বল আমায় সেই সময়ের নেই কেন অস্তিত্ব, বোঝাও আমায় সেই কল্পনার নেই কোন সমাধান.....আমারি স্বপ্ন আজো জেগে রয় আধারো শুন্য চোখে ... প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ জয় করতে শিখেছে নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে। বিশেষ করে আধুনিক সময়ে এসে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর কোনো কাজেই মানুষের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনে এখন শ্রবণ, দৃষ্টি বা অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও তৈরি হয়েছে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণের দারুণ সব সুযোগ। এসকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার কিছু সাম্প্রতিক কিছু উদ্ভাবনের কথা জানাচ্ছেন মোজাহেদুল ইসলাম
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এই সংগ্রামে কখনো মানুষের বাঁধা হয়েছে প্রকৃতি, কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শারীরিক অক্ষমতা।
অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ শারীরিক এসব অক্ষমতা নিয়েই জন্ম নেয়। তবে মানুষকে থামিয়ে রাখা যায়নি কখনোই। বিশেষত আধুনিক এই যুগে এসে প্রযুক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের অন্যতম সহায়। একদিকে চিকিত্সাবিজ্ঞানে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন মানুষকে সুযোগ করে দিচ্ছে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার, অন্যদিকে নানান ধরনের প্রযুক্তিপণ্য এসব অক্ষমতাকে অতিক্রম করে সুযোগ দিচ্ছে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এবং তাদের সহায়তায় তৈরি নানান প্রযুক্তি পণ্যের প্রদর্শনী নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
২৭তম এই সম্মেলনে প্রযুক্তি বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তারা নিজেদের নানান পণ্য ও সেবার সাথে কীভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধীরা খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করে। এর পাশাপাশি এই সম্মেলনে প্রদর্শিত হয় নানান ধরণের প্রযুক্তির উদ্ভাবন, যেগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করার জন্য। কম্পিউটার ইন্টারনেট এবং তথ্য প্রযুক্তির আধুনিক জীবনের সাথে যেন তারা পিছিয়ে না পড়ে, সে লক্ষ্যেই এসব ডিভাইসের উদ্ভাবন। এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত ডিভাইসগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি ডিভাইসের পরিচিতি তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
হেড মাউস এক্সট্রিম
আমাদের চারপাশে অনেক মানুষই রয়েছে যাদের হাত দুইটি পূর্ণ কর্মক্ষম নয়। অনেকে হাত দুইটি ঠিকমতো নাড়াতেও পারেন না। তাই বলে কি তারা কম্পিউটার চালাতে পারবেন না? এই ধরনের মানুষের জন্যই তৈরি করা হয়েছে হেডমাউস এক্সট্রিম। এটি মূলত একটি তারবিহীন মাউস যা কেবল মাথার নড়াচড়ার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাথার নড়াচড়ার প্রতিটি অংশকে সনাক্ত করার জন্য এতে রয়েছে একটি তারবিহীন অপটিক্যাল সেন্সর।
আর ব্যবহারকারীকে তার কপালে, মাথার কোনো টুপির সাথে অথবা চশমাতে ব্যবহার করতে হবে আরেকটি সেন্সর। এর ফলে ব্যবহারকারী তার মাথা নাড়ালেই সেই অনুপাতে কম্পিউটারে মাউসের কার্সরটিও নড়বে। কম্পিউটারের সামনে যেকোনো স্থানে বসেই যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারবেন। এই মাউসের কার্সর ডিসপ্লে রেজ্যুলেশনের প্রতিটি পিক্সেল সনাক্ত করতে পারে। ফলে এটি ব্যবহার করে নানান ধরনের ড্রয়িং, মাউস নিয়ন্ত্রিত গেমিং, নানান ধরনের গ্রাফিক্সের কাজ এবং ক্যাড (CAD)-এর মাধ্যমে নানান ডিজাইনের কাজও করতে পারবে।
ইউএসবি পোর্টের মাধ্যমেই পিসিতে সংযুক্ত করা যায় এই হেডমাউস এক্সট্রিম এবং এর জন্য আলাদা কোনো সফটওয়্যার ড্রাইভারও দরকার হয় না। এর সাথে অনস্ক্রিন কি-বোর্ডসহ রয়েছে বেশকিছু অ্যাপ্লিকেশন যা ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ সব ধরনের কাজই করা যায়। এটি তৈরি করেছে অরিজিন ইনস্ট্রুমেন্টস।
রুবি হ্যান্ডহেল্ড ভিডিও ম্যাগনিফায়ার
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা স্বল্পদৃষ্টি সম্পন্ন। তাদের জন্য দৈনন্দিন জীবনে নানান ধরনের লেখা পড়তে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
অনেকে আতশী কাঁচ ব্যবহার করলেও তা কাজ করে কেবল নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই। এই সমস্যা দূর করতে তৈরি করা হয়েছে রুবি হ্যান্ডহেল্ড ভিডিও ম্যাগনিফায়ার। মাত্র ৪.৩ ইঞ্চি আকৃতির এই বিবর্ধক যন্ত্রে রয়েছে উজ্জ্বল রঙের ডিসপ্লে। আর আকারে ছোট হওয়ায় একে সহজেই যেকোনো স্থানে বহন করা যায়। এ ব্যবহারও অত্যন্ত সহজ।
যন্ত্রটি চালু করার জন্য একটি বাটনে একবার চাপলেই হবে। তারপর যেকোনো লেখার উপরে একে ধরে লেখার আকৃতি বাড়ানোর বা কমানোর জন্য রয়েছে ‘+’ এবং ‘-’ বাটন। ফলে সহজেই যেকোনো লেখা জুম করা যায়। এতে রয়েছে এর ডিসপ্লে’র যেকোনো কিছুকে ছবি আকার ধারনের সুবিধা। এতে ধারণ করা ছবিকেও ইচ্ছেমতো জুম করা যায় পাশাপাশি সহজে পড়ার জন্য যেকোনো লেখার রং এবং লেখার ব্যাকগ্রাউন্ডের রংও পরিবর্তন করা যায়।
‘ফুল কালার’ মোড ছাড়াও এতে রয়েছে চারটি বিশেষ মোড—সাদা রেঙের উপর কালো লেখা, কালো রঙের উপর সাদা লেখা, হলুদ রঙের উপর নীল রঙের লেখা এবং নীল রঙের উপর হলুদ রঙের লেখা। চারটি AAA রিচার্জেবল ব্যাটারির সাহায্যে এটি একটানা দুই ঘন্টা চলতে পারে। আবার ব্যাটারির চার্জ শেষের দিকে আসলে বিশেষ একটি সংকেতের মাধ্যমে তা ব্যবহারকারীকে জানিয়েও দিবে যন্ত্রটি। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১৪ গুণ পর্যন্ত বিবর্ধন করা সম্ভব।
টোপাজ এইচডি ডেস্কটপ ভিডিও ম্যাগনিফায়ার
স্বল্প দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সহায়তায় রয়েছে আরেকটি বিশেষ বিবর্ধক যন্ত্র ‘টোপাজ এইচডি ডেস্কটপ ভিডিও ম্যাগনিফায়ার’।
১১ ইঞ্চি ডিসপ্লেবিশিষ্ট এই যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়েছে একটি হাইডেফিনেশন ক্যামেরা যা এই যন্ত্রে স্থাপিত যেকোনো ছাপা লেখার বিবর্ধিত স্পষ্ট প্রতিরূপ প্রদর্শন করতে সক্ষম। এই যন্ত্রটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন এতে স্থাপিত কোনো কিছুকে বড় করে দেখার জন্য আলাদা করে তা নড়াচড়া করাতে হয় না। বরং ডিসপ্লে থেকেই আলাদা আলাদা অংশকে বিবর্ধন করা যায়। এর ক্যামেরার নিচে রয়েছে কোনো বই বা বস্তু স্থাপন করার স্থান। এখানকার সোয়া আট ইঞ্চি স্থানের পূর্ণ ছবি ধারণ করতে পারে এই ক্যামেরা।
এতে নানান ধরনের টেক্সট পড়ার জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক ৩০টি হাই-কনট্রাস্ট টেক্সট কালার মোড। একে অবশ্য ভিজিএ পোর্টের মাধ্যমে পিসি বা ল্যাপটপের সাথেও সংযুক্ত করা যায়। ফলে, পিসি বা ল্যাপটপের ডিসপ্লের যেকোনো লেখা বা ছবিকেও এটি বিবর্ধন করতে পারে সহজেই। এর সাথে অবশ্য চাহিদানুযায়ী ২৪ ইঞ্চি আকৃতি পর্যন্ত ওয়াইডস্ক্রিন সংযুক্ত করা যায়।
ব্রেইল এজ ৪০
অন্ধদের জন্য কম্পিউটারে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কেননা প্রচলিত কি-বোর্ডের সাথে তারা পরিচিত নয়। অন্ধদের জন্য তাই বিভিন্ন লেখালেখির কাজে রয়েছে ‘ব্রেইল এজ ৪০’। এর মাধ্যমে নোট লেখা ও সংরক্ষণ করা যায় এবং বই বা অন্যান্য ডকুমেন্টস পড়াও যায়। পাশাপাশি এতে রয়েছে সিডিউলার, অ্যালার্ম, ক্যালকুলেটর, স্টপওয়াচ এবং কাউন্টডাউন টাইমার। এতে রয়েছে দুইটি পৃথক পৃথক চারদিকের নেভিগেশন কি এবং ৮টি ফাংশন কি (এসকেপ, ট্যাব, কন্ট্রোল, অলটার, শিফট, ইনসার্ট, উইন্ডোজ এবং অ্যাপ্লিকেশন)।
ফলে ব্যবহারকারী সহজেই এর মাধ্যমে তার টাইপিংয়ের কাজটি করতে পারে। এটি ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান এবং ইতালিয়ানসহ বেশকিছু ভাষা সমর্থন করে। একে পিসি বা অন্যান্য কম্পিউটিং ডিভাইসের সাথে ব্লু-টুথের সাহায্যে সংযুক্ত করা যায়। তা ছাড়া ইউএসবি’র সাহায্যেও একে সংযুক্ত করা যায়। এতে ৩২ গিগাবাইট পর্যন্ত এসডি কার্ড স্টোরেজ ব্যবহার করার সুবিধা রয়েছে।
ফলে এর মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই সংরক্ষণ করা যায়। এর ব্যাটারি পূর্ণ চার্জ দিলে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যাকআপ পাওয়া যায়। এর ব্রেইল ডিসপ্লেতে রয়েছে ৪০টি সেল।
ব্রেইল সেন্স ইউ২
অন্ধদের লেখার জন্য আরেকটি যন্ত্রের নাম ‘ব্রেইল সেন্স ইউ ২’। ১ গিগাহার্জ প্রসেসর এবং ৩২ গিগাবাইট ফ্ল্যাশডিস্ক স্টোরেজের এই ডিভাইস দিয়ে অন্ধরা খুব দ্রুত লিখতে পারবেন।
এতে পাঁচটি ভাষায় লেখার সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে এসব ভাষার জন্য আলাদা আলাদা ডিকশনারি। অন্ধদের জন্য এটি শিক্ষা সহায়ক উপকরণ হিসেবেও ব্যবহূত হতে পারে সহজেই। রয়েছে পূর্ণাঙ্গ সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর। ইন্টারনেট মেইল অ্যাকসেস প্রটোকল (IMAP) ব্যবহার করে একে সার্ভারে সংযুক্ত করে এর মাধ্যমে ই-মেইলও চেক করা যায়।
যেকোনো স্থানে একে ইথারনেট বা ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমেও যুক্ত করা যায়। ইউএসবি’র মাধ্যমে এতে থ্রিজি নেটওয়ার্কও ব্যবহার করা যায়। এছাড়া গুগল টক এবং টুইটারের সাথে সংযুক্ত হতে এতে রয়েছে সরাসরি বাটন। এতে রয়েছে বেশ কিছু মাল্টিমিডিয়া ফাংশন যার মাধ্যমে অডিও বা এফএম রেডিও শোনা যায়। এতে তিনটি ইউএসবি পোর্টের পাশাপাশি রয়েছে একটি মিনি ইউএসবি এবং এসডি স্লট।
আর ব্লু-টুথের মাধ্যমে একে ব্লু-টুথ সমর্থিত প্রিন্টার বা কিবোর্ডের সাথেও সংযুক্ত করা যায়। ৯২৪ গ্রাম ওজনের ব্রেইল সেন্স ইউ ২-এর ব্যাটারি ব্যাকআপ প্রায় ১৭ ঘণ্টা।
ইত্তেফাক
লেখক: মোজাহেদুল ইসলাম
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।