মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... সম্ভবত ক্লাশ ফাইভে পড়ি তখন।
গ্রামে বাড়ীর পাশেই যে স্কুলটাতে পড়ি, তাহাতে সৌভাগ্যবশত মাথার উপরে টিনের চাল থাকিলেও চারিদিকে দেয়ালের কোন বালাই ছিলোনা। নিখাদ কাঁচা মাটির মেঝেতে বর্ষাকালে ব্যাঙ আর ইয়ামাহা সাইজের কেঁচো দেখিয়া প্রায়শই তাহাদেরকে বড়শিতে গাঁথিয়া মৎস্য শিকার করিবার চিন্তায় মশগুল থাকিতাম। তবে পৃষ্ঠদেশে ঝপাং বেতের শব্দে সেই দীবা স্বপ্নসমূহ ভাঙ্গিয়া যাইতে বিলম্ব হইতনা।
বর্ষাকালে পানি যখন আরো খানিকটা বাড়িয়া যাইত, তখন স্কুলের ভিতরে মাশাল্লাহ হাঁটু পানি...! কলাগাছের ভেলা বানাইয়া স্কুলে যাইবার সেকি মহোৎসব!! এবং স্কুলের শিক্ষা দীক্ষার অবস্থাও ছিল তথৈবচ।
শিক্ষকদের বেশীরভাগই ছিলেন আন্ডার ম্যাট্রিক। যাহাদের অনেকেই ইংরেজি বানান উচ্চারণের ভয়ে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখিয়া দিতেন। উল্লেখ্য, গ্রামের অবস্থাপন্ন যেইসকল গৃহস্থরা মিলিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, তাহাদের লেখাপড়া জানা সন্তানেরাই অগ্রাধীকার ভিত্তিতে সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হইয়াছিলেন...
তো একবার স্কুল পরিদর্শনে আসিলেন এ.টি.ও (সহকারী থানা অফিসার, সম্ভবত) সাহেব। আগের দিন-ই আমাদের পরিপাটি করিয়া সাজিয়া আসিতে বলা হইয়াছে। পূর্বের ঈদে পাওয়া নতুন কোর্তাখানি ফুলতোলা ট্র্যাঙ্কের সুগভীর কোন হইতে ন্যাপথলিনের সুগন্ধি সহিত বাহির করিয়া, ভাঁজ ভাঙ্গিয়া, গায়ে চাপাইয়া, স্কুলে আসিয়া হাজির হইলাম।
যথাসময়ে ক্লাশে আসিয়া হাজির হইলেন মহামান্য এ.টি.ও সাহেব। ভয়ে আমাদের সকলেরই আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হইবার দশা। গম্ভীর হইয়া তিনি চৌদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন। চকিতে লক্ষ্য করিলাম, আমাদিগের হইতে আমাদিগের শিক্ষকদের অবস্থাই অধিকতর শোচনীয়। দরোজার পাশে দেয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহারা পরস্পরকে পরস্পরের শরীরে আড়াল করিতে শশব্যাস্ত।
যাহাই হউক, কাশিয়া গলা পরিস্কার করিয়া মহামান্য এ.টি.ও সাহেব নানাবিধ প্রশ্ন করিতে লাগিলেন। ছেলেপুলেদের পারফর্মেন্স লেটার মার্কস প্রাপ্তির কাছাকাছি রকমের খারাপ। কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা থাকিলেও, ভয়ে তাহারা সকলি তালগোল পাকাইয়া ফেলিতে লাগিল। এবং মহামান্য এ.টি.ও সাহেব তখন শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করিতেছেন যে-'তা আলমগীর সাহেব, এই ছেলেটাতো দেখি বাংলাদেশের পতাকার মাপই জানেনা, সামনেতো ১৬ই ডিসেম্বর। এইটা না জানলেতো দর্জির দোকানে গিয়া পতাকার মাপ ভুলভাল দিয়াসবে।
তখন পরবেনতো বিরাট ঝামেলায়। মাপটা একটু বলে দেনতো ওরে। '
আলমগীর স্যার যথারীতি ঘামিয়া, কাশিয়া, কাপিয়া একাকার। এবং মহামান্য এ.টি.ও সাহেব তাঁহার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই বাদ-বাকী ছাত্রের দিকে মনোনিবেশ করিলেন। অবশেষে তিনি লিটনের দিকে দৃষ্টি স্থির করিলেন।
পরিপাটি করিয়া আঁচড়ানো চুল, সুন্দর শার্ট, হাতে প্ল্যাস্টিকের কালো বেল্টের ক্যাসিও ঘড়ি। আসলে লিটনরা ঢাকায় থাকে। পড়াশোনায় ভালো। সেইসময়ে একটা জিনিস খুব দেখা যাইত- 'শহুরে ভালো ছাত্রদের ক্লাশ ফাইভ ও এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়াইবার জন্য চতুর অভিভাবকেরা তাহাদের গ্রামে লইয়া আসিত। এবং যথারীতি তাহারা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি বগলদাবা করিয়া শহরে চলিয়া যাইত।
আহা!
তো যাহাই হোউক, সেই স্কুলের 'গোবরে পদ্মফুল' লিটনকে দেখিয়া মহামান্য এ.টি.ও সাহেবের চক্ষু চমকাইয়া উঠিল। তিনি কাছে গিয়া সুমিষ্ট স্বরে কহিলেন, 'বলতো বাবা, পানি কয় অবস্থায় থাকতে পারে?' লিটন সটান দাঁড়াইয়া কহিল-'পানি তিন অবস্থায় থাকিতে পারে, তরল কঠিন এবং বায়বীয়। ' মহামান্য এ.টি.ও সাহেব অকস্মাৎ থমকাইয়া গেলেন। তিনি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার মুখ গম্ভীর হইয়া রহিল। তিনি হঠাৎ বাংলা কাম বিজ্ঞান শিক্ষক মোজাম্মেল স্যারের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, এই ছেলে কোথা হইতে আসিয়াছে? এ কি এই স্কুলের ছাত্র? এ তো দেখি আমার মাথা আউলাইয়া ফেলিল!'
মোজাম্মেল স্যার ছিলেন শিক্ষদের মধ্যে কিঞ্চিৎ বেশী জানাশোনাওয়ালা লোক।
তিনি তাহার প্রতিভা প্রদর্শনের এহেন সুযোগ পাইয়া নিজেকে আর স্থির রাখিতে পারিলেন না। ঝড়ের বেগে আসিয়া লিটনের কান ধরিয়া চিৎকার করিয়া বলিতে লাগিলেন-'রে গাধার বাচ্চা গাধা, টাউনে থাকিয়া জীবনে কোনোদিন পানিও দেখো নাই, না!! পানি কয় অবস্থায় থাকে এই অতি তুচ্ছ জিনিসও জানোনা, অ্যা? ওই দেখ্ গাধার গাধা, বাইরে বিলের পানির দিকে তাকাই দেখ্। পানি কয় অবস্থায় আছে। দেখছস? পানি থাকে দুই অবস্থায়। যখন ঢেউ থাকেনা তখন হইলো সমান-সমান অবস্থা, মানে সমতল অবস্থা... আর ঢেউ হইলে উঁচানিচা হইয়া যায়- অইটারে বলে অসমতল অবস্থা! বুজ্ঝস ঢাকাইয়া গাধা!'
মহামান্য এ.টি.ও সাহেব দৌড়াইয়া আসিলেন।
মোজাম্মেল স্যারের হাত হইতে লিটনকে ছাড়াইয়া নিয়া কহিলেন- 'আপনার প্রতিভায় আমি মুগ্ধ! বাদ দেন, চলেন, চলেন। আজকে আর কিছু দরকার নাই...
সিরিয়ালে লিটনের পড়েই ছিলাম আমি... আশু প্রশ্নের ভয়ে কলিজা ধড়ফড় করিয়া লাফাইতেছিল। মোজাম্মেল স্যারের এহেন প্রতিভা আর বীরত্বে মুগ্ধ হইয়া আমার ধরফরানিরত কলিজা পায়ের আঙ্গুল আই মিন 'টো' পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া গেলো। আহা, এমন স্যার যদি প্রত্যেক ঘরে ঘরে থাকিত!!
উল্লেখ্য, কিছুকাল পরে, আমাদের টার্ম পরীক্ষায় উক্ত প্রশ্নটি আসিলো। এবং লিটন ব্যাতিত আমরা সকলেই উহার উত্তর হিসেবে একযোগে লিখিয়াছিলাম- পানি দুই অবস্থায় থাকিতে পারে-
১।
বাতাস বা ঢেউ না হইলে সমতল অবস্থায়
২। বাতাস বা ঢেউ হইলে অসমতল অবস্থায়
পরিশিস্টঃ লিটন নামক 'শহুরে গাধা' ছেলেটি ব্যাতিত আমরা সকলেই উক্ত প্রশ্নের উত্তরের জন্য পূর্ণ নম্বর পাইয়াছিলাম। এবং লিটনের খাতায় উক্ত প্রশ্নের উত্তরের নিচে লাল কালিতে মোজাম্মেল স্যার বড় বড় হরফে লিখিয়া দিয়াছিলেন- "গাধার গাধা- ঢাকাইয়া গাধা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।