আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেলিম স্যার

ক্লাস ওয়ান এর প্রথম ক্লাস। স্যার সবাইকে একটা বই দেখিয়ে জিজ্ঞাস করলেন “এই বইয়ের নাম কি?” ক্লাস এর সবাই বলল “বাংলা বই”। একমাত্র আমিই বলেছিলাম “আমার বই”। সেই দিনই সেলিম স্যারের সাথে পরিচয়। স্যার সেই দিন আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে অনেক আদর করেছিল।

তারপর থেকে ক্লাসে আমিই যেন স্যারের একমাত্র ছাত্র। স্যারের আদর ও পশ্রয় দুটোই যেন আমার পড়ালেখার উৎসাহ। ভাল করতে লাগলাম সব পরীক্ষায়। ক্লাসে প্রথম না হলেও তিন চার জনের মধ্যেই থাকত রেজাল্ট। ছোট থাকতে চোখে সমস্যা ছিল বলে মোটা গ্লাসের চশমা পরতাম (আমিই মনে হয় ক্লাসের একমাত্র চশমাধারী)।

আড়ালে অনেকেই আমাকে কানা বলে ডাকত। যদিও কেউ সামনে ডাকত না। একদিন টিফিন পিরিয়ডে আমাদের ক্লাসের সব চেয়ে গাধা ছাত্র মতি এসে সবার সামনে কানা কানা বলে ক্ষেপাতে লাগলো। সেই বয়সে মান অপমানবোধ বেশি না থাকলেও, ক্লাসে সবার সাথে মেয়েদের হাসির শব্দে যেন মাথায় খুন চেপে বসেছিল। দৌড়ে ধরতে গেলাম মতিকে।

মতি একলাফে ক্লাসের বাইরে, তারপর মাঠে দৌড়াতে লাগলো। আমিও নাছোড়বান্দা, হঠাৎ হোচট খেয়ে মতি পরল ভাঙ্গা ইটের স্তূপের উপর,কপাল থেকে গলগল করে বেরুতে লাগলো রক্ত। অন্য ছেলেরা স্যার কে খবর দিল, এক স্যার মতিকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেল। একটুপরেই আমার বিচারপর্ব, সেলিম স্যার তিন নম্বরি সন্ধিবেত নিয়ে ক্লাসে আসলেন। তারপর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলেন।

তারপর মারতে লাগলেন ইচ্ছামত। সেদিন রাতে প্রচণ্ড জ্বর এলো আমার, বিছানার পাশে আম্মা আব্বা বসে রইলেন সারা রাত। একটু পরে মাথায় কার যেন হাতের স্পর্শে তাকিয়ে দেখি সেলিম স্যার। স্যার আমার পাশে বসে কাঁদছেন। তারপর কোনদিন স্যার আমাকে মারেননি।

স্কুলের শেষদিন স্যারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম অনেক্ষন। স্যার মাথায় হাত রেখে বলেছিল বেটা বড়-হ। দীর্ঘ দশ বছর পর কোন এক ছুটিতে আবার দেখা হল সেলিম স্যারের সাথে। জীবন যুদ্ধে আহত এক অন্ধ সৈনিকের মত স্যার বিছানায় শুয়ে আছেন। দীর্ঘদিনের ডায়বেটিকস কেড়ে নিয়েছে তার চোখের আলো।

তবুও আমার গলার শব্দে স্যার আমাকে চিনতে পারলে, নাম ধরে ডাক দিয়ে কাছে বসালেন, আমি স্যারের হাত ধরে বসে থাকলাম। স্যারের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে আমরা বন্ধুরা চাঁদা ওঠালাম, কিন্তু স্যার আমাদের একটি টাকাও নেয়নি। এক ঝড়োবৃষ্টির দিনে স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, সেই সময়টাতে আমরা স্যারের কাছেই ছিলাম। আমার দুই চোখ ছাপিয়ে কান্না আসতে শুরু করল, নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি,সেদিন দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির জলে আড়াল করেছিলাম নিজেদের ব্যর্থতা আর কান্নার জল। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।