আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল...ড. হেনরি এ কিসিঞ্জার

কাজী ইনসানুল হক, টোকিও থেকে ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল এই সাক্ষাৎকারটি আমি গ্রহণ করি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি বিরুদ্ধকারী বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ড. হেনরি এ. কিসিঞ্জারের মুখোমুখি হবার সেই সুযোগটি আমার জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা। সেই সাক্ষাত্কারটি পাঠকদের অবগতির জন্য তুলে ধরছি। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল- ‘১৯৭১ সালে আপনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন , আমেরিকার পলিসি ছিল পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহযোগিতার, সরাসরি এ রকম প্রশ্নে বিব্রত হন তিনি। সামলে নিলেন নিজেকে।

রাগ চেপে অহেতুক বিনয় করেই জবাবটা দিলেন, জেন্টলম্যান ,সত্যটা জানবার চেষ্টা করুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয় ,ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল ,যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে না পড়ে। আমরা ভারতীয় বাহিনীর যে কোনো সুযোগে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের বিপক্ষে ছিলাম। ২০০৭ সালের ১ এপ্রিল। পূর্ব নিধারিত চীন সফরের পথে মাত্র ক ঘন্টার জন্য জাপানে আসেন ড. হেনরি এ কিসিঞ্জার।

উদ্দেশ্য জাপানের মর্যাদাবান ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানজনক ডক্টর অব ল গ্রহণ। ১৯৫৭ সাল থেকে এই পদক দেবার সূচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচয়ে আলোচিত সেক্রেটারি অফ স্টেট (৭৩-৭৭) একসময়ের হার্ভার্ডের প্রফেসর ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. হেনরি এ কিসিঞ্জারকে এই সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৯-১৯৭৭ পর্যন্ত U S Foreign Policy নিয়ে কিসিঞ্জারের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। মার্কিন -চীন সম্পর্কের উন্নতি ও পরবর্তিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানে তার ভূমিকার জন্য তার শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি।

ওয়াসাদা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৭ সাল থেকে এই সম্মানজনক পদক দিয়ে আসছে। প্রথম বছর এই পদক পান ভারতের পন্ডিত নেহেরু ও ও য়া সে দা এলুমিনি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী তানজেন ইশিবাসী। ১৯৬৯ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন ও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মান পেয়েছিলেন। নেলসন মান্ডেলা, বিল গেটস সহ বিশ্বের অনেক ব্যক্তিত্ব এই পদক পেয়েছেন। ও য়া সে দা বিশ্ববিদ্যালয়র আমন্ত্রণে ৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে ড. কিসিঞ্জারের প্রেস কভারেজের সুযোগ দেয়া হয়।

জাপান ফরেন প্রেস সেন্টারের ফরেন প্রেস মেম্বার (তত্কালীন সাপ্তাহিক ২০০০ র প্রতিনিধি ও জাপানের বাংলা কাগজ "পরবাস " সম্পাদক ) হিসেবে বাংলাদেশ থেকে আমি উপস্থিত হই। সকালের নির্ধারিত সেশন শেষে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ একটি কক্ষে, নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের সবার সাথে একজন করে গাইড দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও জাপানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সংক্ষিপ্ত প্রেস কনফারেন্স এ ড. কিসিঞ্জার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। পরিচয় পর্বে আমি বাংলাদেশের বলতেই তিনি আমার দিকে তাকান এবং ‘বেংলাদেশ’ ‘বেংলাদেশ’ বলতে থাকেন।

ড. ইউনূস এর নোবেল বিজয়ের কথাও বলেন। এ সময়েই আমি প্রথম প্রশ্নটি করি এবং তিনি উত্তর দেন। আমি তাকে বলি, আমাদের ইতিহাস কিন্তু আপনাকে সেভাবেই জানে এবং গণ হত্যাকারী পাকিস্তানিদের আমেরিকান সমরাস্ত্র সরবরাহর কথাটাও মিথ্যা নয়। হেনরী কিসিঞ্জার বলেন, পলিসিগত কারণে আমরা পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করি। স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

প্রশ্ন : স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারকে আপনি "বটমলেস বাস্কেট" বলেছিলেন... হেনরী কিসিঞ্জার : ও ভাবে বলেছি কিনা তা মনে নেই ,তবে সে সময়ে দুর্নীতির কারণে দেশটির পুনর্গঠন কাজ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছিল সেটা সত্যি। প্রশ্ন : ‘বাংলাদেশ’ সম্পর্কে এখন আপনার মূল্যায়ন কি ? হেনরী কিসিঞ্জার : ভৌগলিক কারণে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। দেশটির উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। আমি জাপানে প্রথম আসি প্রথম ১৯৫১ সালে , আজ ৫৬ বছর পর যে জাপানকে দেখছি তা কিন্তু সম্ভব হয়েছে সঠিক নেতৃত্বের জন্যই। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশেই এ নেতৃত্বের সংকট আছে।

তবে সামান্য হলেও বাংলাদেশ এগুচ্ছে। প্রতিবেশী ভারত, চীনতো অনেকটাই এগিয়েছে। এখন সময় এশিয়ার। আমি আশাবাদী। বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করি।

এরপর তিনি সব সাংবাদিকদের একসাতে লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানান। আমি কাছাকাছি হতেই ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, তোমার দেশবাসীকে জানিও ,আমি তাদের বিরুদ্ধে ছিলাম না, আমার কাছে সে সময়ের সব ডকুমেন্ট আছে ,আমার জীবিতাবস্থায় তোমাদের সরকারের উচিত তা সংগ্রহ করে সে সময়ের প্রকৃত অবস্থা জানার। তার শেষ বাক্যটায় বোধ হয় কিছুটা দুঃখবোধ ছিল - একসময়ের কৃতকর্মের জন্য আফসোস আর অজ্ঞাতেই ক্ষমা প্রার্থনার আর্তিটাও ছিল। একজন বাংলাদেশী হিসেবে একদার লৌহ মানবের এই পরাজয়ের আদলটা প্রত্যক্ষ করা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা বলেই মনে করি। প্রেস কনফারেন্সের জন্য নির্ধারিত ২৫ মিনিটের প্রথম ১৫ মিনিটেই তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন।

অন্য সাংবাদিকরা আমার প্রতি কিছুটা বিরক্ত হন। সরাসরি সম্প্রচারিত চিনা টিভির সাংবাদিক তার প্রশ্নের কোনো জবাব পাচ্ছিলেন না ,বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার এই সাক্ষাত্কারটি জাপানি টিভি ও মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায়। ড. কিসিঞ্জার তার সাক্ষাত্কারে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার অবস্থানকে যেভাবেই ব্যখা করুন না কেন প্রকৃতভাবে নিক্সন -কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রক্ষা করার জন্য মরিয়া ছিলেন ,কিন্তু ডিসেম্বরে ভারতীয় আক্রমণ তাদের সেই পলিসিকে ব্যার্থ করে দেয়। বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে গণ হত্যার অপরাধে নিক্সন-কিসিঞ্জার গং ইতিহাসের পাতায় নিজেদের কলঙ্কিত নাম কখনই আর মোছাতে পারবে না। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে মাত্র ৮ ঘন্টার সফরে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং ৩ মিনিটের একটি প্রেস কনফারেন্সে কেন তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সহযোগিতার জন্য USS ENTERPRISE কে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- এই প্রশ্নের জবাব দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

অথচ ওই সফরের পর পর আমেরিকান দূতাবাসের আয়োজনে গোপন বৈঠকে ক’জনার উপস্থিতির কথা পরবর্তীতে প্রকাশ হয় এবং তারপরেই ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ড। তথ্যসূত্র- Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.