আমি লিখতে চাই................... পথে হাঁটা আমার ছোট বেলার শখ। ২০১১ সালের এপ্রিল চার তারিখে আমি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করেছিলাম। সারাদিন হাটতাম, আর রাতে ডাইরী লিখতাম। আজ ইচ্ছা হলো সেই্ পদব্রজে ভ্রমনটা সবার সাথে শেয়ার করি। জানি না কার কেমন লাগবে।
কেউ বিরক্ত হলে বলবেন ভাই।
০৭-০৪-২০১১
ব্লক এইচ
মোচনি ক্যাম্প
টেকনাফ
কক্সবাজার-টেকনাফ রুটের বাস থেকে যখন নামলাম তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। টেকনাফ বাস টার্মিনাল। প্রায় বিকেল হলেও চার দিকে খাখা রোদ। বাজারে অধিক লোক সমাবেশ আর ফুট পাথের অধিক ব্যবহার দেখে বোঝা যাচ্ছে আজ এখানে বাজারের দিন।
বাজার ভাঙার পথে। প্রচন্ড গরবমে আমি প্রায় হাপিয়ে উঠেছি। তেষ্টার তীব্রতা অনেক। আমি এদিক সেদিক ডাব খুজতে শুরু করলাম। যায়গাটা যেহেতু টেকনাফ তাই ডাব পেতে আমার তেমন কষ্ট হলো না।
আমার পোষাক আষাক চেহারা সুরোত দেখেলই বোঝা যায় আমি এখানকার লোকাল কেউ নই। আমি বইঙ্গা। বইঙ্গা মানে হলো যারা স্থানীয় নয়। ফলে দোকানদার আমার কাছে ডাবের দাম চাইল বিশ টাকা। টেকনাফের কোন স্থানীয় লোককে কখনোই বিশটাকা দিয়ে ডাব কিনে খেতে হয়না আমি জানি।
এখানে প্রায় সব বাড়ীতেই কম বেশী নারিকেল গাছ রয়েছে। ২০০৬ সালে আমি যখন এইসকল স্থানে এসেছিলাম তখন একশ ডাব দুই শ আড়াইশ বড় জোর তিনশ টাকায় পাইকারী বিক্রি হতে দেখেছি। তখন খুচরা একটা দুইটা বিক্রি হতো পাঁচ টাকা, ছয় টাকা। আর তা এখন খেতে হচ্ছে বিশ টাকা দিয়ে। আমি অগত্যা বিশ টাকা দিয়ে বেছে টেছে অপেক্ষাকৃত এবটু বড় একটা ডাব শাঁষ সহ গলধ করন করলাম।
এবটু বসে ভেবে নিলাম কখন হাটা শুরু করব। ঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটা পনের। আমি ছায়া যুক্ত একটা স্থান খুজছি একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য। কিছু দুর গিয়ে দেখলাম চল্লিশের কোঠায় এক লোক তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে একটা বেশ বড় আকারের ছায়া যুক্ত গাছের নীচে অস্থায়ী খাবারের দোকান খুলে বসেছে। সেখানে ভাজা পোড়া বিক্রি করছে সেখানে।
সামনে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসতে বসতে দেখলা্ম একটা ফ্লাস্কও রয়েছে।
-চা হবে?
আমি যেকোন বেশী চিনি খাওয়া লোকের চাইতেও চিনি বেশী খাই। কিন্তু এই দোকানদার আমার দিকে যে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিলেন তা আমার কাছে মনে হলো আবিদজানের চা। আবিদজানের অধিবাসিরা তাদের চায়ে বিশ্বের যেকোন দেশের চেয়ে বেশী চিনি খায়। আমি অতি কষ্টে চা খাওয়া শেষ করলাম।
ঘড়িতে তিনটা উনত্রিশ। আমি একটু হেঁটে আমার কাঙ্খিত সাইন বোর্ডের নিচে এসে দাড়ালাম। সেখানে লেখা আছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, মোট দুরত্ব ১০০৪ কি.মি। এটা সড়ক ও জনপদের হলুদ বোর্ডের উপর কালো কালিতে লেখা সাইন বোর্ড। ঠিক তিনটা ত্রিশ মিনিটে আমি টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার উদ্দেশ্যে প্রথম পা বাড়ালাম।
আমার হাতের ডান দিকে তেমন কোন গাছপালা না থাকায় সামান্য রোদ আসছিলো মাঝে মধ্যে। হাতের বাম দিকে বেশ গাছপালা থাকায় আমি ছায়ার উদ্দেশে বাম দিক থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি হেঁট চলেছি। সামনে হ্নীলা বাজার। আমার পাশ কাটিয়ে হুস হাস করে বিভিন্ন ধরনের গাড়ী যাচ্ছ।
একটা বিষয় খেয়াল করলাম অন্যান্য এলাকার স্থল যানের চেয়ে এই এলাকায় একটা স্থল যান বেশী চলছে, আর তাহলো মাইক্রো বাস। তারা লোকাল বাসের মতই যাত্রী বহন করছে। পথের মাঝখানে দাড়িয়ে হাত তুললেই হল। গাড়ী থামিয়ে আপনাকে তুলে নেবে। আমাকে সন্ধার আগেই রাতের আশ্রয় খৃজতে হবে।
এই এলাকায় নজীর নামে আমার এক পরিচিত কিশোরের বাড়ী। আমার কাছে ওর ফোন নম্বর আছে। আমি তাকে ফোন করলাম।
-হঠাৎ করে আমার কথা কেন মনে পরল?
-আমি টেকনাফে তো তাই।
- বল কি? তুমি কি টেকনাফ বাজারে?
-এতক্ষন ছিলাম, এখন হ্নীলার দিকে যাচ্ছি।
-মোচনি গেটে এসে আমাকে ফোন দিও, আমি তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসব।
ফোন রেখে আমি পথচারীর কাছে জানতে পারলাম মোচনী গেট আরো অনেক দুরে। আমি হাঁটতে থাকলাম। বেলা শেষের দিকে। রোদের তেজ একদমই নেই।
হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। ফুরফুরে বাতাস। লোকজন গরু নিয়ে বাড়ী ফিরছে। রাস্তার প্রায় সবাই-ই আমার দিকে ভ্রু কুচেক তাকাচ্ছে। আজিব চিজ তো! মাথায় গামছা বাধা, পড়েন হাফ প্যান্ট, পিছনে ব্যাগ, আবার যাচ্ছে হেঁটে।
এ আবার কোন দেশী পাগল রে বাবা?
আমার বা দিকে নাফ নদী। সেখানে লবনের চাষ হচ্ছে। সারি সারি লবনের স্তুপ। সেখানে কাজ করছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। আমি আনমনে হাঁটছি।
একটু যেতেই সামনে পরল ল্যাদা বর্ডার গার্ড ক্যাম্প। বিমর্ষ মুখে ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ রাইফেল নিয়ে ডিউটি করছে বিজিবি জওয়ান। ক্যাম্প ছাড়িয়ে ল্যাদা বাজার। সন্ধা প্রায় হয়ে এসেছে। আমাকে সন্ধার আগে হ্নীলা যেতেই হবে।
ওখানে কোন এক মসমজিদে রাত কাটানো যায় কিনা ভাবছি। আমি আবার নজীরকে ফোন করলাম।
-হ্যালো নজীর আমি এখন ল্যাদা বাজারে।
-ক্যানো তোমাকে না বললাম মোচনী গেটে এসে আমাকে ফোন করতে?
-মোচনী বাজার আর কত দুর?
-আরো পিছনে ফেলে গেছ। একটা মাইক্রতে উঠে চলে এসো।
আমি লোকাল একটা মাইক্রো থামিয়ে মোচন গেটে চলে এলাম।
হেলপার আমাকে যথা স্থানেই নামিয়ে দিলো। নেমেই দেখি নজীর দাড়িয়ে। আমাকে সে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলল। চারদিক অন্ধরকার।
আমি আমার চোখের জল লুকানোর একটা সুযোগ পেলাম। নজীর আমাকে নিয়ে মোচনী রিফিউজি ক্যাম্পের দিকে রওনা দিলো। নজীর বেশ রেগা হয়ে গিয়েছে। আমরা হেঁটে চলছি আলো আধারী পরিবেশে। লক্ষ্য নজীরের বাড়ী।
একটা ক্যাম্প পেরিয়ে আমরা আরএকটা ক্যাম্পএ প্রবেশ করলাম। চারদিক অন্ধকার থাকায় আমি তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। বিভিন্ন গলি উপগলি পেরিয়ে আমরা অবশেষে ওদের ঘরে এসে পৌছালাম। ক্যাম্পএর অবস্থা দেখে মনে হলো এটা আসলে একটু উন্নত বস্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ঢাকার বিভিন্ন বস্তির চেয়ে একটু উন্নত।
লম্বা লম্বা ঘর গুলো টিনের পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা। মধ্যে ঢুকলে ছোট ছোট রুম। আমি আর নজির বসে কথা বলছি। এর মধ্যে ওর বাবা এলেন। তার সাথে কথা বলতে বেশ কষ্ট হলো আমার।
আমি কক্সবাজার এলাকার কথা বুঝি এবং বলতেও পারি। কিন্তু নজীরের বাবার কথা অনেক দুর্বোধ্য। উনি তো খাঁটি বর্মাইয়। নজীর মাঝখানে অনুবাদকের কাজ করলেও কথা বেশী দুর এগোনো সম্ভর হলো না। আমি অত্যান্ত ঝাল ডীম ভাজা দিয়ে আতপ চালের ভাত খাওয়ার চেষ্টা করলাম।
এরা কাঁচা মরিচ নয়, শুকনা মিরচের গুড়া হলুদের গুড়া ইত্যাদি দিয়ে ডীম ভাজে। প্রচন্ড ক্ষুধা থাকা সত্বেও আমি আক্ষিরক অর্থেই খেতে পারলাম না। হাত ধুইতে বা্ইরে এসে শুনলাম কারা যেন সুর করে কি গাইছে। বেশ কিছু মহিলা কন্ঠের সমবেত সঙ্গীত। গানের কথা বোঝা যাচ্ছে না একদমই।
-কি হইতেছে রে নজীর?
-হলা গাইতাছে।
-হলা কি জিনিস?
গিয়ে দেখলাম হলা কি জিনিস।
হলা হলো বিয়ের গীত। এটা মিয়ানমারের মুসলমান বিয়ের রীতি। আট দশ জন মহিলা একত্রে গোল হয়ে গাওয়া হয় এই গীত্।
আগমী শুক্রবার নজীরের ভাইয়ের বিয়ে পাশের ক্যাম্পের এক মেয়ের সাথে। সেই উদ্দেশ্যেই এই হলা গাওয়া হচ্ছে। গানের সুর একদমই শ্রুতি মধুর না। নজীর এর অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিলো। অর্থ হচ্ছে
"অমুক ক্যাম্পের তমুক মেয়ের সাথে আমাদের ক্যাম্পের অমুকের বিয়ে দেয়া হবে।
আমরা তাতে খুবই খুশি। এ বিয়েতে সোনা দেয়া হবে, অনেক যৌতুক দেয়া হবে, আমরা তাতে খুশি। আমরা অনেক খাব। "
আমি পেটে ক্ষুধা নিয়েই ঘুমিয়ে পরলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।