মিনার মাহমুদ। তার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি-কথা হয়নি। তবে তাঁর নামটা খুব চেনা-খুব জানা। সাংবাদিকতা করার কারণে অন্য অনেকের কাছ থেকেই তাঁর সম্পর্কে জেনেছি। তাকে মনে হয়েছে অনেক আপন।
আজ বিদায় বেলায় তাঁর সম্পর্কে জানলাম আরো অনেক কিছু। তাতে শ্রদ্ধা আর ভালোলাগাটা অরো বাড়লো।
ঘটনার শুরুটা এভাবে। বিকেল বেলা অফিসে গিয়ে কম্পিউটার অন করতেই ইন্টারনেটে সৌদি আরব থেকে সাংবাদিক ও শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ফকরুল বাশার মাছুম ভাই জানতে চাইলেন মিনার মাহমুদ কিভাবে মারা গেলেন। আমি তখনো খবরটা শুনি নাই।
তাই সাথে সাথেই আমি অফিসে বাকিদের জিজ্ঞেস কলাম। কিন্তু এই তথ্য সম্পর্কে তখনো কেউ নিশ্চিত নন। কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম এটিএন নিউজের প্রধান বার্তা সম্পাদক প্রভাষ ভাই সেখানে যাচ্ছেন। প্রভাষদা একসময়ে মিনার ভাইয়ের সাথে নাকি কাজ করতেন। সাথে সাথেই ফোন দিলাম প্রভাষদাকে।
তিনি জানালেন, হোটেল রিজেন্সি থেকে বিকেলে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি মিনার ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছেন।
এরপর মিনার ভাইয়ের ছোট ভাই মেহেদি হাসানকে ফোন দিলাম। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারপরেও বললাম-ভাইয়া ঘটনা কি একটু বলবেন।
মেহেদি ভাই জানালেন, বুধবার বাসা থেকে বের হয়ে গেছেন মিনার ভাই। সারাদিন কোন খোঁজ পাননি। বিকেলে মোবাইল অন পাই। ফোন করলে পুলিশ ফোনটি ধরে জানায়, লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
মেহেদি ভাই জানালেন, একটি চিঠি লিখে গেছেন মিনার ভাই।
তাতে সাংবাদিক জীবন আর ১৮ বছরের প্রবাস জীবন নিয়ে তাঁর হতাশার কথাই লিখে গেছেন।
বুঝতে চাইলাম কেন মারা গেলেন মিনার ভাই? তাঁর লেখা শেষ চিঠি এবং সবার সাথে কথা বলে যেটা জানলাম- স্রেফ অভিমান থেকেই চলে যাওয়া।
৫০ বছর বয়সী মিনার ভাইয়রে জন্ম আমারই জেলা ফরিদপুর শহরে। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় লেখালেখির মধ্য দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতা জগতে পা রাখেন।
স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক শাসনামলে ১৯৮৭ সালের ১০ জুন মিনার মাহমুদের সম্পাদনায় প্রকাশ হয় সাপ্তাহিক ‘বিচিন্তা’।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী ভাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় স্বৈরাচারের নির্দেশে গুলি, হামলা, গণহত্যা চালানো হয়। ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা ও নিরোর বাঁশি’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপা হয় বিচিন্তায়। এরপরেই পত্রিকাটি নিষিদ্ধ, মিনার মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দেওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আবারো প্রকাশ হয় ‘বিচিন্তা’। তবে সে বছরই প্রকাশনা বন্ধ করে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে যান মিনার মাহমুদ। এরপর দীর্ঘ ১৮ বছর অভিমান করে তিনি দেশে আসেননি। তবে দেশের মাটিতে মরতেই বোধহয় তিনি ফেরেন।
২০০৯ সালে তিনি দেশে ফেরেন।
গত বছরের মার্চ মাসে মস্তিষ্কে বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকের পরামর্শে পূর্ণ বিশ্রামে ছিলেন মিনার মাহমুদ। তবে মনের ভেতরে তার কষ্টগুলো রয়েই গেছে।
মারা যাবার আগ্ই যে চিঠিটা মিনার ভাই লিখে গেছেন-তাতে স্ত্রীকে লিখেছেন, “আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, তোমার মতো মেয়ে হয় না। কিন্তু আমি বাঁচতে পারলাম না। অনেকবার চেষ্টা করেছি আত্মহত্যা করার, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে করতে পারিনি।
সর্বশেষ তোমার অগোচরে চলে এসেছি। আমার কাছে মাত্র ৪ হাজার টাকা আছে। কোনো সহায়সম্পত্তি নেই। কি করে আমি বাঁচবো? সবাই নতুন করে বাঁচতে চায়, কিন্তু আমি পারলাম না।
লিখেছেন, “১৮ বছরের দাসত্বের জীবন শেষ করে নতুন আশা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম।
অনেক চেষ্টা করেছিলাম নতুন পত্রিকায় যোগ দিতে, কেউ আমাকে নিতে চায়নি। সবাই চায় নতুন আর নতুন। আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। এ মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সুখে থেকো, ভালো থেকো।
আমাকে ক্ষমা করে দিও। ”
যে মিনার ভাই এদেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন-জেল খেটেছেন সেই মিনার ভাই দেশে আসার পর কয়জন তাঁর খোঁজ নিয়েছেন। মিনার ভাই যাদের হাতে ধরে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন তাদের অনেকেই আজ বড় সাংবাদিক। । অনেকের বাড়ি-গাড়ি-অর্থ সবই আছে।
কিন্তু মিনার ভাইয়রে কিছুই ছিলো না। দেশে আসার পর একটি চাকুরিও জোটেনি তাঁর। এই না হলে বাংলাদেশ। যেই গণতন্ত্রের জন্য লিখে জেলে গিয়েছেন মিনার ভাই-সেই মিনার ভাই কিছু না পেলেও তার বদৌলতে হাসিনা-খালেদারা প্রধানমন্ত্রী। আর চাটুকার সাংবাদিকরা পায় সব সুবিধা।
কিন্তু মিনার মাহমুদদের কোন খোঁজ নেয় না রাষ্ট্র।
আমি মিনার ভাইয়ের নিউজ লিখি আর মনে মনে যন্ত্রনায় কুকড়ে যাই। মাত্র কয়েকদিন আগেই শুনছিলাম আহমেদ নুরে আলম নামের আরকেজন সাংবাদিকের কথা। বাংলার বানী, জনকন্ঠের মতো পত্রিকায় তিনি চাকুরি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
অসম্ভব ভালো লিখতেন। বাংলাদেশের পরিবেশ সাংবাদিকতার জনক। প্রচন্ড অমায়িক ছিলেন। সবাইকে সাহায্য করতেন। কিন্তু এমন একজন ভালো মানুষ এই দেশে টিকতে পারনেনি।
তিনিও কয়েক বছর আগে প্রবাসে পাড়ি দিয়েছেন।
আমার গত কয়েকবছরের অভিজ্ঞতা আর সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, যারা এই দেশটাকে খুব ভালোবেসেছে-যারা মনে প্রাণে এই দেশটার জন্য কাজ করেছে-যারা সাংবাদিকতাকে খুব ভালোবেসেছে, নেশাগ্রস্তের মতো সাংবাদিকতা করেছে-সৎ জীবন যাপন করেছে তারা কেউই টিকতে পারনেনি। তাদের কাউকে আমরা সম্মান দিতে শিখেনি। তাই বড্ড অভিমানে তারা কেউ দেশ ছেড়ে চলে যান, কেউ পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু থেকে যায় সব খারাপ মানুষগুলো।
তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে। সাংবাদিকতাকেও তারা আজ করপোরেট বানিয়ে ফেলেছে। এদের অনেকেই গাড়ি-বাড়ি-বিত্তের কাছে হারিয়েছে তাদের সব মানবিকতা।
কিন্তু আহমেদ নূরে আলম, মিনার মাহমুদ-ফয়েজ আহমেদের মতো সাংবাদিকরা এটা পারেন না। তাই তারা এই রাষ্ট্রে অবহেলিত থেকে যায়।
মারা যাওয়ার পর আমরা তাদের নিয়ে আফসোস করি, শোকগাথা করি-কিন্তু বেঁচে থাকতে তাদের ভাবি বোকা। কেউ কেউ সমালোচনা করে বলি-খুব বিশঙ্খল জীবন যাপন করে। টাকা জমায় না। তারা বৈষয়িক না। তারা করপোরেট না।
কিন্তু সবকিছুর পরেও একটি কথাই কেবল বলতে চাই-এই মিনার মাহমুদরাই বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে আদর্শ হয়ে। তাদের মতো বোকারাই হবেন আমাদের আদর্শ। আমরা তাদের মতো সাংবাদিক হতে চাই। মানবিক হতে চাই। উচ্ছৃঙ্খল হতে চাই।
মিনার ভাই-আপনি আপনার মার্কিন জীবনের ১৮ বছরকে বলেছেন দাসত্বের জীবন। কিন্তু আজকাল এই দেশের করপোরেট গণমাধ্যমগুলোও দাসত্বের চর্চাই করছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে, ভালো রেজাল্ট নিয়ে, সব মোহ ছেড়ে শুধুমাত্র দেশ আর মানুষের জন্য কিছু করবো বলে, স্বাধীন পেশা হিসেবে, নিজের মতো করে থাকবো বলে যারা সাংবাদিতকতা করতে এসেছি তাদরেকে দাস বানাতে চায় অনেকেই। কিন্তু আমরা হতে চাই না। আমরা হতে পারি না।
কারণ আমরা চাই সাংবাদিক হতে। আমরা চাই মানবিক হতে। তাই বারবার প্রতিবাদ করি।
দোয়া করবেন মিনার মাহমুদ আর আলম ভাইরা-যেন আমরা সাংবাদিকতা আর মানবিকতার আদর্শ ধরে রাখতে পারি। এই করপোরেট যুগেও যেন আমরা মানুষ থাকতে পারি।
আমাদেরও অনেক টাকা পয়সার দরকার নেই। গাড়ি বড়ির দরকার নেই। লোকে না হয় আমাদের বোকাই বলুক। তারপেরও আমরা মানুষ থাকতে চাই। আর যখন পারবো না প্রতিবাদ করে টিকে থাকতে তখন না হয় আমরাও চলে যাবো।
আপনাদের সশ্রদ্ধ সালাম। আপনারা বেঁচে থাকবেন আমাদের মতো সাংবাদিকদের মনে..আদর্শ হয়ে..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।