অরুণালোক
তৈয়ব খান
(নরসিংদী থেকে ফিরে)
বাঙালি জাতির জীবনে মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। ১৯৭১ সালে এ মার্চ মাসটি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে এ মাসের ৭ই তারিখে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেছিলেন, যা সমগ্র জাতিকে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা যুগিয়েছিলো। দেশনেতার উদাত্ত্ব আহ্বানে নিরস্ত্র অসহায় বাঙালিরা পশ্চিম পকিস্তানের প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করেছিলো, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলো দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য। এ মরণ শপথ বাঙালি জাতিকে মাত্র নয় মাসে দেশ স্বাধীন করার যে শক্তি যুগিয়েছিল, তা সমগ্র বিশ্ববাসির কাছে আজও বিস্ময়।
২৫শে মার্চ তারিখের রাতটি পাক-হানাদার বাহিনীর বর্বরতার জন্য কালরাত্রি হিসেবে ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। এ মাসে বাঙালি জাতির মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক গ্রেফতার হন যদিও এর আগে তিনি বহুবার কারাবরণ করেছিলেন। তাই এ মাসটির কথা কেউ ভুলতে পারবে না।
নদী মাতৃক, সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এ সোনার বাংলাদেশ। এ দেশ শেরে বাংলার দেশ, এ দেশ বঙ্গবন্ধুর দেশ, এ দেশ রবীন্দ্র- নজরুল- জসীম উদ্দীন- জীবনানন্দ- মধুসূদনের দেশ।
এ দেশ হাজার বাউল- সাধক ও মুনিঋষি- দরবেশের দেশ। এ দেশ সকল দেশপ্রেমিক মানুষের প্রাণের বাংলাদেশ। এ দেশ ছোটদের বড়োদের সকলের, এ দেশ চাষা- মজুর- আর অগুণিত খেটে খাওয়া সংগ্রামী মানুষের দেশ। ‘মার্চ’ এ দেশের প্রিয় স্বাধীনতার মাস।
দেশ স্বাধীন হয়েছে একচল্লিশ বছর হলো।
প্রতি বছর বাঙালি জাতি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে স্বাধীনতা দিবস, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাঁদের উত্তরসূরীদের আত্ম-ত্যাগের কথা। যে স্মরণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আগামী পথ চলার প্রেরণা লাভ করে।
গত ৩১শে মার্চ ২০১২, শনিবারে উদ্যাপিত হলো নরসিংদী জেলা পরিষদ আয়োজিত ৪১তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস- ২০১২। এ উপলক্ষে “স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু” শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বিশেষ এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচকদের সকলেই ছিলেন নরসিংদী জেলার কৃতিসন্তান, সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ও যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
অনুষ্ঠানটির প্রধান আকর্ষণ ও প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব মাইন উদ্দিন খন্দকার। বিশেষ অতিথি যুগ্ম-সচিব মো: সামসুজ্জামান যিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সচিব ও নরসিংদী জেলার স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ, সুযোগ্য সভাপতি। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন নরসিংদী সরকারী কলেজের দু’জন সাবেক অধ্যক্ষ, অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ও অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা মিয়া এবং গুণী ব্যক্তিত্ব জনাব মো: আবুল কালাম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নরসিংদী জেলার সুযোগ্য জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট মো: আসাদোজ্জামান।
নরসিংদী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম সাহেবের আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে পাক্ষিক বিবর্তন পত্রিকার পক্ষে এ অনুষ্ঠানটিতে যোগদানের কথা ছিলো সম্পাদক আবদুল মাবুদ চৌধুরী সাহেবের।
অনিবার্য কারণে তিনি যেতে না পারায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আমাকেই যেতে হলো। সম্পাদক সাহেব ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বেশ ¯েœহ করেন। আমি এ পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। যিনি এ অনুষ্ঠানটি ও আমাদের বিবর্তন পত্রিকার সাথে যোগসূত্র ঘটিয়ে দিলেন, তিনি সম্পাদক সাহেবের বিশিষ্ট বন্ধুÑ এলডার জন এস. আর. তালুকদার-কবীর। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব, যুগ্ম-সচিব মো: সামসুজ্জামান সাহেবেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।
ব্যক্তিগতভাবে হাসিখুশি ও বন্ধুবৎসল কবীর ভাইকে আমার বেশ ভাল লাগে। তার সাথে অনুষ্ঠানে গিয়ে পুরো অনুষ্ঠানের উপর ফিচার করার সুযোগ পেয়ে খুশিই হলাম।
সবুজ গাছে ছাওয়া আঁকা বাঁকা পিচঢালা পথ পেরিয়ে আমাদের মাইক্রোবাসটি যখন নরসিংদীর সুতাপট্টিতে সোহরাওয়ার্দী পার্কে পৌঁছালো তখন বিকেল চারটা। চৈত্রের বিকেল, রোদের ঝাঁজ রয়েই গেছে তখনও। তবে গা সওয়া গরম।
ড্রাইভার বুলু দা’কে গাড়ি সাইড করিয়ে রাখতে বলে আমি ও কবীর ভাই গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম। তখনও ডেকোরেশন কর্মীরা কেউ ইলেকট্রিকের কানেকশন পরীক্ষা করে দেখছিলো, কেউ অতিথি-আগতদের জন্য আসন সাজাচ্ছিলো, কেউ সাউন্ড সিস্টেম চেক করছিলো, ফাঁকে আমি ক্যামেরা বের করে খালি মঞ্চ থেকে ব্যানারের গোটা কয়েক ছবি তুলে নিলাম, পরে কাজে লাগবে ভেবে। অনুষ্ঠান শুরু করতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে বুঝতে পেরে এ’ সময়ে চারপাশটা রেকি করতে দু’জনেই বেরিয়ে পড়লাম। ঘণ্টাখানেকেই মোটামুটি নরসিংদীর বাজারটা দেখা হয়ে গেল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যেমন- চাল-ডাল-গুড়-সবজিসহ অন্যান্য জিনিস পত্রের দাম জেনে নিতে নিতে আমরা ঢাকার দামের সাথে তুলনা করছিলাম।
বাজারের বাইরে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম কচুরি পানা ভর্তি একটা খাল, যেটা সারা বাজারের ময়লা আবর্জনা আর দুষিত পানি বয়ে নিয়ে অনতিদূরে মেঘনায় ফেলছে। বছর বারো তেরো’র তিনজন কিশোর খালের পাড়ে ফেলে দেওয়া মন্দিরের পোড়া মোম সংগ্রহ করে নিচ্ছে দেখতে পেলাম। খাল ছেড়ে আবারও অনুষ্ঠানস্থলে ফিরে আসতেই দেখলাম ঊনিশ'শো পয়তাল্লিশ সালের এক প্রাচীন ভবনের গা ঘেঁসে নতুন একটি ভবন, যেটি বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের শাখা অফিসের পরিচয় নিয়ে প্রবীণের মাথা ছাড়িয়ে গেছে কড়ূল বাঁশের মতো। প্রবীণের সাথে নবীণের এ সখ্যতা আমায় বেশ মুগ্ধ করলো।
চা খাওয়ার সময় মাইকের ঘোষণা শুনলাম অনতিবিলম্বে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার।
আমরা মঞ্চের কাছে পৌঁছুতেই শুনলাম স্থানীয় চারণ গায়ক সুনীল দাসকে গান গাইতে অনুরোধ জানানোর। ছিপছিপে লম্বা সুনীল দাস শুধু একটা ডুগডুগি বাজিয়ে খালি গলায় বঙ্গবন্ধুকে “বাংলাদেশের নেতা তুমি শেখ মুজিবুর রহমান/ তোমারই গুণের কথা জানেন বিশ্ববাসী” এবং “তুমি বেঁচে থাকবে/ ইতিহাসের মাঝে/ বঙ্গবন্ধু গো, আমি তোমায় ভীষণ ভালবাসি” গান দু’টি দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। শিল্পীর আবেগ আমাকেও ছুঁয়ে গেলো। ইতোমধ্যে দেখলাম একে একে সম্মানিত সব অতিথিরা এসে গেছেন। এর আগে এক ফাঁকে মঞ্চ থেকে অনতিদূরে একটি ভবনে অতিথিরা বসার সময়েই আমি সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময়ের পর আমাদের পত্রিকা পাক্ষিক সময়ের বিবর্তনের সৌজন্য কপি সবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।
অনুষ্ঠানের ঘোষণা শুনে সবাই নেমে এলে সঞ্চালকের আহ্বানে একে একে মঞ্চে গিয়ে অতিথিরা আসন গ্রহণ করলেন। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক জনাব আসাদুজ্জামান খোকন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্রনেতা। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালনের আহ্বান জানালে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। আমি ফাঁকে ফাঁকে আমার প্রয়োজনীয় ছবিগুলো তুলে নিচ্ছিলাম।
এরপর সঞ্চালক ঘোষণা দিলেনÑ “সম্মানিত দর্শক শ্রোতা ভাইবোনেরা, এবার আপনাদের সামনে রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি উপস্থাপন করবে ব্রাহ্মন্দী কে কে এম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র মো: তৌহিদুল ইসলাম পিয়াল”। ঘোষণাটি হওয়ার সাথে সাথে দৃপ্ত পদক্ষেপে একজন কিশোর এগিয়ে এলো, তার পরনে বঙ্গবন্ধুর মতোই পোশাক, চোখে বঙ্গবন্ধুর মতো করে কালো চশমা আটা, গোঁফজোড়াও তেমনি বাঘা, চুলগুলোও তেমনি কাঁচা-পাকা। আমার মনে হলো, বঙ্গবন্ধু বুঝি ঐ কিশোরের দেহে ভর করে আছেন। ছেলেটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গভীর চোখে সামনে অবস্থানরত সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আনলো, তারপর শুরু করলো রক্তের কোষে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী সেই কালজয়ী ভাষণÑ, “ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সব জানেন এবং বোঝেন... ...।
” অখ- নিরবতা নেমে এলো সারা অনুষ্ঠানে, বাতাসে তরঙ্গ তোলে সকলকে বিবশ করে রাখলো যার বজ্র উচ্চারণ, সে কেবল ঐ কিশোরের কণ্ঠ। ভাষণ শেষ হয়ে যাবার পরও কয়েক মুহূর্ত তার রেশ থেকে গেলো। উপস্থিত সর্বস্তরের গণমানুষ সহস্র করতালি দিয়ে পুরো এলাকাটিকে মুখরিত করে দিলো।
বিজয়ী কিশোরের বেশে বঙ্গবন্ধু মঞ্চ থেকে নেমে যেতেই আসাদুজ্জামান খোকন আলোচকদের মাঝ থেকে নরসিংদী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শ্রদ্ধেয় গোলাম মোস্তফা মিয়াকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখার আহ্বান জানালে তিনি আসন থেকে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। এখানে একটি বিষয় আমাকে খুব বিস্মিত করেছে।
তা হলো এই যে, এতো বড়ো মাপের মানুষেরা নরসিংদী বাসীর সামনে বসে রয়েছেন, মঞ্চে তাঁদের জন্য কোন সোফা নেই, নেই কোন আড়ম্বরতার বালাই। সব কিছুই সাধারণ, একে বারে সাদামাটা। কিন্তু সেসবের দিকে প্রবীণ-জ্ঞানী-গুণী ও সম্মানিত-মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী সৈনিকদের ফিরে দেখার অবকাশ নেই। তাঁরা মঞ্চের উপর সাধারণ সাদা চাদরে জোড়াসন হয়ে এমনভাবে বসে আছেন যেন, একরাশ শ্বেত শুভ্র রজনীগন্ধা। তাঁদের চোখের তারায় খেলা করছে অতীতের অনেক ঘটনা, যা তাঁরা নতুন প্রজন্মের জন্য উজাড় করে ঢেলে দিতে এসেছেন যেন নতুন প্রজন্ম তাঁদের স্মৃতি পটে ধরে রাখা ঘটনাগুলো শুনে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়।
আমার মনে হলো, শ্রদ্ধা মানুষ এমনি এমনি পায় না, শ্রদ্ধা পাবার মতো যোগ্যতা থাকতে হয়। উঁনারা সত্যিকারের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। আমি সাধারণত: শ্রদ্ধেয় কারো সামনে আজও আসনে বসি না। বা বসে থাকলে, এমন কাউকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিনীতভাবে তাঁদের জন্য আসন ছেড়ে দিই। এ’জন্য আমাকে অনেক সময় সুহৃদদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়।
আমি ওদের জানিয়ে দিই যে, সম্মানের এ কাজটা আমি আজীবন করবো। সে যাক, অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা মিয়া তাঁর বক্তব্যে ক্ষোভের সাথে বললেন, স্বাধীনতা বিকৃতিকারীদের এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, নির্দিষ্ট কারো ঘোষণায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। ” তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজও বাস্তবায়ন হয় নি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বাদ বাঙালি আজও পায় নি। ” তাঁর এ কথাগুলোর বাস্তবতা চোখ মেললেই দেখতে পাওয়া যায়।
তবে তিনি আশাবাদি মানুষ। তাই বললেন, “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এদেশে বাস্তবায়িত হবেই, ইনশাল্লাহ্। ”
উনার বক্তব্য শেষ হবার পর মূল্যবান বক্তব্য নিয়ে এলেন নরসিংদী সরকারী কলেজের আরেকজন শ্রদ্ধেয় সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক জনাব মোহাম্মদ আলী। তিনি তাঁর বক্তব্যে নরসিংদীর মানুষের উপর পাক-হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “এই নরসিংদীর মাটিতে পাক-বাহিনী দু’বার বম্বিং করেছে। তারা প্রথম বম্বিং করে ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল ও পরে মে মাসে।
” তিনি দুঃখের সাথে তাঁদের বাড়ি পুড়ানোর ঘটনার কথা নরসিংদী বাসির কাছে তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের পরিবারের ত্যাগ ও তিতীক্ষার কথা নতুন প্রজন্ম জানতে পেরে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
বক্তব্যের এ’ পর্যায়ে নরসিংদীর মাটি ও মানুষের প্রাণ পুরুষ, অন্যতম সংগঠক, স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর সম্মানিত সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব, শ্রদ্ধেয় যুগ্ম-সচিব সামসুজ্জামান সাহেব। জনাব সামসুজ্জামান তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পরিচয় কী ছিলো এ প্রসঙ্গে বলেন, ঐ উত্তাল দিনগুলোতে বাঙালির পরিচয় ছিলো “জয় বাংলা”।
তিনি ভারতে যাওয়ার সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ভারতের মানি এক্সচেঞ্জ স্পটগুলোতে, হোটেল রেঁস্তোরায় বাঙালিদের “জয়বাংলা” বলে সম্মান জানানো হতো। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার দাবী রাখেন এবং সব শেষে খুব আবেগময় কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর উপর একটি নাতিদীর্ঘ স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির নাম “অনেক ক্ষুধা”। পাঠকের জন্য আমি তাঁর কবিতাটি তুলে ধরছি: অবুঝ মনের সাদা মাটা প্রশ্ন/পলাশের রং এত লাল কেন? / জিজ্ঞেস করতেই স্মৃতিতে ভেসে উঠে/ ৭১’ এর রক্ত ঝরা মার্চ/ ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের ফসল কোথায়?/ মায়াময়ী প্রকৃতি রুদ্ধশ্বাসে বলে দিল/ লাল সবুজের পতাকা। / কবি কোথায়?/ যে কবি পাঠ করে গেছে ৭১’ এর ৭ই মার্চ/ তাঁর অমর কবিতা/ এ প্রশ্নটি উঠলেই/ হায়নার দল রক্ত চক্ষু দেখায়/ রক্ত পিপাসু শুয়ারের বাচ্চা গুলো/ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত চায়/ না-আর-না/ রক্ত দেব না আর, রক্ত খাব এবার/ আমি মুজিব সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা,/আমি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলব।
/ রক্তে আমার মুক্তিযুদ্ধের তপ্ত উন্মাদনা;/ আমি স্বাধীনতার কথা বলবো/ আমি মুজিবের কথা বলব বলেই-বেঁচে আছি। / পতাকার গায়ে আচড় দেবে?/ এক সাগর রক্ত ঝরাব আবার/ ছিড়ে খাব রাজাকারের বাচ্চাগুলো। / আর কত ঘুমাও-যুদ্ধ ঘোষণা কর/ জেগে ওঠ ৭১’ এর মুজিব সেনাদল। /চারদিকে কিলবিল করছে পরাজিত হায়েনার দল/তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ওষ্ঠাগত প্রাণ। / আর দেরী হলে আবার লাল হবে/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জল।
এরপরে বক্তব্য নিয়ে আসেন, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, নরসিংদীর জেলা পরিষদ প্রশাসক এডভোকেট জনাব মো: আসাদোজ্জমান। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি অনুষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রশংসা করেন। তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা ৭ই মার্চের মহান নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে রয়েছে’। তিনি ২৬শে মার্চকে প্রাধান্য দিয়ে ৩১শে মার্চের এ অনুষ্ঠানের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন।
এরপর অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বের অন্যতম আকর্ষণ নরসিংদীর কৃতি সন্তান, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধেয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাননীয় অতিরিক্ত সচিব জনাব মাইন উদ্দিন খন্দকারকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্যের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
জনাব মাইন উদ্দিন খন্দকার তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে কেন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়, তার বিশদ ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি ‘আজকের দিনে বঙ্গবন্ধু কতোটুকু প্রাসঙ্গিক’ তার প্রতিও আলোকপাত করেন। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বঙ্গবন্ধুকে কেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির মর্যাদা দেওয়া হয়, সে প্রসঙ্গে বলেন, আড়াই হাজার বছরের মধ্যে কোন বাঙালিই এ দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেন নি। কেননা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন একজন সফল নেতা, তিনি একই সূত্রে সমগ্র দেশের মানুষকে যিনি গেঁথে নিতে পেরেছেন। তিনি ছিলেন এক অনন্য সাধারণ মানুষ।
১৯৭১ সালের আগে কোন বাঙালিই বাংলাদেশ শাসন করেন নি। এ প্রসঙ্গে তিনি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম পর্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সাথে বঙ্গবন্ধুর উপর লেখা নির্মলেন্দু গুনের একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। আবৃত্তি শোনে উপস্থিত দর্শক শ্রোতা মুগ্ধ হন। এরপর প্রাসঙ্গিকভাবে জামায়াত ইসলামের কথা উঠে এলে তিনি জামায়াত ইসলামকে ‘যমের হাতে ইসলাম’ বলে মন্তব্য করলে উপস্থিত জনতা একযোগে হেসে উঠেন।
নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, আমাদের দেশের এক শ্রেণির কাঠমোল্লা নারীকে বন্দি করে রাখতেই প্রয়াসী। এ কথা সত্যি যে, নারীর চলাফেরা, খাবার-দাবার, পোশাক- এসবের স্বাধীনতা এবং শিক্ষা ও মেধা বিকাশসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অঘোষিত অবরোধ আরোপ করে রাখা হয়েছে। জাতীয় অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হলে নারীদেরও পুরুষের পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জনাব মাইন উদ্দিন খন্দকারের মূল্যবান বক্তব্য শেষে শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে ”স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু” শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে যেসব শিক্ষার্থীরা চারটি বিভাগে মেধাভিত্তিক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভ করে, তাদের পুরস্কৃত করা হয়।
উল্লেখ্য যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপর “স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু” শীর্ষক রচনা প্রতিযোগিতায় নরসিংদী জেলার প্রতিটি উপজেলার স্কুল ও কলেজ থেকে হাজারের বেশি শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেছিল। অভিজ্ঞ বিচারক ম-লী সেসব লেখা বাছাই করে ৪টি বিভাগের ১৮জনকে পুরস্কৃত করে তাদের মেধার মূল্যায়ন করেন যেটি ছিলো অনুষ্ঠানটির অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ।
এতে ‘ক’ বিভাগ থেকে ১ম হয় জনতা আদর্শ বিদ্যাপীঠ, পলাশের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা সুলতানা, ২য় স্থান অধিকার করে যুগ্মভাবে- জয়নগর, মহেশপুর, রায়পুরের আলহাজ্ব বজলুল হক জে এম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্রী তাসনোভা রিবন্যা এবং নরসিংদী সদরের এন. কে.এম হাইস্কুল এন্ড হোমস এর ৭ম শ্রেণির আরোয়া হাসান (হাফসা), ৩য় স্থান অধিকার করে যুগ্মভাবেÑ নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দী কেকেএম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির মো: তৌহিদুল ইসলাম, (যে বঙ্গবন্ধুর সাজে সেজে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনিয়ে সকলকে মুগ্ধ করেছিলো) এবং হাসনাবাদ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ইফরাত জাহান সাদিয়া। এরপর ‘খ’ বিভাগ থেকে ১ম স্থান অধিকারী নারায়ণপুর সরাফত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্র অলিউল্লাহ, যুগ্মভাবে ২য় স্থান অধিকারীরা হলো ব্রাহ্মন্দী আইডিয়াল হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী মাহবুবা বিনতে মোহাম্মদ (মহুয়া) ও শিবপুর বাঘাব ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মো: শাওন ভুঁইয়া। ৩য় স্থান অধিকারির সংখ্যা ৩জন।
এরা যথাক্রমে বেলাব’র দেওয়ানের চর মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী সিনথিয়া সিলভী, বাদুয়ারচর কাজী আবুল হাসেম উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আলম সুমি এবং এন.কে.এম হাইস্কুল এন্ড হোম্স এর ১০ম শ্রেণির ছাত্রী সাহিদা আক্তার ইতি। বিভাগ ‘গ’ থেকে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে ১ম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করে ডা. নজরুল বিন নুর মহসিন গার্লস স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী রোকসানা আক্তার, ২য় স্থানে যুগ্মভাবে নরসিংদী সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিজওয়ানা হক চৌধুরী ও আ: কাদির মোল্লা সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণির মুসফিকুর রহমান মৃধা। ৩য় স্থান অধিকারী মনোহরদী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো: মোবারক হোসেন। ‘ঘ’ বিভাগ থেকে রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে ১ম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করে মাধবদী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিবিএ (১ম বর্ষ, সম্মান) এর ছাত্রী পলিনুর আক্তার ঝুমা, ২য় স্থান অধিকারী নরসিংদী সরকারী কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের (সম্মান, ২য় বর্ষ) ছাত্র মো: আব্দুল্লাহ আল মারুফ (লিমন) ও ৩য় স্থান লাভ করে একই কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের (সম্মান, ১ম বর্ষ) ছাত্র মো: নুর মাকসুদ মিয়া। প্রতিযোগিতায় জয়লাভকারীদের মাঝে আমন্ত্রিত অতিথিরা পুরস্কার বিতরণ করে উৎসাহিত ও সম্মানিত করেন।
অবশ্য অতিথিদের জন্যও উপহারের বন্দোবস্ত থাকায় মনে মনে আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়েছি। সম্মানিতদের সম্মান জানানোই উচিৎ যদিও সত্যিকারের সম্মান জানানোর মতো কোন উপহার কোনকালেই সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য একে একে দর্শক সমাগম বাড়তে লাগলো। বাদ্য ও সঙ্গীত শিল্পীরা একে একে এসে মঞ্চে আসন নিলেন। তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্বটিকে আয়োজকরা দু’টি ভাগে ভাগ করেছিলেন।
প্রথম ভাগে মঞ্চে এলেন স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ। তাঁরা দর্শক শ্রোতাদের মনের মাঝে দেশপ্রেম জাগানো এবং মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সমবেতভাবে অগ্নিবাণীতে ভরা পরপর দু’টি গান পরিবেশন করলেন। তারপরে কৌতুক অভিনয় করে উপস্থিত দর্শক হাসালো স্থানীয় তরুণ কৌতুক অভিনেতা আতিকুল ইসলাম। এরপর এককভাবে গান পরিবেশন করলেন রতন ধর। তিনি খুব আবেগ ঢেলে গাইলেন, যে প্রেম স্বর্গ হতে এসে ভুবনে অমর হয়ে রয়’ উনার চমৎকার পরিবেশনা গানটির মূল শিল্পী খালিদ হাসান মিলুর কথা মনে করিয়ে দিলো।
এ গানটি অবশ্য প্রতীক হাসানও গেয়েছেন। যা হোক, পরের একক গানের শিল্পী ‘আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা/ভয় আছে পথ হারাবার” কালজয়ী শিল্পী সতীনাথের এ গানটি পরিবেশন করলেন তন্ময়া সাহা। কোন মেয়ের কণ্ঠে আমি এ গান আগে কখনো শুনি নি। ওর কণ্ঠের এ গানটি আমাকে বেশ খানিকক্ষণ তন্ময় করে রাখলো, মুগ্ধ করলো। তাল-লয় সঠিক ভাবে ধরে রেখে ও’র গান পরিবেশনায় আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে অনুরোধ পাঠাই, গুরু নজরুলের “মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর/ নম: নম: নম: নম: নম: নম:/ শ্রাবণ মেঘে নাচে নটবর....” গানটি পরিবেশন করার জন্য।
কিন্তু এ ধরনের অনুষ্ঠানে সময় বেঁধে দেওয়া থাকে বিধায় আর অনুরোধ করলাম না। সে যাক, তারপর “সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে তোমার কপালে....” গানটি খুব সুন্দর গাইলেন নিতু নন্দী। মুনা ভৌমিক গাইলেন ফেরদৌসী রহমানের “ও আমার দরদী/ আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায়....। ” গানটি অবশ্য মরমী গায়ক আব্বাস উদ্দিনও গেয়েছেন। এরপরে বৃষ্টি সাহা’র কণ্ঠে শুনলাম আশা ভোঁসলের গান “খুব চেনা চেনা লাগছে তোমাকে”।
সুবীর নন্দী’র বিখ্যাত গান “দিন যায় কথা থাকে/ যে কথা....” গানটি আসল গায়কের মতো ভরাট কণ্ঠে না হলেও সুন্দর পরিবেশন করলো রণি দাস। সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও বেতার শিল্পী দীলিপ দাস গাইলেন, যুগ্ম-সচিব জনাব সামসুজ্জামানের লেখা গান “আমি উত্তরে যাবো না/ দক্ষিণে যাবো....” গানটি আমার কাছে নতুন লাগলো, আগে শোনা হয় নি। উনার দীর্ঘদিনের সাধা গলায় গানটি অসম্ভব মুগ্ধ করলো উপস্থিত সবাইকে। পরে চামেলী দাস গাইলেন পরপর দু’টি গান, “এমন একটি মানুষ খুঁজে পেলাম না...” গানটি অনেক শুনেছি কিন্তু মূল শিল্পীর নাম মনে করতে পারলাম না। প্রতিমা’র গাওয়া “একটি গান লিখো আমার জন্য/ না হয় আমি...” পরিবেশন করে উনি মুগ্ধ করলেন সবাইকে।
চামেলী দাসের কণ্ঠে গান দু’টি শুনে মনে হলো, এ গান দু’টি বুঝি ওর জন্য সৃষ্টি হয়েছে। স্বপন সাহা গাইলেন, “মানুষ বাঁচাও/ বাঁচবে আমাদের পৃথিবী”। এ গানটিও আমি নতুন শুনলাম এবং গায়কের মুন্সিয়ানায় মুগ্ধ হলাম। রুমা দাসের কণ্ঠে যখন মমতাজের গাওয়া ‘খায়রুন সুন্দরী’ ছায়াছবি’র “খায়রুন লো, তোর লম্বা মাথার কেশ/ চিরল দাঁতের হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ” গানটি শুনলাম, মনে হলো এমন একটি হালকা আঙ্গিকের গান এতো বড়ো মাপের শিল্পীর কণ্ঠে মানায় না। অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টি খেতে খেতে উনার সাথে এ বিষয়ে কথাও বললাম।
উনার কণ্ঠে যদি কবিগুরু রবীন্দ্র নাথের গান শোনা যেতÑ, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এ জীবন ধন্য করো....” ভাল লাগতো। কিংবা কোন রাগের আলাপ করতেন, তো বেশ হতো। সে যাক, অনুষ্ঠানের সর্বস্তরের দর্শক শ্রোতার দিকে লক্ষ্য রেখেই গান নির্বাচন করতে হয়। তাই হয়তো উনি ঐ গানটিই বেছে নিয়েছিলেন। এরপর শুনলাম পিয়ালের কণ্ঠে “আমার মতো সুখি নয়তো কারও জীবন”।
এ গানটিও আমার নতুন শোনা হলো। অসম্ভব ভাল তবলা বাজিয়ে মুগ্ধ করলেন নরোত্তম ও ফণিদাস। এতোগুলো গানের সাথে তবলা বাজাতে গিয়ে ঘেমে উঠেছিলেন উনারা কিন্তু চেহারায় ফুল ফোটানো অমলিন হাসি লেগেই ছিলো শেষ অব্দি। চমৎকার ঝুমুর বাজালেন চিন্ময় সাহা। গানের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদে দুই নৃত্য শিল্পী ‘অর্পা ভৌমিক’ ও অন্য আরেকজনের (নাকি একজনেই দু’বার নৃত্য পরিবেশন করলো, ধরতে পারি নি।
আমার কাছে দু’জন মনে হয়েছে) নাচ অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে দিলো।
এর পরের পর্বে লালন সাঁইজির গান নিয়ে এলেন স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর শ্রদ্ধেয় সভাপতি যুগ্ম-সচিব জনাব সামসুজ্জামান সাহেবের স্নেহধন্য শিল্পী কুষ্টিয়ার ছেলে ভজন দাস। অবশ্য ক্ষ্যাপা নামে ওঁর একজন সহযোগীকে দেখলাম কিন্তু তিনি কোন গান গাইলেন না। সে যাক দু’জনের বেশভূষায়, আচার আচরণ দেখে ওদের সত্যিকারের সাধকের মতো মনে হলো। সাধনা না থাকলে কোন শিক্ষাই ধরা দেয় না।
সঙ্গীত বিষয়টি সম্পূর্ণ গুরুমুখি বিদ্যা। এ বিদ্যা অর্জন করতে হলে চাই সাধনার পাশাপাশি গুরু ভক্তি। মনে হলো ওঁরা দু’জন সত্যিকারের সাধনায় নিজেদের সঁপে দিয়েছেন। ভজন দাস মঞ্চে এসে বিনীতভাবে উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম যে গানটি গাইলেন, সেটি বাংলা কাওয়ালী। বাণী হচ্ছে, “আল্লাহ/খুলে দে নৌকা মাঝি যাবো মদিনায়”।
পরে লালনের “সে কি চেনে মানুষ রতন .... .... শিরনী খাওয়ার লোভ যার আছে”। এবং এ গানটির পর একের পর একটি করে দরদ দিয়ে লালন সাঁইজির গান পরিবেশন করে দর্শক শ্রোতার মন মাতালেন। অবশ্য এর মাঝে মিনিট তিনেকের জন্য বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিলো। আনন্দের রেশ থাকতে থাকতেই যখন গানের অবসান হলো, তখন রাত এগারোটা চার মিনিট। আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে।
সমগ্র নরসিংদীবাসির পক্ষে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, আমরা তাঁদের স্নেহ-ভালবাসা গায়ে মেখে, বিদায় নিয়ে মাইক্রোতে গিয়ে বসলাম। গাড়ির চাকা গড়াতে লাগলো। নরসিংদীবাসির কাছ থেকে যতোই ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছিলাম, ততোই আমার মনে হচ্ছিল জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতা, “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়........”
সত্যিকথা বলতে কি, একটি দেশে যখন সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের সুযোগ থাকে, তখন সমাজ থেকে অনেক অন্যায় অবিচার দূর হয়ে যেতে বাধ্য। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির জন্য চাই ব্যাপক গণসচেতনতা, সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ, সমাজের ভাল মানুষদের অংশগ্রহণ ও পাশাপাশি সরকারী উদ্যোগ। যেটি আমি নরসিংদী জেলা পরিষদ আয়োজিত ৪১তম মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে লক্ষ্য করলাম।
পেশাগত জীবনে একজন সাংবাদিক এবং নেশায় একজন কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে আমি অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। এসব অনুষ্ঠানগুলোর কোথাও সত্যিকারের সুস্থ সংস্কৃতি যেমন দেখেছি, তেমনি কোথাও নোংরা দলাদলী, ভাঙচুর, নিজেরা নিজেরা মারামারি করে অনুষ্ঠান প- হতেও দেখেছি। দেখেছি সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নৃত্য আর অপসংস্কৃতির নোংরামী। কিন্তু রাজধানীর বাইরে নরসিংদীর মতো একটি ছোট শহরে এই যে মহান স্বাধীনতা দিবসকে উদ্যাপন করা হলো, এখানে লোকজন এতো শান্ত, সভ্য ও শালিনতা বজায় রেখে ছয় ছয়টি ঘণ্টা পুরো অনুষ্ঠান উপভোগ করলো, অথচ কোথাও কোন অসামঞ্জস্য চোখে পড়লো না। এটি সত্যিই প্রশংসা করার মতো।
এতো বড়ো একটি অনুষ্ঠানে মাত্র দু’জন পুলিশ আমার নজরে এসেছে। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্মানিত জেলা পরিষদ প্রশাসক এডভোকেট মো: আসাদোজ্জামান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সচিব ও স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম-সচিব জনাব সামসুজ্জামান সাহেবসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় লোকজন যেভাবে আনন্দ উপভোগ করেছেন, এ দৃশ্য সত্যি বিরল। সারা দেশে যদি এমন নেতাদেরই জন্ম হতো, যাঁরা উঁনাদের মতো করেই এলাকার সর্বস্তরের লোকদের ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন, তবে হয়তো পুরো দেশের চিত্রই পাল্টে যেতো। জানি না তা কোনদিন হবে কিনা, তবে এরকমটাই কামনা থাকবে। এ কামনা শুধু আমার একারই নয়, সম্ভবত: সবার।
২রা এপ্রিল, ২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।