রয়েছে তা অনেক।
এটি বন্ধ হবে না।
কিছু লোক বলে যে, হিজরত আর নেই কারণ,
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ফাত্হে মাক্কার (মক্কা বিজয়ের) পর আর হিজরত নেই”। এবং তিনি বলেনঃ “জিহাদ ও নিয়্যত ছাড়া অন্য সকল হিজরত বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্ণিত আছে যে, যখন মারওয়ান ইবনে উমাইয়্যাহ (রদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম কবুল করেন, তাকে বলা হয়েছিল, তার জন্য কোন দ্বীন নেই যে হিজরত করে না। সুতরাং তিনি মদীনায় চলে যান।
তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “কিসে তোমাকে এখানে আনলো, হে আবু ওহাব’ সে বলল, “একথা বলা হয়েছে যে তার জন্য কোন দ্বীন নেই যে হিজরত করে না”। তিনি বললেন, “ফিরে যাও আবু ওহাব, মক্কার বিস্তৃত উপত্যকায়, এবং তোমার গৃহেই থাকো, কারণ হিজরত তো শেষ হয়ে গেছে শুধুমাত্র জিহাদ ও নিয়্যত ছাড়া”।
এই পুরোটাই সাঈদ থেকে বর্ণিত।
আর মুআবিয়া (রদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছেঃ আমি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, “হিজরত বন্ধ হবে না যতক্ষণ না সূর্য তার অস্ত যাওয়ার দিক থেকে উদিত হয়”-আবু দাউদের বর্ণিত।
আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “হিজরত বন্ধ হবে না যতদিন জিহাদ থাকবে”।
[সাঈদ অন্যান্যদের থেকে বর্ণিত]।
সমন্বয় সাধনঃ
আর এসকল আয়াত ও হাদীসের সার্বজনীনতা থেকে বোঝা যায় যে,
হিজরতের কারণ সমূহের মতো, সকল সময়েই হিজরত আবশ্যক।
পূর্বের হাদিসটি যেখানে তিনি মক্কা বিজয়ের পরে হিজরত না থাকার কথা বলেছেন যে, বিজিত দেশ থেকে হিজরত নেই।
আর সাফওয়ান ইবনে উমাইয়্যাকে তিনি যে হিজরত শেষ হওয়ার কথা বলেছেন, তা হলো মক্কা থেকে হিজরত, কারণ (সাধারণভাবে) হিজরত হলো কাফিরদের দেশ থেকে বাহির হওয়া। সুতরাং এটি যদি (ইসলাম দ্বারা) বিজিত হয়, তাহলে তা আর কাফিরদের দেশ থাকে না, সুতরাং এটি থেকে হিজরত করার কোন প্রয়োজন নেই।
আর একইভাবে প্রত্যেকটি দেশ যেটি দখল করা হয়েছে, তা থেকে আর কোন হিজরত নেই, বরং তার দিকেই হিজরত করতে হয়।
যখন স্পষ্ট হয়ে গেল কিয়ামত পর্যন্ত হিজরত চলবে তখন জানতে হবে মুহাজিরদের প্রকারভেদ সম্পর্কে। মুহাজির তিন প্রকারেরঃ
প্রথমতঃ যার ওপর হিজরত ওয়াজিব এবং সে এ ব্যাপারে সক্ষম।
যখন সে তার দ্বীন প্রকাশ করতে পারে না, বা যখন সে দ্বীনের হুকুম মানতে পারে না অথবা যখন সে কাফিরদের মধ্যে অবস্থান করে। সুতরাং এই ব্যক্তির ওপর হিজরত ওয়াজিব।
কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের জীবনের প্রতি যুলুম করেছিল, ফেরেশতাগণ তাদের প্রাণ হরণ করতে গিয়ে বলবেঃ তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলবে, আমরা দুনিয়ায় অসহায় ছিলাম। তারা বলবেঃ আল্লাহর দুনিয়া কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তন্মধ্যে হিজরত করতে? অতএব তাদেরই বাসস্থান জাহান্নাম এবং ওটা কত নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থান”। (সূরা নিসা ৪: ৯৭)
আর এটা সত্যিই একটি ভয়াবহ হুমকি, যা হিজরত এর আবশ্যকতা তুলে ধরে। এটা এই কারণেই যে প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তির জন্য ‘দারুল কুফর’ থেকে হিজরত করা অবশ্য করণীয়। আর হিজরত হলো এসব আবশ্যক প্রয়োজনসমূহের একটি, যা এগুলোকে পরিপূর্ণতা দেয়, এবং যা ছাড়া হুকুমসমূহ পালন করা সম্ভব নয়; সুতরাং এ বিষয়টিও ওয়াজিব।
দ্বিতীয়তঃ যার ওপর হিজরত ওয়াজিব নয়।
যে হিজরত করতে সক্ষম নয়- অসুস্থতার কারণে, অথবা সেখানে থাকতে বাধ্য হলে অথবা তার স্ত্রী সন্তানদের বা অনুরূপের (শারীরিক) দুর্বলতার কারণে।
আল্লাহর আয়াতঃ “কিন্তু পুরুষ নারী ও শিশুদের মধ্যে অসহায়গণ ব্যতীত। যারা কোন উপায় করতে পারে না বা কোন পথ প্রাপ্ত হয় না। ফলতঃ তাদেরই আশা আছে যে, আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং আল্লাহ্ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল”।
(সূরা নিসা ৪:৯৮-৯৯)
আর এক্ষেত্রে হিজরতকে উত্তম বা সুপারিশমূলকও বলা যাবে না কারণ, এটি সম্ভব নয়।
এবং তৃতীয়তঃ সেই ব্যক্তি যার জন্য এটি প্রশংসনীয় কিন্তু ওয়াজিব নয়।
ইনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি হিজরত করতে সক্ষম আবার প্রকাশ্যে তার দ্বীন পালনেও সক্ষম। সুতরাং দারুল কুফরে তার বসবাসে ইতি টানা প্রশংসনীয় হবে যাতে সে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সক্ষম হয় এবং মুসলিমদের সংখ্যা বাড়াতে পারে এবং তাদের সাহায্য করতে পারে। সেই সাথে কাফিরদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের কুকর্মের সাক্ষী হওয়া থেকেও রেহাই পায়।
কিন্তু এটি তার ওয়াজিব নয় কারণ সে হিজরত না করেই সেখানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করতে সক্ষম।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চাচা আল আববাস (রদিয়াল্লাহু আনহু) তার ইসলামে থাকাকালীন মক্কায় অবস্থান করেছেন। নু’আইম আন নুহাম যখন হিজরত করতে চান তখন তার কওম বনু আদি তার কাছে এসে বলে, ‘আমাদের সাথে থাকুন, আপনি আপনার দ্বীনের ওপর থাকবেন এবং তাদের থেকে আপনাকে রক্ষা করবো যারা আপনার দ্বীনের ওপর থাকবে না এবং তাদের থেকে আপনাকে রক্ষা করব যারা আপনার ক্ষতি করতে চায়। আমাদের জন্য দায়িত্বশীল থাকুন যেভাবে আপনি (বর্তমানে) আমাদের প্রতি দায়িত্বশীল আছেন’। আর তিনি বনু আদির ইয়াতিম ও বিধবাদের দেখাশোনা করতেন।
সুতরাং তিনি কিছুদিন হিজরত থেকে বিরত থেকে পরবর্তী সময়ে হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বলেনঃ “তোমার কওম তোমার প্রতি তার চেয়ে উত্তম যেমনটি ছিল আমার কওম আমার প্রতি। আমার কওম আমাকে বহিষ্কার করে এবং আমাকে হত্যা করতে চায় এবং তোমার কওম তোমাকে রক্ষা করে এবং (ক্ষতি থেকে) বাচায়। তখন তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ’, আপনার কওম তো আপনাকে আল্লাহর আনুগত্য ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের দিকে বহিষ্কার করেছে। আর আমার কওম আমাকে হিজরত ও আল্লাহর আনুগত্য থেকে আটকে রেখেছে।
অথবা এর কাছাকাছি কোন বক্তব্য”।
উৎসঃ (আল মুগনি ওয়াশ শারহ্ আল কাবীর)
সৌজন্যেঃ বাব-উল-ইসলাম
সূত্র
আমার আগের পোস্ট
সুনান আন নাসাঈ বাংলা ও ইংরেজী ডাউনলোড ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।