এবার তোরা মানুষ হবি facebook.com/tabassumDorshon
মেয়েকে নিয়ে কয়েকদিন আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। ওই দিন ক্লাশ ছিল না। অন্য একটা কাজে যেতে হয়েছিল। ক্লাশ না থাকলে সুযোগ পেলেই মেয়েকে নিয়ে ইউনিতে চলে আসি। এর একটা কারণও আছে।
ছোটবেলা থেকে ওর মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন ঢুকিয়ে দেয়া। এই স্বপ্ন আলোকিত মানুষ হবার স্বপ্ন।
মনে পড়ে, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে একবার ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যাই। শুনলাম দূর সম্পর্কের এক আত্নীয় শীঘ্রই ঢাকায় যাবে কি একটা কাজে। বয়সে বড় হলেও উনি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো।
তাকে বললাম, ঢাকায় গেলে আমার হলে বেড়াতে আসবেন। সে যেন আতকে উঠে বলে, বাবারে! ওখানে যাব গুলী খেয়ে মরতে!
দৃশ্যপট এক: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়
হলের সামনের ছোট ছোট অনেকগুলো টং দোকান। সকাল বেলা। ঘুম থেকে উঠে সবাই নাস্তা খেতে এসেছে। বিশাল লাইন।
এমন সময় ঢুলু ঢুলু চোখে, উস্কোখুস্কো চুলে একজন এসেই হুংকার দিয়ে বলে, মামা নাস্তা দে। সবাই চুপ। কিসের লাইন। আগে বড় ভাইর নাস্তা। এক জনের দাপটে সবাই চুপসে আছে।
নাস্তা শেষে মামা লিখে রাখ বলে আজীবন বাকীর খাতায় রুটি ভাজির দামটা লিখে প্রস্থান।
দৃশ্যপট দুই: তাহাদের বিশ্ববিদ্যালয়
কফি শপ। ক্লাশ শুরু হয় হয়। লম্বা লাইন। সিরিয়াল মতো যে যার কফির কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছে।
ক্লাশে যাবার আগে কফির গরম কাপে একটু একটু চুমুক দিতে দিতে লেকচার শুনবে। আমিও আছি সেই লাইনে। সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছি। উহু! কারো ভিতরে কোন উত্তেজনা নেই। দেরী দেখে উদ্বেগ আছে, ক্লাশ শুরু হবে সেই জন্য।
কেউ চিতকার করে বলছে না, কই শালা! তাড়াতাড়ি কর! মাইরা হাত গুড়ো কইরা দিমু।
এখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শুধু ছাত্র শিক্ষকের নয়। যারা এখানে কাজ করছে, সবার। সবাই যে যার অবস্থানে সমান ভাবে সম্নানিত। সেই ক্লিনার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
সবাই সমান। সবাই একই টয়লেটে যায়। একইভাবে লাইনে দাড়িয়ে থাকে।
এবং কিছু আলোচনা...
দুই সপ্তাহ আগে আমার এক পরিচিতা এ্যাডিলেইডে এসেছিলেন পুত্রের সমাবর্তন অনুষ্টানে যোগ দিতে। তার কাছ থেকে সমাবর্তনের গল্প শুনলাম।
অভাবনীয় গর্বিত পরিবেশ! কাকতলীয়ভাবে সে সময়ে দেশের পত্রিকায় একটা খবর পড়লাম। সেটাও সমাবর্তনের। কিন্তু গেৌরবের নয়, লজ্জার। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা একটা মগ এবং একই রকম আরো দুটো কি জিনিস পাবার লোভ সামলাতে না পেরে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সব লুটে নিয়ে যায়। ভিসি বলেছেন, তোমাদের কি এই শিক্ষা দিয়েছি।
বেয়াদবি নিবেন না, ভিসি মহোদয়। এর চেয়ে বেশী কি শিক্ষা আমরা পেয়েছি আপনাদের কাছ থেকে? আপনি যোগ্য হলেও আপনার যে নিয়োগ, সেটাও রাজনৈতিক বিবেচনায়। এইতো কয়েক সপ্তাহ আগে খবরে পড়লাম জাবিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য দেয়াল টপকিয়ে ভিসির বাসায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে। মাঝে মাঝেই খবরে দেখি শিক্ষকদের হাতাহাতি। কি অসম্ভব দুর্লভ ছবি সেগুলো।
পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ আছে! দুর্নিতির কথা নাই বা বললাম। আপনাদের কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছে ছাত্ররা সেটাই চর্চা করে দেখিয়েছে মাত্র। গোস্যা করে লাভ কি!
কিন্তু এই আচরনের কারণ কি? বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাথে এই পরিবেশগত পার্থক্যটা কেন? আমার মনে হয় ক্ষমতার ধারণা একটা অন্যতম কারণ। আমাদের দেশে টিকে থাকতে হলে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতাবান হতে হয়। কেননা ব্যক্তিকে মানুষ হিসেবে ক্ষমতায়িত করা কিংবা নিরাপত্তা দেবার দায়িত্ব যাদের সেই প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্র সবার প্রতি সুষম আচরণ করতে ব্যর্থ।
তাই রাজনীতির মাধ্যমে হোক, আত্নীয়তার সম্পর্ক ব্যবহার করে হোক, কিংবা টাকার জোরে হোক, সবাই একটা অনিয়মতান্ত্রিক, বেআইনী, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরেও নিজস্ব একটা ক্ষমতার বলয় তৈরী করতে চায় বেচে থাকার তাগিদে। বিশ্ববিদ্যালয় হলো তার একটা মোক্ষম জায়গা।
উন্নত বিশ্বের মানুষের অস্তিত্ব বা নিরাপত্তার সংকট থেকে নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো বা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে না। রাষ্ট্রই নাগরিককে সেগুলো নিশ্চিত করে। তাই এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষমতার কনসেপ্ট ভিন্ন।
তাদের ক্ষমতায়িত হবার একমাত্র এবং শুধুমাত্র ধ্যান জ্ঞান হচ্ছে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়টার সবোর্চ্চ ব্যবহার করে, অধিক মাত্রায় জ্ঞান অর্জন করে জীবন যুদ্ধে নিজেকে যোগ্য করা যায়। যেহেতু এখানে চাকরী পাবার ক্ষেত্রে 'মামা ধরা' তেমন কাজে আসে না, তাই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে নিজের যুদ্ধটা নিজেকেই করতে হয়। তাছাড়া এখানে জীবনকে উপভোগ করার জন্য উপযোগ ঘটানোরও পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। ছাত্ররা ছাত্র অবস্থাতেই ইচ্ছে করলে পার্ট টাইম কাজ করে যথেষ্ট কামাতে পারে। সেখানে আমাদের দেশের বিশাল ছাত্র সমাজ কম পয়সায় পড়ে, কম পয়সায় হলে থেকে বাকী সময়টা রাজনীতি না করে কিভাবে কাটাবে? সম্ভবত: তাই আমাদের দেশের ছাত্ররা সংঘবদ্ধ হয় ক্ষমতা দখলের জন্য (বর্তমানের ছাত্র রাজনীতি দেখে এর চেয়ে ভাল কোন মন্তব্য করা যাচ্ছে না)।
অন্যদিকে, এরা সংঘবদ্ধ হয় জ্ঞান অর্জনের জন্য।
একটা সময় আমাদের এ অঞ্চলে ভন্ড পীরদের ব্যাপক দাপট ছিল। এরা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন জিনিস বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে পবিত্রতার মিথ তৈরী করে সেগুলোকে সমালোচনার উর্ধ্বে রেখে নিজেদের অপকর্মগুলোকে নির্বিঘ্ন করতো। এখন সেই সকল ভন্ড পীরদের দাপট অনেকাংশে কমে গেলেও বেড়েছে ভন্ড সুশীল, ভন্ড দেশ প্রেমিকের সংখ্যা। এরাও ঠিক একই কায়দায় কোন কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে 'ঐতিহ্যের মিথ' তৈরী করে আপন স্বার্থকে কায়দা করে বাগিয়ে নিচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতি ঠিক সে রকমই এক ঐতিহ্যের শেকড়ে গাথা হয়ে আছে। এটাকে এমনই পবিত্রতার মোড়কে আটকানো যে, ধরা যাবে না, ছোয়া যাবে না। কেউ সমালোচনা করলেই চারিদিকে 'গেল গেল' রব! তারপরেও সত্যটা কাউকে না কাউকে বলতেই হবে। ইজ্জত বাচাতে প্যান্ট ভিজানোর মানে হয় না। কি বুঝা গেল না কথাটা?
একবার টগবগে এক তরুণ গিয়েছে কন্যা দেখতে।
ছেলেটিকে অল্প বয়সেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু কন্যা দেখতে গিয়ে ডায়াবেটিসের কথা তো আর বলা যায় না। কথাটি গোপন রাখার কারণে না বলা সত্ত্বেও তাকে গোটা কয়েক মিষ্টি খেতে হোল। আর যায় কোথায়! একদম জায়গায় বসে প্যান্ট ভিজিয়ে দিল। এই লজ্জার চেয়ে ডায়াবেটিসের কথা বলে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকাটা কি ভাল ছিল না? এখনতো বিয়েও হোল না, সাথে প্যান্ট ভিজানোর লজ্জা!
ছাত্র রাজনীতি এক সময় আমাদের বিভিন্ন আন্দোলনের সাথী ছিল ভাল কথা।
কিন্তু স্বাধীন দেশে এখন কি সেইভাবে জাতীয় রাজনীতি নির্ভর ছাত্র রাজনীতির কোন প্রয়োজন আছে? বিভিন্ন কারণে লাইনচ্যুত ছাত্র রাজনীতি দ্বারা জাতি কিভাবে, কতোটুকু উপকৃত হচ্ছে? ছাত্র রাজনীতির নামে যে হানাহানি, সন্ত্রাস ঘটে চলেছে সেটা বিশ্বের যে কারো কাছে শুধু অবিশ্বাস্য নয় নিন্দনীয়।
ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা রাজনীতিবিদ কিংবা তাদের তাবেদাররা ছাড়া অন্য কেউ বলছে বলে সন্দেহ। সারা জীবন কষ্ট করে যে বাবা, যে মা নিজ সন্তানকে মানুষ করাতে ইউনিতে পাঠালো সে বা তারা কি চায় তাদের সন্তান রাজনীতি করুক? অথচ যে রাজনীতিবিদ কিংবা তাদের দোসরের ছাত্র রাজনীতির পক্ষে সাফাই গাইছে, খোজ নিয়ে কেউ কি দেখেছে তাদের সন্তানেরা কি করে? দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, তারা কেউ রাজনীতি করে না। বরং দেশের টাকা বিদেশে খাটিয়ে নিজেরা বিদ্যান হচ্ছে। এরাই একদিন শিক্ষিত হয়ে অর্ধ শিক্ষিত চুংগা ফুকা ছাত্র রাজনীতি করা পাতি নেতাদের নেতা সেজে ছড়ি ঘুরাবে।
আমি কখনোই ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে ছিলাম না, এখনো নই। কিন্তু জাতীয় রাজনীতি নির্ভর, বড় দলের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে। ছাত্ররা রাজনীতি করবে নিজেদের বলয়ে, শিক্ষাকে আরো যুগোপযোগী এবং গুণগত মানের উতকর্ষতার জন্য। এ দল, ও দলকে ক্ষমতায় আনার হাতিয়ার হিসেবে নয়। দেশকে নেতৃত্ব দিতে হলে ছাত্র অবস্থাতেই জাতীয় রাজনীতিতে জড়াতে হয় না।
রাষ্ট্র চালাতে হলে একজনকে অর্থনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা এবং আরো অনেক জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড ছাত্র অবস্থায় কখনো লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় আনার জন্য রাস্তায় নেমে গাড়ী পোড়ায়নি। জুলিয়া গিলার্ড হতে হলে ছাত্র অবস্থায় লেখাপড়া শিকেয় তুলে শ্লোগান দিতে হয় না। ছাত্র অবস্থায় জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়ে নয় বরং সময়ের কাজ সময়ে লেখাপড়া করে নিজেকে দেশ চালানোর যোগ্য করে তুলতে হয়।
bangladesh first
- ইমেইলঃ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।