আসেন দুর্নীতি করি। আর এই দুনিয়াটাকেই খুচাই! শুরু টা হয়েছিল মার্চ মাসেই। ইউরোপে স্যোশাল সাইন্সে পড়ুয়াদের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়েই আলোচনার শুরু। একটা সম্পর্ক তার সাথে একটা পরিবারের লিনিয়েজ প্রতিষ্ঠার বীজও সেদিন ইউরোপের ভূত-ভবিষ্যতের সাথে যুক্ত হল! যারা সেটা করলো সেই দুজন (আমি আর আমার লেইজি বোন্স) ছাড়া পুরো জগত সংসার ই জানলো সে কথা। কথার গাড়ি চলে।
সুইডেনে যখন মাত্র রাত শুরু তখন বাংলাদেশে রাতের মাঝামাঝি সময়। এখানে বসে আমি আর ওখানে সে। রাত গড়িয়ে সকাল হয় আমার, ওর রাত মধ্যরাতে পৌছায়। হাবিজাবি সব কথা চলতেই থাকে। কেন রোজ রাতে অপেক্ষা করতাম তার জবাব নেই।
কেন কোন কোন দিন না থাকলে সে অফলাইন মেসেজ ছেড়ে যেত তারও সন্তোষজনক কোন উত্তর নেই! দুর্ঘটনা আমার মধ্যে আগেই ঘটে গিয়েছিল। আমি বলিনি কিছু। কিন্তু বেপোরোয়া ছেলেটার মধ্যেও কিছু ঘটেছিল, যা সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাইত না। সে কিছু যুক্তি দেখাত তার আচরণের স্বপক্ষে। আমি জানতাম সেগুলো কতটা অযৌক্তিক যুক্তি! কিন্তু বলতাম না কিছুই।
স্রেফ মনে মনে হাসতাম আর বলতাম "দেখা যাবে কতদিন টিকতে পার"! ছোট বেলা থেকে বাবাকে বুঝতাম ভীষণ, বন্ধুবান্ধবের তালিকায় পুরুষলীঙ্গের প্রানী বেশি থাকায় এই প্রজাতিটাকে অনেক ভাল করেই বুঝি আমি। তাই ওপরে বড় বড় বুলি আওড়ানো শুনেও বুঝতাম ভেতরে ভেতরে একটা জীবনের লোভ ওকে তাড়া করে। নিজের যুক্তির ট্রেডমিলে চেপে তাই ও গন্তব্যহীন হেঁটেই যাচ্ছে। আমাকে বেশি কিছুই করতে হবেনা। স্রেফ এই ট্রেডমিল থেকে ওকে নামাতে হবে, ঘাম মুছে দিয়ে বলতে হবে "মাই ডিয়ার গাব্বার সিং, আমার হাত টা ধরে দেখ, ক্লান্তি কেটে যাবে, পিপাসাও মিটে যাবে!" বেশিরভাগ ব্যাপারে আমি "ধর তক্তা মার পেরেক" টাইপের হলেও এই ব্যাপারে কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলাম।
গাব্বার সিংকে সময় দিলাম।
২৬ এপ্রিলের রাত। বাংলাদেশে তখন ২৭ এপ্রিল শুরু হয়ে গেছে। ভীষণ অকপটে বলে ফেলল "I love u"। ৬টা অক্ষর আমি ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে, উল্টো-সোজা অনেক রকম করে পড়লাম।
কিছু একটা ছিল না এর ভেতর। উল্টো পাল্টা যুক্তির ট্রেড মিলে চেপে বলা "ভালবাসি" কথাটার মধ্যে স্বস্তিটা ছিল না। আবারো হাসলাম মনে মনে আর বললাম "তোমাকে আরো একবার বলতে হবে এই কথাটা, সেদিন তুমি শান্ত হয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলবে, দিনটা বেশি দূরে নেই"। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমি খুব নিন্ম শ্রেণীর। চিন্তা ভাবনাটা যতই মহামানবের মত করিনা কেন, মানবিক চাহিদা আমারও ছিল! আমার ও "চিরবঞ্চিত" মনটা ভালবাসাঘন ছেলেমানুষি কিছু বাক্য শুনতে চাইত,প্রত্যাশা করত সে জানতে চাইবে কেমন আছি, কেমন আছি তাকে ছাড়া, কতটা ভালবাসি ইত্যাদি ইত্যাদি! সেগুলোর ধারে পাশেও সে নেই।
সে পড়ে থাকে তার অতীত নিয়ে, বস্তা পচা দুর্গন্ধময় অতীত। কানের মধ্যে গুজে রাখে হেডফোন, তাতে চলে মেটাল। সেই গান নামক হাউকাউ ছাপিয়ে আমার যন্ত্রণা পৌছেনা ওর কাছে। চার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আব্বু আম্মু আমার মধ্যে একটা জিনিস ভাল করে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, "ইউ হ্যাভ টু ডু ইট"! সেই থেকেই হেরে যেতে আমার যত আপত্তি। অবহেলা যত বাড়ে পাল্লা দিয়ে জ্যামিতিক হারে বাড়ে আমার জিদ।
বাড়তে থাকে ভালবাসা। তাকে বোঝাতেই হবে যে নষ্ট অতীত কে ভালবেসে সে নিজেকে প্রেমিক পুরুষ প্রমাণ করতে চায় সেটা আসলে "বুল শিট"! নিজের কাছে নিজের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে দিতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। রাতের পর রাত না ঘুমোতে ঘুমোতে না ঘুমানোটাই অভ্যাসে পরিণত হল। হঠাত একদিন বলল "আগামী কয়েকমাস আমি নেটে আসব না, ফোন করব মাঝে মাঝে"। ধাক্কা খেলাম, প্রকাশ করলাম না।
ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিল "going for hibernation"। কাটল ২ মাস। সেই দুমাস আমি প্রতিটি রাত ১২টা থেকে সকাল অবধি ঠায় বসে থেকেছি ল্যাপটপের সামনে! শরীর ক্ষয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার ধরিয়ে দিল স্লিপিং পিল। শুরু হল স্লিপিং পিলের ঊপর নির্ভরতা।
প্রচন্ড রকম আশা করছিলাম অন্তত জন্মদিনে ওর একটা ঊইশ পাব। ফোন করল কিন্তু "শুভ জন্মদিন" কথাটা বলল না। বুঝলাম সবই। এর কিছুদিন পর আবার নিয়মিত হল।
তারিখটা ছিল ১৬ অক্টবর ২০১১।
হঠাতই একদিন পুরনো সেই নামটা আবার ডাঈনী রুপে আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। এর আগে ওর এই অতীত নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাইনি আমি। সেদিন কেন যেন নিজেকে খুব অপমানিত মনে হল। হয়ত শরীরের ক্ষয়টা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছিল। প্রচন্ড রেগে গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম।
আমার সাথে যোগাযোগের সব রাস্তাই বন্ধ করে দিলাম। এমনকি নিজের সেলফোনটাও বন্ধ করলাম। জানিনা কোন পিশাচ ভর করেছিল কি না সেদিন আমার ওপর। পর দিনই যোগাযোগ করলাম পরিচিত এক ভাইয়ার সাথে, জাহিদ ভাই। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটা এন জি ও তে (সঙ্গত কারনে নামটা গোপন রাখব) জয়েন করার ডিসিশন নিলাম।
ট্রেডমিল থেকে তাকে নামাতে গিয়ে নিজেও সেই ট্রেডমিলে চেপে বসার স্বিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম! ১৮তারিখে জাহিদ ভাই কনফার্ম করলেন। ২০ তারিখে যেতে হবে। এর মধ্যে ও পাগলের মত খুজতে শুরু করেছে আমাকে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে ফোন করে করে বার বার বলছে সে একবার আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি বলিনি।
জানতাম হারিয়ে যাওয়া থেকে যদি কেঊ আটকাতে পারে সে ওই কণ্ঠস্বরটাই! ২০ তারিখ সকালে যখন ট্রেনে চেপে বসলাম, প্রথম বার কান্না পেল। সেলফোনটা খুললাম। ওর এস এম এস ঢুকল প্রায় সাথে সাথেই। না পড়েই আবার বন্ধ করে ফেললাম। নিজের ভেতর কেন এত নিরাসক্তি কাজ করছিল তার জবাব আমি এখনো পাইনি।
জাহিদ ভাই স্টেশনে থাকবেন এমনই কথা ছিল। পেয়েও গেলাম অতি দ্রুত মুঠোফোন নামক প্রযুক্তির কল্যানে। প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগল গন্তব্যে পৌছতে। অসাধারন একটা গ্রাম। টানা ৩ দিনের অনিয়মিত খাওয়ার কথা পেটটা জানান দিল।
জাহিদ ভাই বলল "যাও ফ্রেশ হয়ে এস, খাবার দিতে বলি, চাপকলে পানি তুলতে হবে, পারবা?"। আমি হেসে বললাম "জাহিদ ভাই আমার দাদাবাড়িও গ্রামে, আমি কোন জমিদারের বেটি নই যে চাপকল চাপতে দাসী বাদি লাগবে"। ঝির ঝিরে বাতাসে কেমন যেন স্বস্তি লাগছিল। মনে হল এমন স্বর্গ যে দেশে আছে সে দেশে কেন মানুষ বছর বছর ঢাকা গিয়ে নরকের আগুনে জ্বলে? হাত মুখে পানি দিয়ে ঘুরতেই দেখি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে একটা ছেলে। বয়স বোঝা যায় না।
১০ ও হতে পারে , আবার তার বেশিও। পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের আরো কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হবে! কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "নাম কি তোমার?" জবাব দিল না। জাহিদ ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত ধুতে ধুতে বলল "ওর নাম শাহজাহান, এখানকার স্কুল ফর ডিসেবলে পড়ে"। এদেরকেই পড়াতে হবে আমার। ওর মা এখানে পরিচ্ছন্ন কর্মী।
আমি কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলাম। খেতে বসলাম। ভুলেই গেলাম খুব কষ্ট পেয়ে ক্যারিয়ার নামক সোনার হরিণ ছেড়ে চলে এসেছি এখানে! যে খবর এখনও আমার মা ও জানেনা! (চলবে)
-----ফারজানা (ফারা) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।