আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাধার আবার বয়স কী? গাধা দশ বছরেও গাধা, আশি বছরেও গাধা

যেথায় পড়শী বসত করে, আমি একদিন ও না দেখিলাম তারে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। শিক্ষাবিদ। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রধান। সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতির অন্যতম সংগঠক।

সৃজনশীল প্রশ্ন-পদ্ধতি নিয়ে বলেছেন দরকারি কথা। ২ আমাদের ছাত্রছাত্রীরা আগামী পরীক্ষায় কোন প্রশ্নগুলো পড়বে তা ঠিক করার জন্য ফাইনাল পরীক্ষার আগে প্রথমে পাঠ্যবইগুলো সামনে নিয়ে বসে। বই হাতে নিয়ে তারা প্রথমেই ধরে নেয়, এ প্রশ্নগুলো ছোট, এগুলো আসবে না, ওগুলো আনইম্পর্টেন্ট কখনো আসেনি, আসবে না। এভাবে আসে না আসবে না করে প্রথমেই বইয়ের ষাট শতাংশ বাদ দিয়ে দেয়। তারপর বসে যায় গত বছরের প্রশ্ন নিয়ে।

রহস্যময় কারণে গত বছরের প্রশ্নও কখনো পরীক্ষায় আসে না। ফলে সেগুলোও বাদ। এভাবে বাদ দিতে দিতে শেষ অবধি এসে ঠেকে বারো-তেরোটা প্রশ্নে। এমন যখন অবস্থা তখন শিক্ষকদের মধ্য থেকে এক-আধজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব হয়। তিনি বলেন, অযথা এত পড়বি কেন রে গাধারা! তেরোটা প্রশ্ন মুখস্থ কি চাট্টিখানি কথা! এই নে, নয়টা প্রশ্ন দাগিয়ে দিচ্ছি, এগুলো পড়।

পরীক্ষায় ছয়টা কমন পাবিই পাবি। স্যারের মুখে রহস্যময় হাসি। ছাত্ররা রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছেন কী করে স্যার? তবে কি শিক্ষাবোর্ডের সঙ্গে স্যারের কোনো প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ...? স্যার তাঁর হাসি আরও রহস্যময় করে বলেন, ‘কিছু খবরাখবর না রাখলে কি চলে রে!’ তাহলে দাঁড়ালটা কী? একটা বইয়ের মধ্যে যদি কমসে কম একশটা প্রশ্ন থাকে তবে তার মধ্য থেকে মাত্র দশটা প্রশ্ন পড়ে আমরা একেকটা পরীক্ষায় পাস করছি। তাহলে পাঠ্যবইয়ের শতকরা কত ভাগ পড়লাম আমরা? মাত্র দশ ভাগ।

অর্থাৎ যদি ১০০০ নম্বরের কোনো পরীক্ষায় আমরা পাস করে থাকি তাহলে আসলে পাস করেছি ১০০ নম্বরের মধ্যে। বাকি নব্বই ভাগ আমাদের কাছে পুরো অজ্ঞাত থেকে যাচ্ছে। যেসব অনার্স-এমএ-রা এই মুহূর্তে আছি তারা ওই দশ ভাগের এক ভাগ পড়ে পাস করা অনার্স এমএ-রাই। আরও কথা আছে। এমন বহু ছাত্র আছে, যারা অনার্স-এমএ পাস করে গেছে কিন্তু পাঠ্যবই হাতেও ছোঁয়নি।

শুধু নোট মুখস্থ করে পাস করেছে। আগেই বলেছি, এই মুখস্থবিদ্যা আমাদের ছাত্রদের এতটাই দৈহিক ও মানসিক কষ্ট দেয়, এমনই নিগ্রহ আর অত্যাচার করে যে তাদের জ্ঞানের উদ্দীপনা আর আনন্দকেই জীবনের জন্য ধ্বংস করে ফেলে। ছাত্রদের কাছে বিদ্যা হয়ে দাঁড়ায় এক মূর্তিমান বিভীষিকার নাম। এই পদ্ধতিতে আমরা শুধু মুখস্থ করছি চিন্তা করছি না, পড়ছি কিন্তু স্বপ্ন দেখছি না, কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে জীবন ও পৃথিবীর অন্তর্জগতে প্রবেশ করছি না। আমাদের অবস্থা দাঁড়াচ্ছে সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই কথাটার মতো: ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।

’ এর ফলটা হচ্ছে কী? আমাদের চিন্তাশক্তি সক্রিয় হচ্ছে না, বুদ্ধি বিকশিত হচ্ছে না, মননশীলতায় সম্পন্নতা আসছে না। ফলে আমরা ক্লাস সিক্সে যা ছিলাম এমএ পাস করেও তাই থেকে যাচ্ছি। ষাটের দশকে ঢাকার বিজ্ঞান কলেজে একজন কেরানি ছিলেন, খুবই বুদ্ধিমান মানুষ। আমাকে একদিন বলেছিলেন, স্যার, গাধার আবার বয়স কী? গাধা দশ বছরেও গাধা, আশি বছরেও গাধা। এই মুখস্থবিদ্যা আমাদের মেধার স্ফুরণ ঘটায় না, শুধু জ্ঞানের ওই ভারবাহী জীবে পরিণত করে, যার জীবনে সময় গড়ায় কিন্তু বয়স বাড়ে না।

আমরা যারা চিন্তাই করলাম না, তাদের তো বয়স হলো না। এ জন্য আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষকে দেখা যায় বয়স হয়ে গেছে অনেক কিন্তু কথা বলছে শিশুদের মতো। আমাদের জাতির এই চির-নাবালকত্ব যে কতটা দুঃখজনক তার একটা উদাহরণ দিই। বিশ্বকাপে ব্রাজিল জিতবে না আর্জেন্টিনা জিতবে তাই নিয়ে দিন কয় আগে আমাদের এক সুদূর গ্রামে দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে ৫০ জন আহত হয়েছে। চিন্তা করে দেখুন ব্যাপারটা।

আমাদের দেশ জিতবে না অন্য কোনো দেশ জিতবে, এ নিয়েও যদি খুনোখুনি হতো তবু না-হয় মানা যেত। কিন্তু কোথায় আর্জেন্টিনা, কোথায় ব্রাজিল, দেশগুলোর কোনটা কোথায়; তাও হয়তো তাদের অনেকে জানে না। অথচ তাই নিয়ে খুনোখুনি করে মরছে আমাদের দেশের লোক। চিন্তা, বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞানের কী বেদনাদায়ক দেউলেপনা! এই চিন্তাশক্তির অভাবে আমাদের বাস্তবযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকে আছে। রাষ্ট্র কিছুতেই সংহত হচ্ছে না, সর্বগ্রাসী নৈরাজ্য জল্লাদের মতো আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে।

জাতির বিশালতা আর বিপুল ওজন নিয়ে আমরা কেবলই নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। এ থেকে বাঁচতে হলে নতুন প্রজন্মকে চেতনার অন্ধত্ব, পরজীবিতার শৃঙ্খল আর প্রশ্নহীনতার জাড্য থেকে মুক্তি দিয়ে নিজের পায়ের ওপর আমাদের দাঁড় করাতে হবে। তাদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা আর চিন্তার স্বাধীনতাকে স্ফুরিত করে তুলতে হবে। পৃথিবীর অগ্রসর দেশগুলোতে কিন্তু পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ আলাদা। ওসব দেশে মানুষকে এক্কেবারে ছোট্ট বয়স থেকে ভাবতে আর কল্পনা করতে শেখানো হয়।

ওখানকার শিক্ষকেরা ওদের পড়াশোনার প্রক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা, বুদ্ধি আর কল্পনাশক্তির প্রয়োগকে সারাক্ষণ উৎসাহিত করেন। ফলে তারা সক্রিয় সজীব আর চিন্তাদীপ্র হয়ে ওঠে। আমাদের এখানে কোনো কিছু নিয়ে স্যারকে প্রশ্ন করলে স্যার চটে যান। এসব প্রশ্ন যেন আর না করা হয়, তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেন। আমাদের কলেজজীবনে একজন স্যার ছিলেন, তাঁকে প্রশ্ন করলেই তিনি জিজ্ঞেস করতেন বাড়ি কোথায়? যদি উত্তর হতো, ‘নোয়াখালী’ সঙ্গে সঙ্গে স্যার বলে উঠতেন, ‘অ, এই জন্যই।

’ এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে তিনি কথাটা বলতেন যে সারা ক্লাস ছেলেটাকে নিয়ে হো হো করে হাসতে থাকত। নোয়াখালী না বলে রাজশাহী বললেও তিনি একই কাজ করতেন। এখন প্রশ্ন, এমন দমনমূলক পদ্ধতি অবলম্বনের কারণ কী? কারণ একটাই। প্রশ্নের উত্তরটা স্যারের জানা নেই। একদিকে মুখস্থসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, তার ওপর এমন জবরদস্তিমূলক শিক্ষকদের নিগ্রহ—সবকিছুর ঘা খেয়ে আমাদের বুদ্ধি আর চিন্তার চর্চা একসময় ভোঁতা হয়ে যায়।

আমরা হয়ে উঠি মানব-রোবট—যেটুকু আদিষ্ট হই, তার বাইরে কিছু বুঝতে বা ভাবতে পারি না। কেবল স্যাররা কেন, সারা দেশে অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ আজ এমনই নিরেট। কারণ একটাই। তারা চিন্তা, বুদ্ধি বা কল্পনাশক্তির মুক্তচর্চার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠেনি, নিজেকে বা বাইরের পৃথিবীকে প্রশ্ন করে জিজ্ঞেস করে, চিরে চিরে বিশ্লেষণ করে জগৎ ও জীবনকে আবিষ্কার করেনি। আমাদের স্যাররা নিজেরা চিন্তা করেননি বলে চিন্তার রাজ্যে ছাত্রকে ডাক দিতে পারেন না, উল্টো প্রশ্ন করলে ছাত্রের ওপর চটে যান।

অথচ ভালো শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক তাঁর চিন্তা আর কল্পনার আনন্দজগতে ছাত্রকে সঙ্গী করে নেন। শিক্ষা সেখানে অংশগ্রহণমূলক। ছাত্র আর শিক্ষকের যুগলবন্দীতে প্রাণবন্ত, মুখর। শিক্ষক সেখানে কথা বলেন না। ছাত্রকে চিন্তা করতে, কথা বলতে অনুপ্রাণিত করেন।

‘বিল, এ সম্পর্কে তোমার মতামত কী, বা এ নিয়ে তুমি কী ভাবছ, বলো তো!’ এ হচ্ছে তাঁদের প্রশ্ন করার ঢং। এতটুকু শিশুকেও সেখানে সম্মান দিয়ে কথা বলা হয়। এতে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। নিজেদের চিন্তাভাবনার ব্যাপারে তারা সাহসী হয়ে ওঠে। আমাদের এখানে শিক্ষক ছাত্রছাত্রীকে সম্মান করবেন কী, ছাত্রছাত্রীদের ন্যূনতম অস্তিত্বকেই যেন আক্রমণ করে বসেন।

‘তুই কে? তুই কেন? কী চাস তুই? চুপ কর। থাম! যা, সর!’ এই হলো যেন আমাদের মনোভঙ্গি। দেশ ভ্রমণে গিয়ে, সারা পৃথিবীর সমস্ত এয়ারপোর্ট দিয়ে আপনি রাজার মতো চলে আসবেন, কোনো অসুবিধা হবে না, কিন্তু যেই ঢাকা এয়ারপোর্টে ঢুকবেন সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন শত চোখে শত সন্দেহভরা প্রশ্ন: কে যায় রে, কী করে রে, কী নেয় রে, পালায় নাকি রে, ধররে, বাঁধরে। যেন একটা চোর ঢুকেছে। সবখানে এমনি নেতিবাচক আক্রমণাত্মক হিংস্র তীক্ষ আক্রোশ।

সবাই যেন সবাইকে এখানে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়। শিক্ষকেরা আমাদের দেশে যোগ্যতা দিয়ে ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখেন না, রাখেন জবরদস্তি দিয়ে। আমাদের দেশে ছাত্র পেটানো রদ করে আইন হয়েছে, তবু আজ অবধি খুব সামান্যই তা বন্ধ করা গেছে। এই তো কালকেও পত্রিকায় দেখলাম, ক্লাস টেনের একটা মেয়েকে একজন শিক্ষক সবার সামনে এমন গরু-ছাগলের মতো পিটিয়েছেন যে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেছে। শিক্ষককে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘ওর কিছুই হয়নি।

ঢং করছে। ’ চিন্তাহীন মূঢ় মানুষের তো এমন জান্তব হওয়ারই কথা। আমাদের প্রশ্নহীন জিজ্ঞাসাহীন মনুষ্যত্বহীন শিক্ষাব্যবস্থা আসলে আমাদের প্রায় কোনো বিকাশই ঘটায় না, সুকুমার বা মানবিক বিকাশ তো দূরের কথা। এ আমাদের শেখায় শুধু অন্ধ অনুকরণবৃত্তি পরজীবিত্ব আর রূঢ় পাশবতা। ষাটের দশকে, প্রায় ৪০-৪২ বছর আগে, আমি একজন বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীকে বলেছিলাম, ‘আপনারা তো কমিউনিস্ট।

কেউ চীনপন্থী, কেউ রুশপন্থী, কেউ ভারতপন্থী; এমনি আরও নানা রকম। কিন্তু আপনাদের মধ্যে বাংলাদেশপন্থী কমিউনিস্ট কেন নেই। ’ তিনি বলেছিলেন, ওটা কখনো হবে না। বললাম, কেন? তিনি জবাব দিলেন, ‘গোলমালটার মূলে রয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। সবকিছুই আমরা জানি মুখস্থের মাধ্যমে।

আমি মুখস্থ করে ফেলেছি চায়নিজ পদ্ধতি, ব্যস, আমি চায়নিজ কমিউনিস্ট। মুখস্থ করেছি রুশপদ্ধতি, আমি রুশপন্থী কমিউনিস্ট। মুখস্থ করেছি ইন্ডিয়ান পদ্ধতি, আমি ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ-পদ্ধতির ওপর তো কোনো বই নেই, আমি মুখস্থ করব কীভাবে? তাই দেশে বাংলাদেশপন্থী কমিউনিস্ট নেই। ’ এভাবে মুখস্থবিদ্যা আমাদের গোটা জাতিকে একটা চির-জড়ত্বের মধ্যে রেখে দিয়েছে।

# আগামীকাল: পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পাওয়ার যুগ এখন শেষ। View this link আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের এই লেখাটা কপি না করে পারলাম না। কপি করার উদ্দেশ্য, প্রত্যেকেরই এই লেখাটা পড়া অবশ্য কর্তব্য। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।